ভারতের মাটিতেই তৈরি হবে যুদ্ধজাহাজ, আত্মনির্ভরতার পথে নৌবাহিনী

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

আর বিদেশী যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ সংস্থার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না ভারতীয় নৌবাহিনীকে। রণতরী তৈরির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ‘স্বনির্ভর’ হতে চলেছে ভারত। নৌবাহিনীতে শামিল হওয়া ‘আইএনএস তমাল’ই হতে চলেছে বিদেশে তৈরি হওয়া শেষ রণতরী। এরপর থেকে দেশীয় প্রযুক্তি ও উৎপাদন সংস্থা পথ দেখাবে নৌবাহিনীকে। সম্প্রতি ‘আইএনএস তমাল’ হাতে পাওয়ার পর এই ঘোষণা করেছে নৌবাহিনী।

প্রসঙ্গত, ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে নৌসেনার জন্য নির্মিত ৩৯টি যুদ্ধজাহাজের মধ্যে ৩৩টি তৈরি হয়েছে ভারতীয় শিপইয়ার্ডে। ব্যতিক্রম কেবলমাত্র দু’টি। ‘আইএনএস তমাল’ এবং ‘আইএনএস তুশিল’। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বিমানবাহী যুদ্ধপোত ‘আইএনএস বিক্রান্ত’কে হাতে পায় ভারতীয় নৌসেনা। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ৪৫ হাজার টনের এই রণতরীর নির্মাণকারী সংস্থা হল কোচিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা এই যুদ্ধজাহাজ নির্মাণকে ভারতের নৌ ইতিহাসের মাইলফলক বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ, এর আগে কখনও এত বড় রণতরী তৈরিতে হাত দেয়নি নয়াদিল্লি।

যুদ্ধজাহাজ নির্মাণে ভারতের ‘আত্মনির্ভর’ হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ বহুদিনের। স্বাধীনতার পর থেকেই যুদ্ধজাহাজ নির্মাণে ‘আত্মনির্ভর’ হয়ে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে দেশ। প্রথম পর্যায়ে দিল্লির হাতে এ বিষয়ে কোনও প্রযুক্তি ছিল না, কোনও ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাও ছিল না। ফলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক ব্রিটেন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকে ফ্রিগেট ও ডেস্ট্রয়ার শ্রেণির রণতরী কিনতে বাধ্য হয়। তবে পদস্থ নৌসেনা আধিকারিকরা উপলব্ধি করেন, দীর্ঘস্থায়ীভাবে এই ব্যবস্থা চালানো যাবে না। যুদ্ধজাহাজ নির্মাণে দেশকে স্বনির্ভর হতে হবে।


সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ১৯৬০ সালে একটি ছোট টহলদারি যুদ্ধজাহাজকে নৌবহরে শামিল করে ভারতীয় নৌবাহিনী। নাম, ‘আইএনএস অজয়’। এটিই ছিল প্রথম দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি রণতরী। এই দশকের শেষের দিকে ব্রিটেনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ‘লিয়েন্ডার’ শ্রেণির ফ্রিগেট তৈরিতে হাত লাগায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা মাজগাঁও ডক শিপবিল্ডার্স। যদিও যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণে যন্ত্রাংশের অভাব সেই কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এইসব যন্ত্রাংশ নির্মাণের মতো প্রযুক্তি ভারতে তখন ছিল না। ফলে ভারতীয় নির্মাণ সংস্থাকে সেই যন্ত্রাংশের বেশিরভাগটাই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। ভারত সরকার ধীরে ধীরে সেই ঘাটতি পূরণ করতে থাকে। তা সত্ত্বেও ১৯৭০ সালে ‘লিয়েন্ডার’ শ্রেণির ফ্রিগেটগুলিতে মাত্র ১৫ শতাংশ ছিল দেশীয় উপাদান।

পরবর্তী তিন দশকে দ্রুত তার অগ্রগতি ঘটে। ২০০০ সালের পর ‘কলকাতা’ শ্রেণির ডেস্ট্রয়ারগুলিতে দেশীয় যন্ত্রাংশের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫৯ শতাংশ। সর্বশেষ ‘বিশাখাপত্তনম’ ও ‘নীলগিরি’ শ্রেণির ফ্রিগেট ও ডেস্ট্রয়ারে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ শতাংশে। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি যুদ্ধজাহাজগুলিকে আরও শক্তিশালী এবং অত্যাধুনিক করে গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেজন্য ২০০৫ সালে নয়াদিল্লিতে নৌবাহিনীর সদর দপ্তরে খোলা হয় ডাইরেক্টরেট অফ ইন্ডিজেনাইজেশন। রণতরী নির্মাণের উপাদানের পাশাপাশি এর নকশার দিকেও নজর দিয়েছে ভারতীয় নৌসেনা। ১৯৬৪ সালে বাহিনীর তত্ত্বাবধানে তৈরি হয় সেন্ট্রাল ডিজাইন অফিস বা সিডিও। ছ’বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯৭০ সাল নাগাদ সেটাই ‘নৌ-নকশা অধিদপ্তর’ বা ডিএনডিতে বদলে যায়।

প্রসঙ্গত, রাশিয়া গত ১ জুলাই ‘আইএনএস তমাল’কে ভারতীয় নৌবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। সেটি তৈরি হয়েছে মস্কোর কালিনিনগ্রাদের ইয়ান্টার শিপইয়ার্ডে। এই রণতরীটি প্রকৃতপক্ষে একটি ‘স্টেল্‌থ’ ফ্রিগেট। পুরাণ মতে, ইন্দ্রের তলোয়ারের নাম ‘তমাল’। সেই কারণে দেবরাজের প্রিয় হাতিয়ারটির সঙ্গে মিলিয়ে যুদ্ধজাহাজটির নাম রাখা হয়েছে। এমনটাই জানিয়েছে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। পরে মুম্বই এবং বিশাখাপত্তনমে আরও দুটি শাখা খোলে কেন্দ্র সরকার।

জানা গিয়েছে, ‘প্রকল্প ১১৩৫.৬’-এর অংশ হিসাবে রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ‘আইএনএস তমাল’ রণতরীটি নির্মাণ করেছে নয়াদিল্লি। প্রযুক্তি ও যন্ত্রাংশ মিলিয়ে ‘আইএনএস তমাল’ নির্মাণে ভারতের অবদান রয়েছে ২৬ শতাংশ। এই যুদ্ধ জাহাজে আছে ইউক্রেনের অত্যাধুনিক গ্যাস টার্বাইন ইঞ্জিন। ‘তলোয়ার’ শ্রেণির অষ্টম ফ্রিগেট হিসাবে একে বহরে শামিল করেছে এ দেশের নৌসেনা। যুদ্ধজাহাজটিকে ‘ক্রিভাক থ্রি’ শ্রেণির ফ্রিগেটের উন্নত সংস্করণ বলেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা। নৌসেনার বহরে অত্যাধুনিক ‘স্টেল্‌থ’ ফ্রিগেটটি যুক্ত হওয়ায় তাদের শক্তি যে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেল তা বলাই বাহুল্য।

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা বিদেশে তৈরি সর্বশেষ যুদ্ধজাহাজ ‘আইএনএস তমাল’কে একটি বহুমুখী ফ্রিগেট বলে উল্লেখ করেছেন। যুদ্ধজাহাজটির ওজন প্রায় ৪,০৩৫ টন। এটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ১২৪.৮ মিটার ও ১৫.২ মিটার। এটি চালাতে ২৬ জন অফিসার এবং ২৫০ জন নাবিকের প্রয়োজন হবে বলে জানা গিয়েছে। সমুদ্রে সর্বোচ্চ প্রায় ৫৬ কিমি প্রতি ঘণ্টা (৩০ নট) ছোটার ক্ষমতা রয়েছে ‘আইএনএস তমাল’-এর। রণতরীটির পাল্লা ৪,৮৫০ নটিক্যাল মাইল। সোজা রাস্তায় যেটা প্রায় ৮,৯৮০ কিমি।

তমালে রয়েছে দু’ধরনের লড়াকু জেট, যা বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম। সেগুলি হল, ভূমি থেকে আকাশ এবং স্বল্পপাল্লার ইগলা ক্ষেপণাস্ত্র। এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলার জন্য যুদ্ধজাহাজটির ভিতরে রয়েছে ২৪টি উল্লম্ব উৎক্ষেপণ লঞ্চার। আটটা ইগলা ছুড়তে পারবে ‘আইএনএস তমাল’। এ ছাড়া নিখুঁত নিশানায় ৭০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে শিলের।