আন্তঃবর্ণ বিবাহের ক্ষেত্রে মায়ের জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে শংসাপত্র পাবে সন্তান, দৃষ্টান্তমূলক রায় সুপ্রিম কোর্টের

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

বাবা উচ্চবর্ণের হলেও মায়ের পরিচয়ের ভিত্তিতেও তফসিলি জাতির শংসাপত্র পেতে পারে সন্তানরা। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের একটি মামলায় এমনই রায় দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। অর্থাৎ মনে করা হচ্ছে, এখন থেকে তফসিলি জাতিভুক্ত কোনও মহিলা যদি উচ্চবর্ণের সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন, তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে তাঁদের সন্তান মায়ের জাতি পরিচয়ের ভিত্তিতে শংসাপত্র পেতে পারেন। আইনজ্ঞদের মতে, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। 

প্রধান বিচারপতি সূর্য কান্ত এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর বেঞ্চ গত ৮ ডিসেম্বর এই রায় দিয়েছে। বিচারপতিরা রায় দিয়েছেন, বাবা তফসিলি জাতিভুক্ত না হলেও সন্তানের ক্ষেত্রে মায়ের পরিচয়ে জাতিগত শংসাপত্র পেতে পারে সে। শুনানি চলাকালীন, প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘যুগ পাল্টেছে। তা হলে মায়ের পরিচয়ের ভিত্তিতে কেন জাতিগত শংসাপত্র দেওয়া যাবে না’ ? আদালত আরও স্পষ্ট করে বলে, এই জটিলতার কারণে কোন ভাবেই যেন মেয়েটির শিক্ষায় বাধা না আসে। 
 
পুদুচেরীর বাসিন্দা এক মহিলা নিজের ২ মেয়ে ও ১ ছেলের তফসিলি জাতি শংসাপত্র বানানোর জন্য আবেদন জানান তহসিলদারকে। তাঁর যুক্তি ছিল, বিয়ের পর থেকে তাঁর বাপের বাড়িতেই রয়েছেন স্বামী। ওই মহিলা নিজেকে ‘আদি দ্রাবিড়’ সম্প্রদায়ের বলে পরিচয় দেন। মাদ্রাজ হাইকোর্ট থেকে সেই মামলা এসে পৌঁছয় শীর্ষ আদালতে। মহিলার পরিচয়ের ভিত্তিতেই তাঁর মেয়ের জাতি শংসাপত্র তৈরিতে অনুমতি দেওয়া হয়। আদালতের এই রায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।  
 
দেশের আইন অনুযায়ী, অনুচ্ছেদ ১৫ এবং ১৬ তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা দেয়। কিন্তু কাদের তফসিলি জাতি ও উপজাতি হিসেবে গণ্য করা হবে তা নির্ধারণ করা সহজ নয়। তফসিলি জাতি ও জনজাতিভুক্তদের জাতিগত শংসাপত্র প্রদানের নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম রয়েছে। এত দিন বাবার জাতি পরিচয় সন্তানদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হত।
১৯৬৪ সালের ৫ মার্চ এবং ২০০২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারির প্রেসিডেন্সিয়াল নোটিফিকেশনে বলা হয়, বাবার জাতের ভিত্তিতেই সন্তানরা শংসাপত্র পাবে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের কোন এলাকায়, কী পরিস্থিতিতে আবেদনকারীর বসবাস, তা বিবেচনা করা হবে।২০০৩ সালে পুনীত রাই বনাম দীনেশ চৌধরি মামলায় সুপ্রিম কোর্টও জানিয়ে দেয়, নির্দিষ্ট আইন না-থাকলে বাবার জাতি পরিচয়ই পাবেন সন্তান। 
 
ভারতীয় সংস্কৃতিতে এতদিন পর্যন্ত বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিয়ের পর স্বামীর গোত্রই গ্রহণ করার চল রয়েছে। যদিও তার বাস্তবতা নিয়ে বহুবার প্রশ্ন উঠেছে। মহিলারা সন্তানের জাতি নির্ধারণ করতে পারেন কি না সেই প্রশ্নও উঠেছে। বিশেষ করে সামাজিক পরিবেশের কথা উঠে এসেছে বার বার। তা সত্ত্বেও বাবার জাতি পরিচয়ে সন্তানের বেড়ে ওঠার চল আজও রয়েছে। যদিও এটি একটি ধারণা ব্যাতীত অন্য কিছু নয় বলে আগেও জানিয়েছে আদালত। 
 
২০১২ সালে রমেশভাই দাভাই নাইকা বনাম গুজরাত সরকার মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, আন্তঃবর্ণ বিবাহের ক্ষেত্রে মামলার সমস্ত তথ্য খতিয়ে না-দেখে সন্তানের জাতিগত পরিচয় নির্ধারণ করা যাবে না। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয়, যদি বাবা উচ্চবর্ণের এবং মা তফসিলি জাতিভুক্ত হন, আর যদি সন্তান মায়ের সান্নিধ্যে বড় হয়, সে ক্ষেত্রে মায়ের পরিচয়ের নিরিখে জাতিগত শংসাপত্র দেওয়া যেতে পারে।
তবে এসব ক্ষেত্রে সন্তানকে প্রমাণ দেখাতে হবে যে, পিতা উচ্চবর্ণের হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোনও বাড়তি সুযোগ সুবিধা পাননি, বরং মা যে সম্প্রদায়ের ছিলেন, সেই সম্প্রদায়ের অন্য সদস্যদের মতোই বঞ্চনা, অপমান এবং প্রতিবন্ধকতা তাঁকেও ভোগ করতে হয়েছিল। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের যে রায় দিয়েছে তা  অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে আন্তঃবর্ণ বিবাহের ক্ষেত্রে সন্তানের জাতিগত শংসাপত্র নিয়ে এক নতুন দিশার সন্ধান মিলেছে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল।