আগামী ৬ নভেম্বর বিহার বিধানসভার প্রথম দফার ভোট। বিধানসভার ভোটে জয়লাভ করলে বিরোধী ইন্ডিয়া জোট মুখ্যমন্ত্রী করবে লালুপুত্র তেজস্বী যাদবকে। এই ঘোষণা করে নীতীশের এনডিএ জোটকে প্রথম গোলটা দিয়ে দিয়েছে বিরোধীরা। সেখানে এনডিএ জোটের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আগামী মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার হবেন, এমন কথা সরাসরি বলেননি। বলেছেন, নীতীশ কুমারের নেতৃত্বেই এনডিএ জোট এবার বিহার নির্বাচনে লড়বে এবং বিপুলভাবে জয়ী হয়ে আবার সরকার গড়বে। এটাই মোদীর গ্যারান্টি। মুখে নীতীশের নেতৃত্বে এনডিএ জোট লড়ছে বলা হলেও আদতে পুরোটাই ‘মোদী শো’ করতে চাইছে বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কেন্দ্রীয় সরকারই বিগত পাঁচ বছরের উন্নতির কারণ বলে ভাষণে বারে বারে উল্লেখ করেছেন মোদী। ইউপিএ আমলে যে টাকা বিহার পেয়েছে, তার তিন গুণ বেশি অর্থ দেওয়া হয়েছে মোদী আমলে। ভবিষ্যৎ বিহার গঠনের দায়িত্ব ও নিচ্ছেন মোদী। কিন্তু ভোটের পরও নীতীশই মুখ্যমন্ত্রী হবেন, এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এড়িয়ে গেলেন মোদী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, সামনে কোনও মুখ রেখে প্রচারে নামলে ভোটের লড়াইয়ে এক শ্রেণির ভোটারের উপর যথেষ্ঠ প্রভাব পড়ে। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে রাম আমলে জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বা তৃণমূল জমানায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমে বামফ্রন্ট কিংবা তৃণমূল বাড়তি সুবিধা পেয়েছে। বিহারের বিরোধী জোট মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তেজস্বী যাদবের নাম আগে ঘোষণা করে এই রাজনৈতিক লড়াইয়ে এগিয়ে থাকার প্রচার করবে সন্দেহ নেই।
আর এখানেই সঙ্কটে পড়েছে শাসক জোট। এনডিএ-র প্রধান শরিক জেডিইউ নেতা নীতীশ কুমার গত কুড়ি বছর বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পদে রয়েছেন। এবারও ভোটে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছার কথাও প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিজেপির দুই শীর্ষ নেতা নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বিহারে নীতীশ কুমারের নেতৃত্বে এনডিএ ভোটের লড়াইয়ে নামলেও মুখ্যমন্ত্রীর নাম ঠিক হবে ফলাফল ঘোষণার পরেই। এখানেও ‘মহারাষ্ট্র মডেল’ কার্যকর করতে চাইছে বিজেপি। মহারাষ্ট্রে একনাথ সিন্ধেকে সামনে রেখে এনডিএ ভোটে গেলেও ফলাফল ঘোষণার পর বিজেপি-র দেবেন্দ্র ফড়নবিশকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছিল। বিহারের ক্ষেত্রেও মোদী-শাহের সেই কৌশল দেখছেন অনেকে। নীতীশকে সামনে রেখে আসন সংখ্যা বিজেপি সামান্য বাড়াতে পারলেই নীতীশ হয়ে যাবেন বিহারের ‘একনাথ সিন্ধে’। কাজেই মুখ্যমন্ত্রীর নাম নিয়ে এনডিএ জোটের প্রধান দুই শরিকের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে। উল্টো দিকে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের প্রার্থী হিসেবে তেজস্বীর নাম ঘোষণা সেই লড়াইয়ে যেন ঘি ঢেলেছে।
বিহারে ভোটে জেতাটা এখন বিজেপির কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা শুধু সে রাজ্যের জন্য নয়, পশ্চিমবঙ্গের জন্যও। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী এপ্রিল মাসের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ভোট শেষ করতে হবে। তার মানে হাতে আর মাত্র ছ’মাস সময়। বাংলায় বিজেপির নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় ভোট আছে। কিন্তু রাজ্যের অর্ধেক বুথ এলাকায় তাদের সংগঠন বলে কিছু নেই। দলের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্বের কথাবার্তা, চিন্তাভাবনার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, দলীয় কোন্দল, নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব যে কোনও শাসক দলকেও লজ্জা দেবে। বিরোধী দলগুলিকে শায়েস্তা করতে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি, বিশেষত সিবিআই এবং ইডি-কে ব্যবহার করে আবার নিশ্চুপ হয়ে যাওয়ার বিষেয়ে বিজেপির আন্তরিকতা নিয়েই সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বাংলাকে কেন্দ্রের বঞ্চনা বিষয়েও বিজেপির কোনও সন্তোষজনক উত্তর নেই। কাজেই বিহার শুধু একটি রাজ্যের ক্ষমতা দখল নয়, বিজেপির কাছে একটা পরীক্ষা। বিহারের সংশোধিত ভোটার তালিকা এবং ধর্ম ও বিভাজনের রাজনীতির প্রচার মোদী-শাহর দিকে কতটা ঝুঁকে পড়বে, সময়ই তার সাক্ষ্য দেবে। আর অন্যদিকে বিরোধী ‘মহাগোটবন্ধন’ বা ‘ইন্ডিয়া’ জোটের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী তেজস্বী যাদব বিহারকে আগামী দিনে দেশের মধ্যে অন্যতম বিকাশশীল রাজ্যে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর।