ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন বা এসআইআর-এর কাজে অমানুষিক চাপ— এবার সেই অভিযোগের মাঝেই উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থানে ফের মৃত্যু হল তিন বুথ-স্তরের আধিকারিকের (বিএলও)। প্রবল মানসিক চাপ, নিদ্রাহীন জীবন আর অসম্ভব টার্গেটের বোঝায় এক শিক্ষক আত্মঘাতী হয়েছেন মুরাদাবাদে। একই সময়ে বিজনৌর ও রাজস্থানের ঢোলপুরে দুই বিএলও মারা গিয়েছেন হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে। তিনটি মৃত্যুই নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনিক কাঠামোর ওপর বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
জানা গিয়েছে, রবিবার সকালে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ৪৫ বছর বয়সি সর্বেশ সিংয়ের দেহ। পেশায় শিক্ষক সর্বেশ প্রথমবারের জন্য বিএলও-র দায়িত্ব পেয়েছিলেন। টানা রাত জাগা কাজ, অনলাইন ফর্ম আপলোড এবং অসম্ভব টার্গেট— সব মিলিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। পুলিশ দেহ উদ্ধারের সময় তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার করেছে তিন পাতার সুইসাইড নোট।
সেখানে লেখা রয়েছে, ‘রাত-দিন কাজ করতে হচ্ছে। মাত্র দু’-তিন ঘণ্টা ঘুমোতে পারছি। টার্গেট পূরণ হচ্ছে না। চার মেয়ে, তার মধ্যে দু’জন অসুস্থ— কী করে এই পরিস্থিতি সামলাব? বাঁচতে চাই, কিন্তু উপায় নেই।’
পরিবারের দাবি, কয়েক দিন ধরে সর্বেশ আর আগের মতো ছিলেন না। মুখে ক্লান্তি, কথায় হতাশা। শনিবার গভীর রাতে বাড়ির ঘরে আত্মহত্যা করেন তিনি। সহকর্মীরা জানান, এসআইআর-এর কাজের চাপে গত দুই সপ্তাহ ধরেই চরম অস্থিরতায় ছিলেন সর্বেশ।
এদিকে উত্তরপ্রদেশের বিজনৌর জেলার ধামপুর এলাকার ৫৬ বছরের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী শোভারানিও ছিলেন এসআইআর-এর দায়িত্বে। তারই মধ্যে ছেলের বিয়ের প্রস্তুতি চলছিল বাড়িতে। ফলে রাতে জেগে ফর্ম আপলোড করতে হচ্ছিল তাঁকে। পরিবারের অভিযোগ, শুক্রবার গভীর রাতে কাজের ফাঁকে হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করেন শোভারানি। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও শনিবার সকালে সেখানেই মৃত্যু হয় তাঁর।
যদিও এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসন দাবি করেছে, শোভারানির ওপর ‘অতিরিক্ত চাপ’ ছিল না। কিন্তু পরিবারের দাবি, কয়েক সপ্তাহ ধরে রাতজাগা কাজই তাঁর মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
অন্যদিকে, রাজস্থানের ঢোলপুরের বাড়িতে বসে ভোটারদের তথ্য আপলোড করছিলেন অনুজ গর্গ, তাঁর বয়স মাত্র ৪২ বছর। পেশায় শিক্ষক, পাশাপাশি এসআইআর-এ নিযুক্ত বিএলও। শনিবার রাতেই আচমকা অসুস্থ হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। পরিবারের দাবি, প্রতিদিন গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হত অনুজকে। বোন বন্দনা গর্গ বলেন, ‘শনিবার রাতে চা চেয়েছিল দাদা। কিন্তু চা নিয়ে আসার আগেই সব শেষ।’
যদিও ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এখনও আসেনি। তবে পরিবারের দাবি, এসআইআর-এর চাপে অনুজ শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
ফলে এভাবে একই সুতোয় গাঁথা তিন মৃত্যু, চাপে ক্ষুব্ধ সহকর্মীরা। গত কয়েক সপ্তাহে শুধু উত্তরপ্রদেশেই এসআইআর-এর অতিরিক্ত দায়িত্বে অন্তত সাত জন বিএলও-র মৃত্যু হয়েছে বলে সহকর্মীদের দাবি। এর মধ্যে তিন জন আত্মঘাতী। সেজন্য বিএলও সংগঠনগুলির অভিযোগ, ‘অতিরিক্ত ডেটা আপলোড, অবাস্তব টার্গেট এবং দিন-রাত কাজের নির্দেশ। সব মিলিয়ে এক অসম্ভব পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এটা প্রশাসনিক কাজের নামে মানবিকতার চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম।’
মুরাদাবাদ থেকে ঢোলপুর, মৃতদের পরিবারগুলির প্রশ্ন— চাপ কমানোর কোনও ব্যবস্থা কেন নেই? কেন বিএলও কর্মীদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, মানসিক সহায়তার কোনও নীতি নেই? প্রশাসনের তরফে তিনটি মৃত্যুর ক্ষেত্রেই তদন্তের আশ্বাস দেওয়া হলেও ক্ষোভ কমেনি বিএলও কর্মীদের। সর্বেশের ভাইয়ের কথায়— ‘যাঁরা দিনরাত কাজ করছেন, তাঁদের জন্য অন্তত নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা হোক। কত মৃত্যু হলে নজর দেবে সরকার?’
ফলে এসআইআর-এর এই লাগাতার কাজের চাপ ভবিষ্যতে আরও বিপর্যয় ডেকে আনবে কি না, সেই প্রশ্নই এখন জোরালো হয়ে উঠছে রাজ্যগুলির প্রশাসনিক মহল, শিক্ষক সংগঠন এবং নির্বাচনী দপ্তরের অন্দরে।