জগন্নাথ দেবের উল্টোরথ

এবার পুরীতে জগন্নাথদেবের উল্টোরথে ভক্তের সমাবেশ হয়েছে প্রায় চল্লিশ লক্ষ। আজ ছিল বলরাম, সুভদ্রা ও জগন্নাথ দেবের ‘সোনাবেসা’ বা ‘স্বর্ণবেশ’। এতে ভক্ত সমাবেশ আশা করা হচ্ছে পঞ্চাশ লক্ষ ছাপিয়ে যাবে। এদিন পুরী স্টেশন থেকেই সবরকমের যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়েছে। মন্দিরের তিন কিলোমিটারেরও বেশি ব্যাসার্ধ এলাকায় যান চলাচল বন্ধ। তাই যাঁরা স্বর্ণবেশ দেখার জন্য মন্দিরের দিকে যাচ্ছেন, তাঁদের অশেষ কষ্টের মধ্যে পড়তে হচ্ছে।

দেখা গেল, কাঁধে এক বছরের সন্তান নিয়ে বাবাকে, ছয় মাসের সন্তান নিয়ে মাকে বা আশি বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে। কেন এই কষ্ট করে এখানে এসেছেন, সে সম্বন্ধে বাইশ জন পুণ্যর্থীকে জিজ্ঞেস করায় পাওয়া গেল একই উত্তর— মহাপ্রভুর কাছে যেতে কষ্ট! কী বলছেন?’ বোঝা গেল, এত মানুষ কীসের টানে ছুটে এসেছেন। শুধুমাত্র মুহূর্তের জন্য একবার দর্শন আর একান্তই ভাগ্যবান হলে রথের রশি একবার ছোঁয়া— আর যাঁর ভাগ্য আরও ভাল তিনি হয়ত রশি ধরে কয়েক পা হাঁটতেও পারছেন। আর সেই ভাগ্যবানের চোখমুখ দেখলে মনে হচ্ছে, তাঁরা ঈশ্বর দর্শনে প্রবল আবগাপ্লুত। এ আনন্দের সঙ্গে কোটি টাকারও তুলনা চলে না। এখানে ধনী-গরীব, জাতপাতের কোনও ব্যাপার নেই। জগন্নাথের কৃপায় এখানে সব একাকার। সবারই এক লক্ষ্য— একবার জগন্নাথ দর্শন।

কথা হল পঁচিশ বছরের সঙ্কেত সাউয়ের সঙ্গে। কলকাতায় সিঁথির মোড়ের কাছে তাঁর বাড়ি। একেবারে আধুনিক যুবক। তাঁদের দলে আছেন মোট এগারোজন— বাবা, মা, কাকা, ভাই, বন্ধুবান্ধব। বললেন, তাঁর বাবা তাঁর জন্মের বছর থেকে এখানে আসছেন। আর এখন এখানে আসে তাঁদের পুরো পরিবার।


তিনি জানালেন, ‘‍আমরা আর না এসে থাকতে পারব না। মঙ্গলবার রাতে ফিরব জগন্নাথদেবের রসগোল্লা ভোগ দেখে ও খেয়ে।’ দেখা হল ভাগ্যশ্রী ঘোষের সঙ্গে। একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। বয়স পঁচিশেরও কম। এই কম বয়সে এখানে আসার কারণ জিজ্ঞেস করায় প্রচণ্ড আবেগ ও উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ‘বয়স! পুণ্যের আবার বয়স! আমি আজ চার বছর আসছি এবং প্রতি বছর বলরাম, সুভদ্রা ও জগন্নাথদেবের রশি টানবই। এবারেও টেনেছি।’

এই ভিড়ে ভয় লাগে না জিজ্ঞেস করতেই জবাব দিলেন, ‘কীসের ভয়, মরে যাবার? মরতে তো একদিন হবেই। আর যদি বলেন অসভ্যতা? তা পৃথিবীর কোথায় নেই? সে কথা চিন্তা করে কি বাড়িতে বসে থাকব?’ এর পরে আর কিছু বলা যায় না। জগন্নাথ দর্শনের জন্য মানুষের এই আবেগের কাছে সব বাধাবিপত্তি একেবারেই তুচ্ছ, সেটা স্পষ্ট।