দূষিত বাতাস, নীরব সংসদ

দিল্লির বায়ুদূষণে তৈরি হয়েছে ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সংকট। অথচ এই জরুরি পরিস্থিতি নিয়ে সংসদে আলোচনা এড়িয়ে যাওয়া গণতান্ত্রিক দায়িত্বহীনতারই পরিচয়। দিল্লির আকাশ আজ আর কেবল ধোঁয়ায় ঢাকা নয়, সেই সঙ্গে ঢেকে যাচ্ছে রাষ্ট্রের দায়িত্ববোধও। রাজধানীর বায়ুদূষণ এবারও ‘ভয়াবহ’ স্তর ছাড়িয়ে ‘অসহনীয়’-র দিকে এগোচ্ছে। দিনের পর দিন এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বিপজ্জনক সীমা অতিক্রম করছে।

শ্বাস নেওয়াই যেন স্বাস্থ্যঝুঁকির সমার্থক হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে সংসদে বিরোধী দলের সাংসদরা যখন বায়ুদূষণ নিয়ে আলোচনা চেয়েছিলেন, তখন সরকার পক্ষ থেকে সেই সুযোগ না দেওয়া গভীরভাবে উদ্বেগের কারণ বৈকি।দিল্লির বায়ুদূষণ কোনও নতুন সমস্যা নয়। এটি বহু বছরের জমে থাকা ব্যর্থতার ফল। যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত সংখ্যা, পুরনো ও দূষণকারী গাড়ির অবাধ চলাচল, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, লাগামছাড়া নির্মাণকাজ থেকে ওঠা ধুলো, শিল্পাঞ্চলের নির্গমন এবং প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতে ফসলের অবশিষ্ট পোড়ানোর ধোঁয়া— সব মিলিয়ে রাজধানী কার্যত এক বিষাক্ত বলয়ে আবদ্ধ।

শীতকালে বাতাসের গতি কমে যাওয়ায় এই দূষণ শহরের উপরই আটকে থাকে, পরিস্থিতি আরও মারাত্মক আকার নেয়।এই দূষণের প্রভাব শুধু চোখে জ্বালা বা কাশির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। চিকিৎসা গবেষণা স্পষ্ট করে দেখাচ্ছে, দীর্ঘদিন দূষিত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার ফলে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমছে, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ছে। শিশুদের ক্ষেত্রে ক্ষতি আরও গভীর। বহু শিশুর ফুসফুস স্বাভাবিক হারে বেড়ে উঠছে না, যার ফল তারা সারা জীবন বহন করবে। গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রেও বাড়ছে জটিলতা, বাড়ছে অপরিণত শিশুর জন্মের আশঙ্কা। এটি নিছক পরিবেশগত সমস্যা নয়, একটি প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন।


এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অভিঘাতও কম নয়। দূষণের সময় স্কুল বন্ধ রাখতে হয়, খেলাধুলা নিষিদ্ধ হয়, নির্মাণকাজ থমকে যায়। হাসপাতালগুলিতে শ্বাসকষ্টের রোগীর ভিড় বাড়ে, চিকিৎসা খরচ বৃদ্ধি পায়। কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ায় উৎপাদনশীলতার ক্ষতি হয়, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে অর্থনীতির উপর। তবু এই সংকটকে এখনও অনেক ক্ষেত্রে ‘মৌসুমি সমস্যা’ হিসেবে দেখার প্রবণতা থেকেই যাচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে সংসদে আলোচনা এড়িয়ে যাওয়া সরকারের মনোভাব প্রশ্নের মুখে পড়ে। সংসদ কোনও আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি জাতীয় সমস্যার সমাধান খোঁজার সর্বোচ্চ মঞ্চ। দূষণ কোনও দলীয় ইস্যু নয়, এটি আন্তঃরাজ্য ও জাতীয় স্তরের সংকট। এর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় অপরিহার্য। সংসদে আলোচনা হলে দায়িত্ব নির্ধারণ হতো, দীর্ঘমেয়াদি নীতির রূপরেখা তৈরি হতো এবং সর্বোপরি জনগণের সামনে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট হতো।

গণতন্ত্রে প্রশ্ন তোলা অপরাধ নয়, বরং কর্তব্য। বিরোধীদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে সমস্যাকে আড়াল করা যায় না। দিল্লির বায়ুদূষণ আজ কেবল শ্বাস নেওয়ার সংকট নয়, এটি রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার ও সংবেদনশীলতার পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে প্রথম শর্ত একটাই– সমস্যার মুখোমুখি হওয়া। আর সেই মুখোমুখি হওয়ার জায়গা সংসদই।