বিরোধী সাংসদদের নির্বাচন কমিশন ঘেরাও অভিযানকে কেন্দ্র করে সোমবার তোলপাড় রাজধানী। আক্ষরিক অর্থে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় দিল্লির রাজপথ। এসআইআর-এর নামে ভোট চুরির প্রতিবাদে দিল্লির নির্বাচন কমিশনের সদর দপ্তর ঘেরাও করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন বিরোধী দলের সাংসদরা। রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, মহুয়া মৈত্র, সুস্মিতা দেব, অখিলেশ যাদবরা নির্বাচন কমিশনের দিকে এগোতে শুরু করলে তাঁদের আটকাতে ব্যারিকেড দিয়ে দেয় পুলিশ। কিন্তু সেই ব্যারিকেডের তোয়াক্কা না করে তার উপরে উঠে পড়েন মহুয়া মৈত্র, অখিলেশ যাদবরা। পদযাত্রা রুখতে বিরোধী সাংসদদের আটক করে তোলা হয় পুলিশের গাড়িতে। সেখানে প্রবল ধস্তাধস্তিতে অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারান কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। অসুস্থ হয়ে পড়েন আরামবাগের সাংসদ মিতালি বাগ। দিল্লি পুলিশের তরফে গ্রেপ্তার করে বাসে তোলা হয় রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, মল্লিকার্জুন খাড়গে-সহ ১০০-র বেশি সাংসদকে। সবাইকে আটক করে সংসদ মার্গ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। দুপুর ৩টে নাগাদ আটক সাংসদদের মুক্তি দেয় দিল্লির পার্লামেন্ট স্ট্রিট থানার পুলিশ। তৃণমূল-সহ বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনস্থ দিল্লি পুলিশ মহিলা সাংসদদের উপর অকথ্যভাবে বলপ্রয়োগ করে, চুল ধরে টানা-হেঁচড়া করে। মহিলা সাংসদদের এইভাবে হেনস্থা করায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। ‘ফ্যাসিস্ট’ বিজেপিকে রুখতে বাংলার শাসকদলের তরফে জোটবদ্ধ হয়ে জোরদার লড়াইয়ের ডাক দেওয়া হয়েছে।
সোমবার সকাল থেকেই উত্তপ্ত ছিল সংসদ চত্ত্বর। সকাল ১১টায় সংসদের দুই কক্ষ লোকসভা এবং রাজ্যসভা অচল করে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল বিরোধী শিবির। বেলা ১১টায় লোকসভা এবং রাজ্যসভার অধিবেশন শুরু হওয়ার পরেই এসআইআর-এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন বিরোধী সাংসদরা। বিক্ষোভের জেরে সংসদের দুই কক্ষেই দুপুর দুটো পর্যন্ত অধিবেশন মুলতুবি করে দেওয়া হয়। এরপরই মকর দ্বারের সামনে জড়ো হন বিভিন্ন বিরোধী দলের প্রায় ৩০০ সাংসদ। সেখান থেকেই তাঁরা মিছিল করে নির্বাচন কমিশনের সদর দপ্তর নির্বাচন সদন পর্যন্ত যাবেন স্থির হয়। তবে দিল্লি পুলিশ প্রায় ৩০০জন সাংসদকে মিছিল করে কমিশন দপ্তর পর্যন্ত যেতে দেওয়ার ছাড়পত্র দেবে কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিলই।
বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ সংসদ ভবন থেকে পদযাত্রা শুরু করেন ইন্ডিয়া জোটের প্রায় ৩০০ সাংসদ। তাঁদের লক্ষ্য ছিল নির্বাচন কমিশনের দপ্তর ঘেরাও। মিছিলের পোস্টারে দেখা যায় বিভিন্ন ভাষায় ‘ভোট চুরি’ বন্ধ করার দাবি তুলে ধরা হয়েছে। কোনও কোনও পোস্টারে রয়েছে এসআইআর-এর বিরুদ্ধে স্লোগান। তৃণমূল সাংসদদের হাতে থাকা ব্যানার এবং পোস্টারে নির্বাচন কমিশনকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়, ‘চুপি চুপি ভোটের কারচুপি’। এই আবহে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে অনুমান করে কমিশনের তরফে বিরোধী শিবিরকে চিঠি পাঠিয়ে জানানো হয়, বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসতে কমিশন প্রস্তুত। বলা হয় ৩০জন প্রতিনিধির নাম পাঠাতে, সময় দেওয়া হয় দুপুর ১২টা।
এদিকে দিল্লি পুলিশের তরফে বিরোধী সাংসদদের এই মিছিলের অনুমতি দেওয়া হয়নি, রবিবারই দিল্লি পুলিশের তরফে একথা জানানো হয়েছিল। যদিও বিরোধী সাংসদদের কর্মসূচির কথা জানার পর রাত থেকেই কড়া নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয় সংলগ্ন এলাকা। সংসদ ভবন থেকে মিছিল বের হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পরই ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে দেয় পুলিশ। তখন ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন সাংসদরা। পুলিশের বাধা পেয়ে রাস্তার ওপরই বসে পড়তে দেখা যায় সাংসদদের। সেখানে ছিলেন লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী, কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। চেয়ারে বসেছিলেন প্রবীণ সাংসদ শরদ পাওয়ার, মল্লিকার্জুন খড়্গেরা। এই প্রতিবাদ পদযাত্রাকে সংবিধান বাঁচানোর লড়াই, বলে উল্লেখ করে স্বচ্ছ ভোটার তালিকা প্রকাশের দাবি জানাতে থাকেন বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী।
কেরলের তিরুবনন্তপুরমের কংগ্রেস সাংসদ শশী তারুরের ‘বেসুরো’ গলাতেও এদিন ছিল প্রতিবাদের স্বর। এদিনের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে রাহুল গান্ধীর তোলা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলির উত্তর কেন নির্বাচন কমিশন দেবে না, সেই প্রশ্ন তোলেন তারুর। এছাড়াও বর্তমানে ইন্ডিয়া জোটে না থাকলেও এদিনের কর্মসূচিতে সামিল হয় অরবিন্দ কেজরীওয়ালের দল আম আদমি পার্টি।
অবস্থান তুলতে সাংসদদের আটক করা শুরু করে দিল্লি পুলিশ। অন্যদিকে ব্যারিকেডের উপর উঠে পড়েন মহুয়া, সুস্মিতা-সহ তৃণমূলের অন্যান্য সাংসদরা। ব্যারিকেড টপকে চলে যান সপা সাংসদ অখিলেশ যাদব, ভূপেন্দ্র যাদবরা। তাঁদের আবার ব্যারিকেডের ওপারে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। মিছিল থেকে স্লোগান ওঠে ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়, নরেন্দ্র মোদী চোর হ্যায়’। বেশ কিছুক্ষণ বিক্ষোভ কর্মসূচি চলার পর রাহুল, প্রিয়াঙ্কা, মহুয়া-সহ অন্য সাংসদদের আটক করে দিল্লি পুলিশ। সাংসদদের গ্রেপ্তার করে পার্লামেন্ট স্ট্রিট থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
পুলিশ আটক করে বাসে তোলার পরই ধস্তাধস্তিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন মহুয়া মৈত্র। জানা গিয়েছে ধাক্কাধাক্কিতে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। একই পরিস্থিতি হয় আরামবাগের তৃণমূল সাংসদ মিতালি বাগেরও। অসুস্থ হয়ে পড়েন এসপির এক সাংসদ। সাংসদদের অসুস্থতার খবর পেয়ে সেখানে পৌঁছে গিয়ে খোঁজখবর নেন রাহুল। বাস থেকে নেমে এসপির অসুস্থ সাংসদকে তুলে দেন অন্য গাড়িতে।
এই ঘটনায় কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী বলেন, ‘ওরা কথা বলতে চায় না, কারণ ওরা মুখ লুকোতে চাইছে। সত্যিটা গোটা দেশের সামনে চলে এসেছে। আমরা চাই সঠিক ভোটার লিস্ট।’