প্রতি বছর ২ লক্ষেরও বেশি ভারতীয়ের নাগরিকত্ব ত্যাগ

চিরদিনের জন্য নিজের দেশ, নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সহজ নয়। তবু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, সেই কঠিন সিদ্ধান্তই নিচ্ছেন বিপুল সংখ্যক ভারতীয়। গত পাঁচ বছরে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ ভারতীয় নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন। ২০২০ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত ৯ লক্ষেরও বেশি ভারতীয় দেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ২০২২ সাল থেকে প্রতি বছরই ২ লক্ষের বেশি মানুষ নাগরিকত্ব ত্যাগ করছেন।

সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে এক প্রশ্নের লিখিত উত্তরে বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, ২০১১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মোট ২০ লক্ষেরও বেশি ভারতীয় নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন। এই সংখ্যার প্রায় অর্ধেকই ঘটেছে গত পাঁচ বছরে, মূলত কোভিড–১৯ অতিমারির সময় এবং তার পরবর্তী পর্বে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর নাগরিকত্ব ত্যাগের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ২০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৪৫ হাজারের মধ্যে। কিন্তু ২০২২ সাল থেকে সেই সংখ্যা হঠাৎ করেই বেড়ে বছরে ২ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়।

কেন হঠাৎ এত দ্রুত নাগরিকত্ব ত্যাগের হার বেড়ে গেল, তার কোনও নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা বিদেশ মন্ত্রক দেয়নি। লোকসভায় লিখিত উত্তরে মন্ত্রক জানিয়েছে, ‘নাগরিকত্ব ত্যাগের কারণ সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই তাঁদের সিদ্ধান্তের প্রকৃত কারণ জানেন। অনেকেই ব্যক্তিগত সুবিধা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা ভেবে বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন।’ একই সঙ্গে মন্ত্রক স্বীকার করেছে, ‘ভারত জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির যুগে বিশ্বজুড়ে কর্মসংস্থানের সুযোগকে স্বীকৃতি দেয়।’


বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণভাবে উন্নত বেতন, ভালো কর্মসংস্থান বা ব্যবসার সুযোগ পেলে অনেকেই দেশ ছাড়েন। এর ফলে বহু ক্ষেত্রে দেশের সেরা শিক্ষিত ও দক্ষ মানুষের বিদেশে চলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, যাকে ‘মেধা পাচার’ বলা হয়। উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতীতেও, বিশেষ করে সত্তরের দশকে, নাগরিকত্ব ত্যাগের ঊর্ধ্বমুখী হার এই মেধা পাচার সমস্যাকে সামনে এনেছিল।

বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশের মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারতের কর কাঠামো আরও জটিল হয়েছে, পাশাপাশি ভালো মানের কাজের সুযোগও তুলনামূলক ভাবে কমেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দূষণ, হিংসা, অসহিষ্ণুতা এবং জঙ্গি হানার মতো ঘটনাবলি। এই সামগ্রিক পরিবেশের প্রভাব পড়ছে শিক্ষিত ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভারতীয়দের উপর। আরও একটি বড় কারণ হল, ভারত দ্বৈত নাগরিকত্বের অনুমতি দেয় না। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা বা ব্রিটেনের মতো দেশের নাগরিকত্ব পেতে হলে ভারতীয় নাগরিকত্ব ত্যাগ করা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। নিয়ম অনুযায়ী, অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেই একজন ভারতীয় তাঁর দেশের নাগরিকত্ব হারান।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রাক্তন মিডিয়া উপদেষ্টা সঞ্জয় বারু এই প্রবণতাকে ‘সফলদের বিচ্ছেদ’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, মূলত ধনী ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষজনই বেশি করে নাগরিকত্ব ত্যাগ করছেন। বারুর দাবি, ২০১৪ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় ২৩ হাজার ভারতীয় কোটিপতি দেশ ছেড়েছেন। উন্নত বেতন, উন্নত জীবনযাত্রার মান, ভালো শিক্ষা ব্যবস্থা এবং স্থিতিশীল শাসনব্যবস্থাই এর প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।