সোমবার বঙ্কিম ইস্যুতে সরগরম হয়ে রইল দেশের রাজনীতি। লোকসভায় শীতকালীন অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতা জুড়ে রইল বঙ্কিম ও বাংলা। এদিন লোকসভায় বন্দে মাতরমের গুরুত্ব এবং প্রভাবের কথা স্মরণ করান তিনি। আর তা করতে গিয়ে বন্দে মাতরমের স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ‘বঙ্কিমদা’ বলে সম্বোধন করে বসেন প্রধানমন্ত্রী। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামী পুলিনবিহারী দাসকে ভুল করে ‘পুলিনবিকাশ দাস’ এবং মাস্টারদ ‘মাস্টার সূর্য সেন’ বলেন।
এদিন লোকসভায় প্রায় এক ঘণ্টার বক্তৃতা দেন প্রধানমন্ত্রী। আর বক্তৃতা চলাকালীন একাধিক বার বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘বঙ্কিমদা’ বলে সম্বোধন করেন মোদী। বক্তৃতার মাঝেই প্রতিবাদ জানান দমদমের তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। ‘বঙ্কিমদা’ সম্বোধনে আপত্তি জানিয়ে তিনি বলেন, অন্তত ‘বাবু’ বলুন। ভাষণের মাঝেই ভুল শুধরে শেষে ‘বন্দে মাতরম’-এর শ্রষ্ঠাকে ‘বঙ্কিম বাবু’ বলে সম্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী সাংসদদের ধন্যবাদ জানিয়ে ভাষণের মাঝেই ভুল শুধরে শেষে ‘বন্দে মাতরম’-এর শ্রষ্ঠাকে ‘বঙ্কিম বাবু’ বলে সম্বোধন করলেন।
মোদী বলেন, ‘আপনার ভাবনাকে আমি সম্মান করি। বঙ্কিমদা বলা আমার ভুল। ওনাকে ‘বঙ্কিমবাবু’ বলছি।‘ পাশাপাশি সৌগতকে দাদা সম্বোধন করে ধন্যবাদ জানিয়ে খানিক মশকরার সুরে মোদী বলেন, ‘আপনাকেও তো দাদা বলেই সম্বোধন করি।‘ এরপর থেকে পুরো ভাষণে ‘বন্দে মাতরম’-এর রচয়িতাকে বঙ্কিমবাবু বলেই উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
বক্তৃতার ৩০ মিনিটের মাথায় বাঙালি তরুণদের আত্মবলিদানের কথা স্মরণ করিয়ে পুলিনবিহারী দাসের কথা উল্লেখ করেন। তবে পুলিনবিহারী না বলে ‘পুলিনবিকাশ’ শোনা যায়। এখানেই শেষ নয়, সূর্য সেনের বীরত্বের কথা বলতে গিয়ে তাঁকে মাস্টারদার পরিবর্তে ‘মাস্টার’ বলে সম্বোধন করে মোদী। তবে সাংসদ সৌগত রায়ের আপত্তির জেরে ‘দাদা’ সম্বোধন নিয়ে সাবধানি হয়ে প্রধানমন্ত্রী ‘মাস্টারদা’-র ‘দা’ বাদ দিয়েছেন কিনা তা জানা যায়নি।
‘বঙ্কিমদা’ ইস্যুতে সংসদের ভিতরেই সরব হয় তৃণমূল। মোদীর পর বন্দে মাতরম নিয়ে বিতর্কে বক্তৃতা করতে উঠে বারাসতের তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার বলেন, ‘যে ভাবে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে প্রধানমন্ত্রী ‘বঙ্কিমদা’ বললেন, তাতে মনে হল প্রধানমন্ত্রী চায়ের আড্ডায় বসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করছেন। বিষয়টি বাংলা ভালো ভাবে নিচ্ছে না। বাঙালি ভালো ভাবে নিচ্ছে না।‘
সোমবার অধিবেশনের বেশির সময় বন্দে মাতরম এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন মোদী। বন্দে মাতরম নিয়ে নিজের অভিমতের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলার গলি থেকে বেরোনো এই আওয়াজ গোটা দেশের আওয়াজ হয়ে উঠেছিল।‘ বঙ্গভঙ্গের প্রসঙ্গও উত্থাপন করে তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশরা বুঝে গিয়েছিল, ভারতকে টুকরো না-করলে শাসন করা মুশকিল। ওরা ওদের বিভেদ ও শাসননীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছিল বাংলায়, বঙ্গভঙ্গ করে। কারণ ব্রিটিশরা জানত বাংলার বৌদ্ধিক শক্তি দেশকে দিশা, প্রেরণা আর শক্তি জোগাচ্ছে।‘
শীতকালীন অধিবেশনে ‘বন্দে মাতরম’-এর ১৫০ বছর পূর্তি আলোচনাতেও মোদীর নিশানায় জওহরলাল নেহরু এবং কংগ্রেস। ‘বন্দে মাতরম’-এর সম্মানহানির অভিযোগ তুলে মোদী বলেন, কংগ্রেস জাতীয় গান অর্থাৎ ন্যাশনাল সং-কে ‘টুকরে টুকরে’ করেছে। সোমবার নিজের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জওহরলাল নেহরুর দাবি ছিল যে বন্দে মাতরম মুসলমানদের প্ররোচনা দিতে পারে।’
সোমবার ‘বন্দে মাতরম’ নিয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তুষ্টীকরণের রাজনীতির অভিযোগ এনেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর দাবি, নেহরু জিন্নার মুসলিম লিগের সামনে মাথা নত করে বন্দে মাতরমের বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জিন্নাহর বন্দে মাতরমের বিরোধিতার পর পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু সুভাষ চন্দ্র বসুকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন, তিনি বন্দে মাতরমের পটভূমি পড়েছেন এবং ভেবেছিলেন এটি মুসলমানদের উত্তেজিত করতে পারে। বাংলায় প্রথম বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দে মাতরম স্লোগান ব্যবহার করে তার প্রতিক্রিয়া দেখতে চেয়েছিলেন।’
এখানেই শেষ নয়, কংগ্রেস বন্দে মাতরমের গুরুত্বপূর্ণ স্তবক বাদ দিয়েছিলেন বলে আগেই দাবি করেছিল বিজেপি। এ দিন সেই কথার পুনরাবৃত্তি শোনা গেল প্রধানমন্ত্রীর গলায়। বন্দে মাতরমের বাদ পড়া অংশ পড়েও শোনান। তাঁর অভিযোগ,‘কংগ্রেস এখনও বন্দে মাতরমকে অপমান করছে। তাঁরা প্রথমে বন্দে মাতরমকে টুকরো টুকরো করেছে। তার পরেই ভারতকে ভেঙেছে।’
শুধু নেহেরু নয়, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকেও আক্রমণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি বলেন,‘বন্দে মাতরম বহু প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও অনুপ্রাণিত করবে। বন্দে মাতরমের গৌরব হানি করেছে কংগ্রেস। যখন বন্দে মাতরম ৫০ বছর পূর্ণ করে, তখন ভারত ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। যখন বন্দে মাতরম ১০০ বছর পূর্ণ করে, তখন ভারত জরুরি অবস্থার কবলে ছিল। সেই সময়ে দেশপ্রেমিকদের জেলে ভরা হয়েছিল। সংবিধানকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছিল। বন্দে মাতরমের ১৫০ বছরে সেই গর্ব ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করতে হবে আমাদের।’
এদিকে লোকসভায় বন্দে মাতরম নিয়ে আলোচনা শুরু আগে বার্তা দেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কোচবিহার যাওয়ার আগে দমদম বিমানবন্দর থেকে তিনি বলেন, ‘হোক আলোচনা, আমাদের কোনও আপত্তি নেই। এটা জেনে রাখা দরকার, বন্দে মাতরম পুরো গানটা নয়, শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্বাচন করে দেওয়া অংশই এখন আমাদের জাতীয় স্তোত্র। সেটা নিয়েই আমরা আলোচনা করব। বিজেপি অনেক কিছু জানে না। এটা আমি জানি, তাই বললাম।‘
বাংলার যত এগিয়ে আসছে ততই সরগরম হয়ে উঠছে রাজ্য রাজনীতি থেকে দেশের রাজনীতি। লোকসভায় আলোচনার বেশির ভাগ অংশ জুড়ে থাকছে বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। তাই লোকসভার শীতকালীন অধিবেশনে বাংলার বিপ্লবীদের নিয়ে মোদীর তর্পন যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল।