পহেলগাম কাণ্ডে পাকিস্তানের উপরে ভারতের একগুচ্ছ নিষেধাজ্ঞা। জবাবে ইসলামাবাদও পাল্টা একাধিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। দুই দেশের সীমান্তেই বিপুল সেনা মোতায়েন ও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা শুরু হয়েছে। চলছে অঘোষিত যুদ্ধের প্রস্তুতি।
পহেলগামে পর্যটকদের ওপর নারকীয় জঙ্গি হামলার ঘটনায় ফের কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘনিয়ে আসতে চলেছে? ঘটনার পর পরই ভারত সরকার জরুরি ভিত্তিতে একাধিক নজিরবিহীন পদক্ষেপ শুরু নিতেই সেই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পাল্টা সামরিক প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে পাকিস্তানও। আর এই আবহেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহলে জল্পনা শুরু হয়েছে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আসন্ন! পহেলগাম ঘটনার পর মোদীকে ফোন করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাশে থাকার বার্তা দিতেই সেই সম্ভাবনা যেন আরও জোরালো হয়েছে। আর এই আশঙ্কা থেকে বুধবার সকাল থেকেই ইসলামাবাদও সর্বত্র হাই অ্যালার্ট জারি করেছে। লাহোর এবং করাচি এয়ারবেসে দিনভর চক্কর কেটেছে পাকিস্তান এয়ারফোর্স। বৃহস্পতিবারও সেই তৎপরতায় কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। এদিকে করাচি উপকূলে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা শুরু করে দিয়েছে পাকিস্তান। শুক্রবারও এই পরীক্ষা চলবে বলে সংবাদ সংস্থা সূত্রের খবর।
প্রসঙ্গত বুধবার রাতেই বেনজির ঘোষণা করেছে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক। সেই ঘোষণায় বলা হয়েছে, পাকিস্তানের কেউ ভারতে আসতে পারবেন না। আর যত পাকিস্তানি নাগরিক এখন এদেশে আছেন, তাঁরা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে যাবেন। আর পাকিস্তানে থাকা নাগরিকরা অবিলম্বে ভারতে ফিরবেন। পাকিস্তানের হাইকমিশনে আর্মি, নেভি ও বায়ুসেনার যত সাপোর্ট স্টাফ এবং কনসাল জেনারেল আছেন, সবাইকে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, দোষীদের এবং যে শক্তি তাদেরকে পরিচালনা করছে, তাদের চিহ্নিত করা গিয়েছে। এবার শিক্ষা দেওয়ার পালা। তিনি বলেছেন, ‘অপরাধীরা ছাড় পাবে না। যারা এই ঘৃণ্য কাজ করেছে, শুধু তারা নয়, তাদের পিছনে যে মাথারা যুক্ত রয়েছে, তাদেরও টার্গেট করা হবে।’
জানা গিয়েছে, ভারত সরকারের নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি (সিসিএস)-র পক্ষ থেকে সমস্ত সরকারি প্রতিবন্ধকতাকে দূরে সরিয়ে তিন বাহিনী আর্মি, এয়ারফোর্স, নেভিকে সম্পূর্ণ ছাড় দেওয়া হয়েছে। এই তিন বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, ‘এই নিরীহ মানুষের রক্ত ব্যর্থ হবে না। গোটা দুনিয়া দেখবে, ভারতের জবাব কী হতে চলেছে।’
বুধবার মাঝরাতেই নয়াদিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স সাদ আহমেদ ওয়ারাইশকে ডেকে পাঠায় ভারতের বিদেশ মন্ত্রক। আর আজ, বৃহস্পতিবার ডাকা হয়েছে সর্ব দলীয় বৈঠক। নিতান্ত যুদ্ধ পরিস্থিতি ছাড়া এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করে না সরকার। এখানেই শেষ নয়, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে আটারি সীমান্ত। বাতিল করা হয়েছে সিন্ধু জলবন্টন চুক্তিও। বৃহস্পতিবার সকালে পাকিস্তানের সরকারি এক্স অ্যাকাউন্টটিও ভারতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
বুধবার ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তের পর বৃহস্পতিবার সকালে পাক বিদেশমন্ত্রী ভারতের এই পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, ‘এমন অকিঞ্চিৎকর বিষয় নিয়ে পাকিস্তান চিন্তিত নয়।’ পাক উপপ্রধানমন্ত্রী মহম্মদ ইশার দার এদিন বলেন, ‘ভারতের প্রতিটি পদক্ষেপের কড়া এবং উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে।’ এদিন বিকেলে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক শেষে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে ইসলামাবাদে ভারতীয় দূতাবাসে থাকা প্রতিরক্ষা আধিকারিকদের পাকিস্তান ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে শাহবাজ প্রশাসন। দূতাবাসে কূটনীতিকের সংখ্যাও ৩০-এ নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। পাক বিদেশমন্ত্রক বৃহস্পতিবার সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তি স্থগিত রাখা এবং সীমান্তের ট্রানজ়িট পয়েন্ট বন্ধের সিদ্ধান্তকে ‘গুরুতর উস্কানি’ বলে দাবি করেছে। কোনও প্রমাণ ছাড়াই ভারত একতরফাভাবে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে বলেও অভিযোগ পাক বিদেশমন্ত্রকের। ইসলামাবাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘দ্রুত এর জবাব দেওয়া হবে।’
বৃহস্পতিবার ইসলামাবাদে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চলা জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক শেষ হতেই বিকেলে বিবৃতি প্রকাশ করেছে শাহবাজ় শরিফের সরকার। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘জল বন্ধ হলে তা যুদ্ধ হিসাবে দেখা হবে’! এর পাল্টা হিসেবে শিমলা চুক্তি-সহ ভারতের সঙ্গে সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও স্থগিত রাখা হতে পারে বলে জানিয়েছে পাকিস্তান। একই সঙ্গে ইসলামাবাদ ভারতের সঙ্গে সমস্ত বাণিজ্য বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, নিজেদের আকাশসীমাও ভারতকে আর ব্যবহার করতে দেবে না তারা। প্রতিটি ভারতীয় উড়ান সংস্থার জন্য এই নিয়ম কার্যকর থাকবে বলে জানিয়েছে পাকিস্তান সরকার।
এদিকে ভারত সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করতেই কার্যত চিন্তায় পড়েছে পাকিস্তান। সিন্ধুচুক্তি স্থগিত হওয়ার ধাক্কায় জলপ্রবাহ বাধা পেলে কী পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, সেই নিয়ে উদ্বেগ দানা বেঁধেছে ইসলামাবাদে। ভারতের সিদ্ধান্তকে ‘জল-যুদ্ধ’ হিসাবে দেখতে শুরু করেছে পাক সরকার। ভারতের এই পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানিয়ে ইসলামাবাদের পাল্টা দাবি, সিন্ধুর প্রতিটি জলবিন্দুতে তাদের ‘অধিকার’ রয়েছে! সে দেশের বিদ্যুৎমন্ত্রী আওয়াইস লেখরি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফের বিদেশ উপদেষ্টা সরতাজ আজ়িজ় সমাজমাধ্যমে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাঁদের দাবি, সিন্ধু জলচুক্তি প্রত্যাহার হলে তা ‘যুদ্ধের পদক্ষেপ’ বা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘শত্রুতামূলক পদক্ষেপ’ হিসাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
প্রসঙ্গত গত ২২ এপ্রিল মঙ্গলবার পহেলগামে জঙ্গি হামলা হতেই সৌদি সফর বাতিল করে জরুরি ভিত্তিতে বুধবার ভারতে ফিরে আসেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দিল্লি বিমানবন্দরে নেমেই প্রধানমন্ত্রীর জন্য এসপিজির সিকিওরিটির দাঁড় করানো বিএমডব্লু সেভেন সিরিজের গাড়িতে না উঠে মোদী সোজা হেঁটে চলে যান এয়ারপোর্টের হাই সিকিওরিটি ভিআইপি লাউঞ্জে। সেখানে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল এবং বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকে পহেলগামের সামগ্রিক পরিস্থিতির খবর নেন। এরপর তাঁর বাসভবনে ফিরে দফায় দফায় বৈঠক শুরু হয়। সেই বৈঠকে ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল সহ তিন সেনা প্রধান। এরপরই বিকেলে ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিওরিটি (সিসিএস) আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, ভারত জবাব দেবে। ভারত সরকারের স্পষ্ট সিদ্ধান্ত, এই ঘটনায় জড়িত কাউকে রেয়াত করা হবে না। যে কোনও সময়ে পাল্টা হামলা হবে। আর সেটা শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।
বুধবার সন্ধ্যায় দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ৭ লোককল্যাণ মার্গের সরকারি বাসভবনে বৈঠকে বসেছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি (সিসিএস)। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে চলে সেই বৈঠক। বৈঠক শেষে রাত ৯টা নাগাদ সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী। তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাঁচটি পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেন। তিনি জানান, যত দিন না পাকিস্তান আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস বন্ধে এগিয়ে না আসছে, তত দিন সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তি স্থগিত রাখা হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নয়াদিল্লি। পাশাপাশি, অটারী-ওয়াঘা সীমান্তে চলাচল বন্ধ করা হচ্ছে। উপযুক্ত নথিপত্র নিয়ে যাঁরা এই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছেন, তাঁদের ১ মে-র মধ্যে পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভারত জানায়, ‘সার্ক ভিসা অব্যাহতি প্রকল্প’-এর (এসভিইএস) অধীনে কোনও পাকিস্তানি নাগরিককে আর ভারতে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। অতীতে এই ভিসায় প্রবেশের জন্য পাকিস্তানিদের যত অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তা বাতিল করা হচ্ছে। ওই ভিসা প্রকল্পের অধীনে যে সমস্ত পাকিস্তানি এখন ভারতে আছেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের দেশ ছাড়তে হবে বলেও জানান মিস্রী। এর পাশাপাশি পাকিস্তানের সামরিক উপদেষ্টাদের ‘অবাঞ্ছিত’ (পার্সোনা নন গ্রাটা) ঘোষণা করার পাশাপাশি সে দেশের ভারতীয় দূতাবাসের সদস্যসংখ্যা ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ইতিমধ্যে মঙ্গলবার রাত থেকে পহেলগামের ১০০ কিমি ব্যাসার্ধে জঙ্গি বিরোধী অভিযান শুরু করে দিয়েছে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলিকে খালি করে দেওয়া হচ্ছে। হাসিমারা, আম্বালা এবং বারমেরে মোতায়েন রয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির রাফাল যুদ্ধ বিমান। যে কোনও সময় সীমান্তে ফরওয়ার্ড মুভমেন্ট শুরু করে দেবে আর্মি নর্দান কমান্ড। এরপর শুধু কাঁটাতার পেরিয়ে আঘাতের পালা। পাকিস্তানকে কড়া জবাব দেওয়া হতে পারে। কিন্তু এবারের জবাবটা ঠিক কীভাবে দেওয়া হবে? তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানান জল্পনা শুরু হয়েছে। সীমান্ত পেরিয়ে আঘাত হানার কোনও হট প্যারাস্যুট, নাকি বালাকোটের স্টাইলে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক? সবার মনে নানারকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
এদিকে পহেলগাঁওকাণ্ডের আবহে পাকসেনার হাতে আটক বিএসএফ জওয়ান! সেনা সূত্রে জানা গিয়েছে, ঘটনাটি বুধবার ঘটেছে। ফিরোজপুর সেক্টরের আন্তর্জাতিক সীমান্তে কর্মরত ছিলেন পিকে সিংহ। ভুল করে পঞ্জাবের ফিরোজপুর সেক্টরের সীমান্ত পেরিয়ে গিয়েছিলেন ওই জওয়ান। আটক হওয়া জওয়ানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পাকসেনার সঙ্গে ফ্ল্যাগ মিটিংয়ে বসেছে ভারতীয় সেনা। দু’পক্ষের মধ্যে কথাবার্তা চলছে। তবে সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, ওই জওয়ানকে এখনও দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। যদিও সেনা সূত্রের দাবি, জওয়ানদের ভুল করে সীমান্ত পেরনোর মতো ঘটনা নতুন কিছু নয়। এ ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হয়।