দেশে ফেরার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেই জল্পনা ও আলোচনা নতুন করে তীব্র হচ্ছে বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও দূরদর্শী মন্তব্য করলেন প্রাক্তন ভারতীয় কূটনীতিক বীণা শিখরি। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, ‘তারেক রহমান দেশের তৃণমূল স্তরীয় রাজনীতির সঙ্গে আদৌ যুক্ত নন। দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার ফলে বাংলাদেশের বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ সংযোগ নেই।’
বীণা শিখরির এই মন্তব্য শুধু কূটনৈতিক মহলেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যেও নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে এমন এক সময়ে এই মন্তব্য করলেন, যখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা, নির্বাচন, ক্ষমতার রদবদল এবং বিরোধী রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা জল্পনা চলছে।
প্রসঙ্গত, তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তন ঘিরে বিতর্ক ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে একাধিক মামলার রায় রয়েছে এবং সেই কারণেই তাঁর দেশে ফেরা নিয়ে আইনি ও রাজনৈতিক দুই স্তরেই প্রশ্ন রয়েছে। তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক কালে বিএনপি’র অন্দরমহলে তাঁর প্রত্যাবর্তন এবং সক্রিয় নেতৃত্বে ফেরার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে বিচক্ষণ প্রাক্তন ভারতীয় কূটনীতিক বীণা শিখরির মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তিনি মনে করেন, ‘কোনও দেশের রাজনীতিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হলে সেই দেশের তৃণমূল স্তরের মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ থাকা জরুরি। মাঠের বাস্তবতা না বুঝে শুধু প্রবাস থেকে নির্দেশ দিলে তা দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিকভাবে ফলপ্রসূ হয় না।’
বীণা শিখরি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষক। ঢাকায় ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত হিসেবে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তন খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাঁর মতে, বাংলাদেশের রাজনীতির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো— এখানে তৃণমূল স্তরের সংগঠন, কর্মীদের ভূমিকা এবং স্থানীয় বাস্তবতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নিয়মিতভাবে মাঠে থাকতে হয়। মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা, সামাজিক টানাপোড়েন, অর্থনৈতিক চাপ— এই সব কিছু সরাসরি না দেখলে রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা গড়ে তোলা খুবই কঠিন।’ ফলে এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি মূলত ইঙ্গিত দিয়েছেন, দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় নেতৃত্ব দেওয়া বাস্তবে সহজ নয়।
তারেক রহমান বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পুত্র এবং দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উত্তরাধিকারী হিসেবে পরিচিত। তবে তাঁর রাজনৈতিক যাত্রাপথ সবসময়ই বিতর্কে ঘেরা। দুর্নীতি মামলা, সহিংস রাজনীতির অভিযোগ এবং বিদেশে দীর্ঘ নির্বাসন— এই সব মিলিয়ে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
বীণা শিখরির বক্তব্য সেই প্রশ্নগুলিকেই নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি’র ভেতরেও এখন দুটি ধারা স্পষ্ট। একটি ধারা তারেক রহমানের নেতৃত্বে ফেরার পক্ষে, অন্যটি মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার কথা বলছে।
যদিও বীণা শিখরি বর্তমানে কোনও সরকারি পদে নেই, তবু তাঁর বক্তব্যকে ভারতীয় কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন হিসেবেই দেখছেন অনেকে। ভারতের কাছে বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা, ধারাবাহিক সরকার এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই একজন প্রাক্তন কূটনীতিক হিসেবে বীণা শিখরি ইঙ্গিত দিয়েছেন, নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সংযোগ না থাকলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার উপরও তার প্রভাব পড়তে পারে। তাঁর মতে, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি শুধু অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, এর প্রভাব পুরো দক্ষিণ এশিয়ার উপর পড়ে।’
প্রসঙ্গত, তারেক রহমানের রাজনীতি মূলত প্রবাসী কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে— এই অভিযোগ নতুন নয়। অনলাইন বক্তব্য, ভিডিও বার্তা এবং প্রবাসী কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি দলের কর্মীদের উদ্দেশে বার্তা দেন। কিন্তু বীণা শিখরির মতে, এই ধরনের নেতৃত্ব বাংলাদেশের মতো দেশে দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক প্রভাব তৈরি করতে পারে না।
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘দেশের মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ না থাকলে, রাজনৈতিক আন্দোলনের ভাষা ক্রমশ বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।’ এই মন্তব্য কার্যত বিএনপি’র ভবিষ্যৎ কৌশল নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিল। তারেক রহমান সত্যিই যদি রাজনীতিতে ফেরেন, তবে তাঁকে একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। আইনি লড়াই, রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা এবং দলীয় সংগঠন পুনর্গঠন তার মধ্যে অন্যতম। বীণা শিখরির মন্তব্য সেই চ্যালেঞ্জগুলিকেই আরও স্পষ্ট করে দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো— বিরোধী রাজনীতি কতটা কার্যকরভাবে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবে। সেই লড়াইয়ে কেবল নাম বা উত্তরাধিকার যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন মাঠে থেকে মানুষের সঙ্গে রাজনীতি করা। দেশে ফেরার পর তারেক রহমানের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা সময়ই বলবে। তবে বীণা শিখরির মন্তব্য বাংলাদেশের রাজনীতির এই সন্ধিক্ষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে— নেতৃত্ব কি কেবল নামের জোরে চলে, নাকি মানুষের সঙ্গে মাটিতে পা রেখে রাজনীতি করাই শেষ কথা?
সুতরাং, প্রাক্তন ভারতীয় কূটনীতিক বীণা শিখরির মন্তব্য তাই শুধু একটি ব্যক্তিগত মতামত নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান বাস্তবতার একটি কঠোর বিশ্লেষণ। তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট করে দেয়, দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থেকে তৃণমূল রাজনীতির সঙ্গে সংযোগহীন অবস্থায় কোনও নেতার পক্ষে কার্যকর ভূমিকা রাখা অত্যন্ত কঠিন।