প্রয়াত প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ জেটলি

অরুণ জেটলি (File Photo: IANS)

শারীরিক অসুস্থতার জন্য লােকসভা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। ঘরবন্দি থেকেও সােশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় ছিলেন। সরকারের সব প্রকল্প নিয়ে সওয়াল করতেন নিয়মিত। টুইটারের মাধ্যমে বিরােধীদের আক্রমণের প্রতি আক্রমণ শানিয়েছেন। বিজেপির এই লড়াকু নেতার চলার পথ থেমে গেল মাত্র ৬৬ বছর বয়সে। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ জেটলি । কয়েকদিন ধরে ক্রমাগত অবনতি হচ্ছিল শারীরিক অবস্থা। শনিবার দুপুর ১২টা ৭ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন জেটলি।

তাঁর মৃত্যুতে শােকের ছায়া নেমে এসেছে দলের অন্দরে। বিরােধী দলের নেতৃত্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় অরুণ জেটলি মৃত্যুতে শােকস্তব্ধ বিরােধী রাজনীতিকরাও। এই মুহূর্তে বিদেশে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদি। টুইটে শােকবার্তায় তিনি জানিয়েছেন, ‘অরুণ জেটলির প্রয়াণে একজন বন্ধুকে হারালাম। ওঁকে জানার সৌভাগ্য হয়েছিল। ওর মতাে রাজনৈতিক দুরদর্শিতা এবং উপলব্ধি খুব কম জনের আছে। অনেক সুখস্মৃতি রেখে গেলেন। আমরা ওঁর অভাব অনুভব করব। দেশের জন্য ওনার অবদান সুদুরপ্রসারী। ওনার চলে যাওয়াটা খুবই দুঃখজনক’। 

শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে ৯ আগস্ট দিল্লির এইমস হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন অরুণ জেটলি। অবস্থার অবনতি হওয়ায় ১৭ আগস্ট থেকে তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। জেটলিকে সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণে রাখছিলেন চিকিৎসকরা। শুক্রবার অবস্থার আরও অবনতি হয়। হাসপাতাল সুত্রে জানা যায় অরুণ জেটলির শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে এগােচ্ছে। জেটলিকে হাসপাতালে দেখতে আসেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন, লােকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লা, প্রবীণ বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি সহ একাধিক শীর্ষ নেতা। তাছাড়া রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি, কংগ্রেসের অভিষেক মনু সিংভি, জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া।


প্রয়াত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর মরদেহ এইমস হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সেখানে দলের সর্বস্তরের নেতারা উপস্থিত হন। প্রিয় নেতাকে শেষবার দেখার জন্য কর্মী, সমর্থকদের ভিড় উপচে পড়ে। বিজেপির সদর দফতরে জেটলির মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় শেষ শ্রদ্ধা জানাবার জন্য। রবিবার দুপুরে দিল্লির নিগমবােধ ঘাটে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে।

দীর্ঘদিন ধরেই ডায়াবেটিস সমস্যায় ভুগছিলেন একদা কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রী অরুণ জেটলি। গত বছর অর্থমন্ত্রী থাকাকালীনই কিডনি প্রতিস্থাপন হয় জেটলির। শারীরিক অসুস্থতার জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসে। অন্তর্বর্তী বাজেট সংসদে পেশ করতে পারেননি তিনি। গত মে মাসেও অসুস্থ হয়ে এইমসে ভর্তি হন। তারপর থেকেই আস্তে আস্তে সরে আসছিলেন রাজনীতির মূল স্রোত থেকে।

দ্বিতীয়বার মােদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রীত্ব থেকে সরে আসার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদিকে আবেদন জানান। তবে নিজেকে দল থেকে সরিয়ে রাখেননি। তাঁর মৃত্যুতে বিজেপির অভাবনীয় ক্ষতি হল বলে মনে করছেন দলের সদস্যরা। ভারতীয় রাজনীতির অতি জনপ্রিয় মুখ তথা বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি প্রয়াত হলেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বেশ কয়েকমাস তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছিলেন।

বিজেপি তাে বটে, প্রধানমন্ত্রী মােদিও যখন কোনও সমস্যায় পড়েছে, তখন ত্রাতা হিসেবে জেটলিকে সব সময় পাশে পেয়েছেন। দলীয় রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা একজন জাত রাজনীতিক হিসেবে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। রাজনীতিতে তাঁর পান্ডিত্য সমালােচকদের মধ্যে হিংসার উদ্রেক করে। মােদি-জেটলি সখ্যতা, পারস্পরিক নির্ভরতা ও বিশ্বাসযােগ্যতা সমীকরণের শুরুটা ১৯৯০ সালের শেষভাগ থেকে– রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙেঘর প্রচারক মােদিকে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিয়ােগ করা হয়েছিল। তখন মােদি জেটলির ৯, অশােকা রােডে সরকারি বাংলাের একটা অংশে থাকতেন।

২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গার পরবর্তী প্রেক্ষাপটে মােদি ও অমিত শাহকেও আইনি জটিলতা থেকে মুক্ত করতে দৌড়ে গেছেন অটলবিহারী বাজপেয়ীর পছন্দের পাত্র জেটলি। ভারতীয় জনতা পার্টির আপদে-বিপদের কান্ডারি অরুণ জেটলি আজ ইতিহাস– দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকার পর এইমসে শনিবার দুপুর বারােটা সাত মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। স্পষ্টবাদী, সুকৌশলী জেটলি দলের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী মােদিরও সময়- অসময়ের ত্রাতা ছিলেন।

কিন্তু শারীরিক সমস্যা তাঁকে প্রতিনিয়ত সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে দাড়াতে বাধ্য করেছে, একটা সময় ভারতীয় রাজনীতির উজ্জ্বলতম ব্যক্তিত্ব অরুণ জেটলি তাঁর চার দশকের রাজনৈতিক কেরিয়ারে দাড়ি টানতে বাধ্য হয়েছিলেন। লােকসভা ভােটে বিরােধীদের ধরাশায়ী করে প্রধানমন্ত্রী মােদি ফের দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন, কিন্তু সেই মন্ত্রিসভায় জেটলিকে দেখা যায়নি, কারণ অসুস্থতা, শারীরিক দুর্বলতা। ঐক্যমত নির্মাণের কারিগর জেটলিকে প্রধানমন্ত্রী মােদির মন্ত্রিসভার আসল চাণক্য হিসেবে পরিগণিত করা হয়ে থাকে। 

গুজরাত দাঙ্গা পরবর্তীতে যখন সমস্ত দায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদির ঘাড়ে চাপাতে বিরােধীরা সােচ্চার হয়েছিল, তখন কালাে মেঘের চাদরের আড়াল থেকে মােদিকে বের করে এনেছিলেন জেটলি। শুধু মােদি নন, মুশকিল আসান হিসেবে জেটলিকে অমিত শাহও পাশে পেয়েছিলেন। তাঁকে জামিন পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে জেটলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সেই সময় প্রায়ই অমিত শাহকে জেটলির কৈলাশ কলােনির অফিসে দেখতে পাওয়া যেত। দু’জনে প্রায়ই বলতে গেলে তখন সপ্তাহের মধ্যে বেশিরভাগ দিনই একসঙ্গে মধ্যাহ্নভােজ করতেন।

২০১৪ সালে ভােটে সময় নরেন্দ্র মােদিকে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে ঘােষণা করার পর শিবরাজ সিং চৌহান, রাজনাথ সিং ও নিতিন গড়কড়িকে সামনে এগিয়ে রাখার কারণে জেটলি বিচক্ষনতার সঙ্গে নেপথ্যে থেকে কাজ চালিয়ে গেছেন। পেশায় আইনজীবী জেটলি, বাজপেয়ী প্রশাসনের মন্ত্রী ছিলেন। মােদি যখন ক্ষমতায় এলেন তখন দেশের অর্থমন্ত্রকের দায়িত্বে জেটলিকে ছাড়া অন্য কারুর কথা তিনি ভাবতে পারেননি।

অরুণ সৌরি ও সুব্রহ্মণ্যম স্বামীকে বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মােদি দেশের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব জেটলির হাতে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনােহর পারিক্কর যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তখন দেশের আরও এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের অতিরিক্ত দায়িত্ব জেটলির হাতে তুলে দিয়েও প্রধানমন্ত্রী হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। তিনি জানতেন অরুণ জেটলি দক্ষ হাতে দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলাতে পারবেন।

১৯৯০ সালের শেষভাগ থেকে জেটলি মােদির পাশে ছায়ার মতাে থেকেছেন। গুজরাত দাঙ্গায় মােদির বিরুদ্ধে ওঠা মামলাগুলােকে তিনি আইনি পথে সামলে ছিলেন। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল মােদি জমানার প্রথম অধ্যায়ে সর্বময় কর্তা হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছেন। তা সে মােদি সরকারের দফায় দফায় সাফল্যের পরিসংখ্যান দেওয়া থেকে শুরু করে বিতর্কিত নীতির পক্ষে সমর্থন জানানাে হােক বা কংগ্রেসকে তুলােধােনা করা হােক সবেতেই সামনের সারিতে জেটলির উজ্জ্বল উপস্থিতি দেশবাসী দেখেছে। পাশাপাশি দেশে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জেটলি আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি যে নেপথ্যে কারণ তা দেশবাসীকে বুঝিয়েছেন।

রাফায়েল চুক্তির জটিল ধাপগুলােকে সহজ সরল ভাষায় বুঝিয়ে বলা ও সংসদে জিএসটির প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর জুরি মেলা ভার। তিন তালাক বিল নিয়ে জেটলিই মােদি প্রশাসনের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। 

রাজনীতির পাশাপাশি তাঁর পছন্দের তালিকায় দামি পেন, ঘড়ি ও গাড়ি রয়েছে। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে অসংখ্য দামি পেন, হাত ঘড়ি ও গাড়ির সম্ভার রয়েছে। অমৃতসরের ছোলে কুলচা তাঁর প্রিয় খাবারগুলাের মধ্যে অন্যতম ছিল। মােদি শাসনের প্রথম জমানায় মধ্যভাগ থেকে শারীরিক সমস্যার কারণে চিকিৎসার জন্য বারবার আমেরিকা যাওয়ার কারণে তিনি মােদি শাসনের প্রথম অধ্যায়ের ষষ্ঠতম ও শেষ বাজেট পেশ করার সুযােগ পাননি।

রাজনীতিক দুনিয়ায় তাঁর বন্ধুর সংখ্যা কম ছিল না। তিনি নির্মলা সীতারমন, পীযুষ গােয়েল, ধর্মেন্দ্র প্রধান সহ একাধিক নেতার আইনি। পরামর্শদাতা ছিলেন। এছাড়াও সব রাজনৈতিক দলের মুখপাত্ররা তাঁর অফিসে পরামর্শ নিতে ভিড় জমাতেন। পরিবেশ মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর তাঁকে ‘সুকৌশলী’ বলে সম্বােধন করেছিলেন। মােদি তাঁকে অমৃতসরে নির্বাচনী জনসভায় ‘বহুমূল্যবান হিরে’ বলে সম্বােধন করেছিলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে জেটলির সম্পর্ক ছিল বেশ খােলাখুলি।

গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই পাটেলকে উৎখাত করে মােদিকে মুখ্যমন্ত্রী করার নেপথ্যে যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল, তাতে জেটলিও ছিলেন বলে রাজনৈতির মহলের বিশ্বাস। সফল আইনজীবীর সন্তান অরুণ জেটলি দেশভাগের পর লাহাের থেকে ভারতে আসেন। আইন নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। ইন্দিরা গান্ধি জরুরি অবস্থা জারি করার সময় জেটলি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। জরুরি অবস্থা চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করার জন্য তাঁকে ১৯ মাস জেলে থাকতে হয়েছিল। জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর তিনি আইন প্র্যাকটিস শুরু করেন।

১৯৮০ সালে, দিল্লির উপশাসক জগমােহন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস অফিস ভেঙে দেওয়ার পদক্ষেপ নিলে জেটলি উপশাসকের পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। ওই সময় তিনি রামনাথ গােয়েঙ্কা, ফলি নরিম্যান, অরুণ সৌরির ঘনিষ্ট হয়েছিলেন। সৌরি ও নরিম্যানের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ভি পি সিং’র নজরে পড়েছিলেন। ভি পি সিং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দেশের কনিষ্ঠতম অতিরিক্ত সলিসটির জেনারেল হিসেবে জেটলিকে নিয়ােগ করেছিলেন।

১৯৯৯ সালে এনডিএ প্রথমবার ক্ষমতায় এলে বাজপেয়ি তাঁকে মন্ত্রী করেছিলেন। তিনি আইন, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক, জাহাজ, শিল্প, বিলগ্নিকরণ মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলেছিলেন। ২০০৬ সালে তিনি রাজ্যসভার বিরােধী দলনেতা হন। তাঁর স্বচ্ছ চিন্তাভাবনা, তাৎক্ষণিক বিবেচনার ক্ষমতার জন্য শাসক দল জেটলির প্রশংসা করেছেন।