সম্বুদ্ধ দত্ত
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ ভারতবাসীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নিল। যার অর্থ দাঁড়াল ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করল। স্বাধীনতা অর্জন করল একথা বলা বোধ হয় প্রকৃত অর্থে সমীচীন হবে না। তবুও ভারত স্বাধীন হল।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সব থেকে কলঙ্কজনক অধ্যায় হল দেশভাগ। দেশ ভাগের পর স্বাধীনতা প্রাপ্তি হল বটে তার সঙ্গে প্রাপ্তি হল দাঙ্গা এবং নৃশংস গণহত্যা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের উদ্বাস্তু হয়ে দেশান্তরী হওয়া। সুতরাং ভারতবর্ষের স্বাধীনতা, দেশভাগ-দাঙ্গা-গণহত্যা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের উদ্বাস্তু হওয়া যেন একসূত্রে বাঁধা।
দাঙ্গায় হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। কিন্ত একথা বলতে কোন দ্বিধা নেই, মুসলমান ভারত ছেড়ে উদ্বাস্তু জীবন বেছে নিয়েছিল আরও উন্নত মুসলমান হয়ে বাঁচার স্বপ্নে । ১৯৪০ সালের মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে বাংলার ফজলুল হক দেশ ভাগের যে দাবি তুলেছিলেন তার মূল কথাই ছিল মুসলমান শুধু ধর্ম বিশ্বাসেই হিন্দুদের থেকে আলাদা নয় তাদের পোশাক পরিচ্ছদ ও সংস্কৃতিও আলাদা। অতএব তাঁরা একটি সম্পূর্ণ আলাদা জাতি।
সুতরাং তাঁদের একটা নিজস্ব বাসভূমি চাই। অর্থাৎ ভারত ভাগ করে মুসলমানরা নতুন একটি দেশ চাইল। অন্যদিকে হিন্দু এবং অন্য ধর্মাবলম্বীরা কিন্তুু উদ্বাস্তু হয়েছে দেশভাগের পরিনামের ফসল হিসাবে। শুধু তাই নয়, নেহরু-লিয়াকত আলি চুক্তির পর বর্তমান পশ্চিম বাংলা থেকে দলে দলে যে মুসলমানেরা তাদের স্বপ্নের পবিত্র ভূমি পূর্ব পাকিস্তানে চলে গেছিল তাঁদের সিংহভাগ কিন্তুু আবার ভারতে (পশ্চিমবঙ্গে) ফিরে এসেছে। ভারত সরকারও তাঁদের পূর্ণ মর্যাদায় ফিরিয়ে নিয়েছে। এমনকি তাদের ছেড়ে যাওয়া ঘর, বাড়ি, জায়গা জমি যেগুলো হিন্দু উদ্বাস্তুরা অধিকার করে থাকতে শুরু করেছিল সেই সম্পত্তিও তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সময়ে এই সম্পত্তি পুনরায় মুসলমানদের হাতে তুলে দেওয়ার কাজটা কিন্তুু মোটেও সহজ ছিল না। তবুও উদ্বাস্তু ও পুনর্বাসন দপ্তরের সচিব হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব দক্ষতার সঙ্গে এমন কঠিন কাজ সম্পন্ন করেছিল। অন্যদিকে সর্বশান্ত হয়ে ভারতে আসা অমুসলমান মানুষ কিন্তু দেশত্যাগের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা স্মরণ করে তারা আর তাদের জন্মভূমিতে ফিরে যেতে সাহস পায়নি। সুতরাং সত্যের আলোকে দেখলে মুসলমান উদ্বাস্তুদের সঙ্গে অমুসলমান উদ্বাস্তুদের একটা মৌলিক পার্থক্য আছে।
উদ্বাস্তু নিয়ে আলোচনা সব সময় হিন্দু, মুসলমান ও শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে আবদ্ধ রয়ে গেছে। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একের পর এক ট্রেনকে মাকড়সার মতো আঁকড়ে ধরে হিন্দু ও শিখ উদ্বাস্তুরা ভারতবর্ষে পালিয়ে এসেছে, এ ছবি আমরা সবাই দেখেছি। দেখেছি এবং জেনেছি ভারতবর্ষে এসে তাদের উদ্বাস্তু জীবনের নিদারুণ সংগ্রাম এবং করুণ পরিণতির ছবি।
দেশ ভাগের উপর যেমন রচনা হয়েছে বহু গল্প, তেমনি বহু চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। (বিশেষত পাঞ্জাবে) হিন্দু, মুসলমান এবং শিখ এই তিন সম্প্রদায়ের বাইরেও যে বিশাল সংখ্যক জনজাতির মানুষ পূর্বপাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ থেকে উৎখাত হয়ে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তাঁদের কথা কিন্তু ইতিহাসে অনুচ্চারিত থেকে গেছে। কেউ খোঁজ রাখেনি পূর্ববঙ্গে বসবাসকারী সাঁওতাল, ওঁরাও- বসবাস রাজসাহী, রংপুরের আশেপাশে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে।
গারো-বাংলাদেশের ময়মনসিংহ সংলগ্ন অঞ্চল, খাসি-সিলেট অঞ্চল। রাজবংশী-দিনাজপুর এ ছাড়াও মারমা, চাকমা, হাজং, মনিপুরী, ত্রিপুরী, তঞ্চ্যঙ্গা, মগ, ম্রো, মতো পার্বত্য চট্টোগ্রমে বসবাসকারি আরও অনেক জনজাতির মানুষদের কথা। কেউ মনে রাখেনি এইসব মানুষদের জীবনের করুণ কাহিনী। কিছু মানুষ ধর্মান্তরিত হয়ে এবং কিছু মানুষ অনোন্যপায় হয়ে আজও বাংলাদেশে রয়ে গেলেও বিশাল সংখ্যক মানুষ তাদের ধর্ম এবং সংস্কৃতি বাঁচাতে পূর্ববঙ্গ থেকে কোথায় যে হারিয়ে গেল তা জানার কেউ প্রয়োজন বোধ করেনি। উপজাতি ও জনজাতি মানুষের দল কখনও সঙ্ঘবদ্ধভাবে আবার কখনও বিক্ষিপ্ত ভাবে জল, জঙ্গল, পাহাড়, নদী পেরিয়ে রাতের অন্ধকারে লোকচক্ষুর আড়ালে ভারতে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারতের উত্তর পূর্বের বিভিন্ন রাজ্যে। আশ্রয় নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মণিপুর এবং অরুণাচলের মতো রাজ্যে। শুধু তাই নয় দেশভাগের অস্থির সময় থেকে শুরু করে আজও উপজাতি থেকে অমুসলমান মানুষের স্রোত বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবাহিত হয়ে চলেছে।
উদ্বাস্তু উপজাতিদের সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে প্রথমে চাকমাদের সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে সব থেকে বৃহৎ হল, চাকমা সম্প্রদায়। এরা পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল নিবাসী। ধর্মে বৌদ্ধ চাকমা সম্প্রদায়ের কিছু অংশ যেমন উদ্বাস্তু হয়ে আসামে আশ্রয় নেয় তেমনি অনেক চাকমা পরিবার পাড়ি দেয় ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, মণিপুর এবং অরুণাচল প্রদেশে।
চাকমাদের দেশত্যাগের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক মর্মস্পর্শী ইতিহাস। দেশ ভাগের আগে থেকে একটা কথা সর্বত্র প্রচার হয়েছিল মুসলমান প্রধান অঞ্চল যেমন পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হবে অন্যদিকে অমুসলমান প্রধান অঞ্চল যুক্ত হবে ভারতের সঙ্গে। এই ধারনার উপর ভিত্তি করে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমারা ধরেই নিয়েছিল তাঁদের বাসভূমি ভারতের মধ্যে থাকবে। শুধু তাই নয় ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ ত্রিবর্ণ রঞ্জিত ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে স্বাধীনতার উৎসব পালন পর্যন্ত করেছিল। কিন্তুু বাস্তবে এই অঞ্চল পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হল। সেই সঙ্গে চাকমাদের জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। চাকমাদের ভারতের প্রতি আনুগত্য প্রর্দশন এবং স্বাধীনতার উৎসব পালন ওই অঞ্চলের মুসলমানদের ও পাকিস্তানী প্রশাসনকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। পরিণামে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং তার সঙ্গে কুখ্যাত আনসার বাহিনী যুক্ত হয়ে চাকমাদের উপর নৃশংস অত্যাচার চালায়। প্রান বাঁচাতে দলে দলে চাকমা আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম এবং অরুনাচলে আশ্রয় নেয়।
চাকমারা মোটামুটি তিন পর্যায়ে বাংলাদেশ থেকে উৎখাত হয়েছে। প্রথম- দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে দাঙ্গার হাত থেকে বাঁচতে। দ্বিতীয় – ১৯৬২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাকিস্তান সরকার কাপ্তাই জলাধার তৈরি করে। এই জলাধারের এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জমি ছিল চাকমা ও হাজং আদিবাসীদের অধীনে। কাপ্তাই বাঁধ তৈরির সময় জনজাতির মানুষরা একদিকে যেমন তাঁদের জমির অধিকার হারায়, অন্যদিকে এই জলাধারের জন্য ভয়ঙ্কর বন্যা দেখা দেয়। এই দুই মিলে সেইসময় ১ লক্ষের উপর বিভিন্ন জনজাতির মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাকমা ও হাজং যারা ধর্মে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। ওই সময় বাস্তুচ্যুত মানুষের দল আশ্রয়ের খোঁজে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। তৃতীয়ত – পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ গঠন হলেও চাকমা এবং অন্য জনজাতির মানুষদের ভাগ্য কিন্তু বদলায়নি।
বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে সমতলের বাংলাদেশি মানুষদের বসতি গড়তে শুরু করলে চাকমারা আবার তাঁদের ধর্ম ও অস্তিত্ব বিপন্নতার ভয়ে ভীত হয়ে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাংলাদেশ সরকারও চাকমাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান চালায়। আবার চাকমা ও হাজং জনগোষ্ঠীর মানুষ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসে ভারতে শরণার্থীর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়।
এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফরিদপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ি, রংপুর, বগুড়া, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, নাটোর, হবিগঞ্জ, দিনাজপুর, রাঙামাটি, সিলেট থেকে ক্রমপর্যায়ে চাকমা ও হাজং ছাড়াও খাসিয়া, মনিপুরী,ত্রিপুরা, মুরুং, মগ, কুকি, বম, তনচংগা, পাংখোয়া, রাজবংশী, ওঁরাও, মুন্ডা এবং সাঁওতালদের মতো ছোট বড় বহু উপজাতির মানুষ যাদের ধর্ম— মূলত হিন্দু, বৌদ্ধ্য, খ্রিস্টান এবং প্রকৃতিপূজারী তাঁরা পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলোতে উদ্বাস্তু হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
এখানে একটা কথা বিশেষ ভাবে বলা প্রয়োজন, উপরের উল্লেখ সব রাজ্য পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জনজাতি মানুষদের নাগরিকত্ব প্রদান করলেও হাজং ও চাকমা সহ অন্য জনজাতির মানুষদের অরুণাচল প্রদেশ নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করে।
বৌদ্ধ্য চাকমা এবং হিন্দু হাজংদের নাগরিকত্ব নিয়ে অরুণাচলে আন্দোলন এবং ভূমিপুত্রদের মধ্যে পাল্টা বিরোধিতা দীর্ঘদিন অব্যাহত রয়েছে। কেন্দ্র, রাজ্য এবং আদালতের চক্রব্যূহে নিষ্পেষিত হচ্ছে এই উদ্বাস্তু মানুষগুলোর জীবন ও জীবিকা। বস্তুত এখনও বহু চাকমা ও হাজংরা নাগরিকহীন হয়েই সেখানে বসবাস করছে। সুতরাং দেখা গেল স্বাধীনতা বহু মানুষকে উদ্বাস্তুই শুধু করলো না, রাষ্ট্রহীনও করে দিল।
৭৯তম স্বাধীনতার উৎসব পালনের সময় আজ প্রশ্ন জাগে, কেন স্বাধীনতার এত বছর পরে কিছু মানুষকে নাগরিকহীন এবং রাষ্ট্রহীন হয়ে থাকতে হবে? এই মানুষগুলি তো আদতে ভারতবাসী। তারা তো স্বাধীনতার জন্য দেশভাগ চায়নি। স্বাধীন ভারতবাসীর কাছে এ প্রশ্ন নিশ্চয় গৌরবের নয়।