৭১-এর ভারত–পাক যুদ্ধে আমেরিকার গোপন আলোচনার দলিল প্রকাশ

ফাইল চিত্র

সালটা ১৯৭১। তখন সদ্য শুরু হয়েছে ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ। পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র জনরোষ আছড়ে পড়েছে। আর পশ্চিম দিক থেকে আচমকা বিমান হামলা চালিয়ে সংঘাতকে নতুন মাত্রা দিয়েছে পাক বায়ুসেনা। সেই ঐতিহাসিক ক্ষণে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন এবং তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার হোয়াইট হাউসের গোপন কক্ষে ফোনে আলোচনা চালাচ্ছিলেন উদ্বেগ আর ক্ষোভে ভরা গলায়। মার্কিন প্রশাসনের শীর্ষ স্তরের সেই আলোচনার গোপন তথ্য এবার জনসমক্ষে প্রকাশিত হল। মার্কিন রাষ্ট্রদপ্তরের প্রকাশিত ঐতিহাসিক দলিলে দীর্ঘ ৫৪ বছর আগে এই দুই শীর্ষ নেতার আলোচনায় সেই ক্ষোভ ও দুশ্চিন্তা যেন আজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। এই আলোচনায় লক্ষ্য করা যায় প্রেসিডেন্ট নিক্সন পাকিস্তানের দুরবস্থা দেখে প্রচণ্ড মর্মাহত হন।

গোপন এই দলিল অনুযায়ী, পাকিস্তানের আগ্রাসী আক্রমণের কথা জানাতে গিয়ে কিসিঞ্জার বলেছিলেন যে, পূর্ববাংলায় যুদ্ধ বিপর্যয়ের কারণে পশ্চিম পাকিস্তান মরিয়া হয়ে ভারতকে আক্রমণ করেছে। এই কথা শুনেই নিক্সন তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান এবং বলেন যে ‘পাকিস্তানের অবস্থাটা দেখে মনটাই খারাপ হয়ে যায়। ভারত যদি ওদের আরও চাপে ফেলে, সেটা অসহনীয়।’ তাঁর ক্ষোভের তির গিয়ে লাগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দিকেও। নিক্সন মনে করেছিলেন, আগেই সতর্ক করা সত্ত্বেও ভারত সংঘাত বাড়িয়ে চলেছে।

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পষ্ট হয়, পাকিস্তান বায়ুসেনা ‘চেঙ্গিজ অভিযান’ নামে এগারোটি ভারতীয় বিমান ঘাঁটিতে বোমা ফেলেছে। তবে ভারতীয় বায়ুসেনা আগেই যুদ্ধ পরিস্থিতি আঁচ করে বিমানগুলিকে গোপন ঘাঁটিতে সরিয়ে রেখেছিল। ফলে তেমন ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি। এদিকে এই হামলার পাশাপাশি জম্মু–কাশ্মীর সীমান্তেও পাকিস্তানি সেনা অগ্রসর হয়েছিল। পরিস্থিতির উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে।


এ অবস্থায় ভারতও পাল্টা আঘাত হানতে দেরি করেনি। রাতের আকাশে একের পর এক যুদ্ধবিমান উড়ে গিয়ে পাকিস্তানের চকলালা, মুরিদ, সারগোধা, চন্দর, রিসালেওয়ালা, রফিকি, মাসরুর এবং শোরকোট ঘাঁটিতে ভয়াবহ আঘাত হানে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে দু’দেশের সীমান্তের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে।

দলিলে আরও উঠে এসেছে, কিসিঞ্জার তখন রাষ্ট্রদপ্তরের পরামর্শ মেনে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি তোলার পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, এত বড় যুদ্ধ শুরু হলে নীরব থাকা কোনওভাবেই দায়বদ্ধতার পরিচয় হবে না। নিক্সন জানতে চান, নিরাপত্তা পরিষদে কারা আপত্তি তুলতে পারে। জবাবে কিসিঞ্জার বলেন, ‘ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন।’ ইতিহাস বলে, পরবর্তীতে বহু দেশই নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের অবস্থানের সমর্থন জানিয়েছিল। কারণ তখন পূর্ববাংলায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতন চরমে পৌঁছেছিল এবং মুক্তিবাহিনী ভারতীয় সেনার সঙ্গে একত্রে মুক্তিযুদ্ধে ব্যস্ত ছিল।

সেই গোপন দলিল প্রকাশের পর আরও জানা যায়, যুদ্ধের ঠিক দু’দিন আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং ইন্দিরা গান্ধীর কাছে নিক্সনের বার্তা পৌঁছে দেন। বার্তায় বলা হয়েছিল, ভারত যেন সীমান্তে সেনা সমাবেশ না বাড়ায়। জবাবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, প্রথমে সেনা এগিয়েছে পাকিস্তানই। কেউ তাদের পিছিয়ে যেতে বলেনি, অথচ ভারতকে সতর্ক করা হচ্ছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও জানান, পাকিস্তানের শাসক ইয়াহিয়া খানের তৈরি করা সঙ্কটের দায়ভার ভারত নেবে না। তাঁর সহ্যশক্তি শেষ হয়েছে, মার্কিন কূটনীতিককে এমনটাই স্পষ্ট করে বলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা।

তখন ইন্দিরা গান্ধীর দৃঢ় অবস্থান দেখে মার্কিন রাষ্ট্রদূত রাষ্ট্রদপ্তরে বার্তা পাঠান যে, প্রধানমন্ত্রী কোনওভাবেই ভারতীয় স্বার্থে আপস করতে রাজি নন। ইতিহাস সাক্ষী, পরবর্তী চৌদ্দ দিনের সর্বাত্মক যুদ্ধে ভারত ও মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত শক্তিতে পূর্ববাংলা স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যায়।