বিহার বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর থেকেই রাজনৈতিক মহলে সবচেয়ে বেশি আলোচ্য বিষয় এনডিএ জোটের অভূতপূর্ব সাফল্য। বিজেপি ও জেডিইউ—উভয় দলেরই আসন জয়ের হার এতটাই বেশি যে, তা শুধু রাজনৈতিক জয় নয়, বরং সমগ্র নির্বাচনী প্রক্রিয়া ঘিরে নতুন করে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। বিশেষত বিরোধী শিবিরের বক্তব্য একটাই, এই ফলাফলকে কোনওভাবেই স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রবাহ বলে ব্যাখ্যা করা যায় না। বরং এটির পিছনে গভীর প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক কারণ রয়েছে, যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে বলে বিরোধীদের দাবি।
ফলাফল অনুসারে বিজেপি ১০১টি আসনে লড়াই করে জিতেছে ৮৯টিতে। আবার জেডিইউ একই সংখ্যক আসনে লড়ে ৮৫টি আসনে জয় পেয়েছে। দুই ক্ষেত্রেই সাফল্যের হার এত বেশি যে, বিশেষজ্ঞরা প্রথমেই তুলনা টেনেছেন আগের দশকের নির্বাচনের সঙ্গে। তখনও এনডিএ শক্তিশালী ছিল, কিন্তু কখনও এমন নিখুঁত সাফল্যের হার দেখা যায়নি। ফলে বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, এই নির্বাচনে জনসমর্থনের পাশাপাশি কিছু বিশেষ পরিস্থিতিরও বড় ভূমিকা ছিল, যা নির্বাচনী আচরণকে প্রভাবিত করেছে।
বিরোধীদের দাবি, নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকা পুনর্গঠনের সময়ে এমন কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে, যা স্বাভাবিক নয়। তাদের অভিযোগ, বহু এলাকায় সংখ্যালঘু ও আর্থিকভাবে দুর্বল ভোটারদের নামের হদিশ পাওয়া যায়নি। যদিও সরকারি দপ্তর এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর যে ভাবে বহু কেন্দ্রে বিরোধীরা অপ্রত্যাশিতভাবে পিছিয়ে পড়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
স্বাভাবিকভাবে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও রাজনৈতিক মহলে অসন্তোষ বেড়েছে। বিরোধী দলের নেতারা স্পষ্টই বলছেন যে, কমিশন নির্বাচন শুরুর সময় থেকে ফলাফল ঘোষণার দিন পর্যন্ত কোনও সময়েই তাদের অভিযোগ যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি। তাদের মতে, নির্বাচনের স্বচ্ছতা রক্ষায় কমিশনের নিরপেক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই জায়গাতেই এই নির্বাচনে বড় শূন্যতা দেখা দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই অভূতপূর্ব স্ট্রাইক রেটের পিছনে অবশ্য শুধুই বিতর্ক নয়, রয়েছে এনডিএ-র দীর্ঘমেয়াদি সাংগঠনিক প্রস্তুতি এবং নির্দিষ্ট ভোটারকে টার্গেট করার কৌশলও। প্রসঙ্গত, বিহারে বিজেপি বহুদিন ধরেই নীচুতলার সংগঠন শক্তিশালী করেছে। গ্রামীণ এলাকায় বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন এবং যুব ভোটারদের বৃহৎ অংশকে নিজের দিকে টানতে তারা পরিকল্পিত প্রচার করেছে। জেডিইউও মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়েছে। ফলে ভোটবাক্সে দুই দলের সমন্বিত প্রভাব স্পষ্টভাবে প্রভাব ফেলেছে।
তবে তার পরেও যে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, সেটি হল একটি রাজ্যে যেখানে বহু নির্বাচনে বহুস্তরীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং সামাজিক বিভাজন বড় ভূমিকা নেয়, সেখানে এত বিপুল সংখ্যক আসন দখল সত্যিই কি শুধু জনসমর্থনের প্রতিফলন? নাকি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে এমন কিছু ঘটেছে, যার প্রভাব ভোটবাক্সে পড়েছে?
তবে এই প্রশ্নের উত্তর এখনই স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, এই ফলাফল ভবিষ্যতের নির্বাচনে রাজনৈতিক পরিবেশকে আরও উত্তপ্ত করবে। বিরোধীরা ইতিমধ্যেই নির্বাচনী সংস্কারের দাবি তুলেছে। আর এনডিএ-র সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ— এই বিপুল জয়ের পর জনগণের আস্থা ধরে রাখা এবং সমস্ত অভিযোগের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করা।
তাই বিহার নির্বাচনের এই ফলাফল শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি জাতীয় রাজনীতির স্বচ্ছতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং নির্বাচনী গণতন্ত্রের কাঠামো নিয়ে এক গভীর আলোচনার দরজা খুলে দিয়েছে। আগামী দিনে এই বিতর্কই হয়তো নির্ধারণ করবে বিহারের রাজনীতি কোন পথে এগোবে এবং জাতীয় রাজনীতির অভিমুখ কোনদিকে মোড় নেবে।