সৈয়দ হাসমত জালাল
সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরুর আগে রাজনৈতিক মহলে তীব্র বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে। রাজ্যসভার সচিবালয়ের একটি বুলেটিনে জানানো হয়েছে, অধিবেশন চলাকালীন সাংসদরা বক্তব্যের শুরু বা শেষে আর ‘জয় হিন্দ’ বা ‘বন্দে মাতরম’ বলতে পারবেন না। পাশাপাশি ‘ধন্যবাদ’-এর মতো শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। এই নির্দেশকে কেন্দ্র করে স্বাভাবিকভাবেই উত্তাপ বেড়েছে রাজনৈতিক মহলে।
সোমবার থেকে শুরু হচ্ছে শীতকালীন অধিবেশন। নতুন উপরাষ্ট্রপতি সি পি রাধাকৃষ্ণন প্রথমবার রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হিসেবে অধিবেশন পরিচালনা করবেন। তার আগেই সচিবালয় জানিয়ে দিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার ওপর বক্তব্য দিতে গিয়ে যদি সাংসদরা অহেতুক এই স্লোগান উচ্চারণ করেন, তবে সংসদের সময় নষ্ট হয় এবং সংসদের গাম্ভীর্য নষ্ট হয়। তাই স্লোগান নয়, গাম্ভীর্য বজায় রাখতে বলা হয়েছে সকলকে। একই সঙ্গে প্ল্যাকার্ড প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা, অভিযোগ তুললে প্রমাণ পেশের বাধ্যবাধকতা, এবং চেয়ারপারসনের মন্তব্যের সমালোচনায় রাশ টেনে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, দেশজুড়ে মাত্র তিন সপ্তাহ আগেই কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে পালিত হল ‘বন্দেমাতরম’-এর ১৫০ বছর। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে যে ‘বন্দেমাতরম’ ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে নতুন উদ্দীপনা এনে দিয়েছিল, তাকেই কি তবে সংসদে উচ্চারণ করা অশালীন, ‘ডেকোরাম’-বিরুদ্ধ? ১৯৫০ সালে সংবিধান সভায় বন্দেমাতরমকে গ্রহণ করা হয়েছিল ‘জাতীয় গীত’ হিসেবে। এমনকি সংসদের অধিবেশনের সমাপ্তিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতুবির সময় নেপথ্যে বেজে ওঠে বন্দেমাতরমই। আরও প্রশ্ন, স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নিজেও যা উচ্চারণ করেন, সেই ‘জয় হিন্দ’ কি তবে সংসদের জন্য অনুপযুক্ত?
এ বিষয়ে সবচেয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “এই নির্দেশ গণতন্ত্রের আত্মার ওপর সরাসরি আঘাত। ‘বন্দে মাতরম’ আমাদের জাতীয় গান। ‘জয় হিন্দ’ প্রতিটি ভারতীয়ের স্লোগান। এগুলো মুছে ফেলার চেষ্টা মানে ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা।” তাঁর অভিযোগ, বাংলার পরিচয় ও কণ্ঠরোধের প্রয়াস চলছে। “বাংলা ভারতের বাইরে নয়, ফুটনোটও নয়— এই দেশের গর্বিত অংশ,” মন্তব্য মুখ্যমন্ত্রীর।
তিনি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন—“আমাদের ইতিহাস, পরিচয় বা সংসদে কণ্ঠস্বর কাউকে মুছে দিতে দেব না। বন্দে মাতরম। জয় হিন্দ। জয় বাংলা।”
শীতকালীন অধিবেশন শুরুর আগেই এই নির্দেশ ঘিরে কেন্দ্র–রাজ্য সংঘাত যে আরও ঘনীভূত হতে চলেছে, তা স্পষ্ট এবং আগামী সপ্তাহে সংসদে তার প্রতিধ্বনি জোরালোভাবে শোনা যাওয়ারই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
বাঙালি মনীষীদের ভাবমূর্তি ও তাঁদের ঐতিহাসিক অবদান ইচ্ছাকৃতভাবে মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে, এমন অভিযোগ অনেকদিন ধরেই তুলছেন বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও সংস্কৃতি মহলের প্রতিনিধিরা। তাঁদের দাবি, বিজেপি ও আরএসএস–ঘনিষ্ঠ মহল রবীন্দ্রনাথকে পাঠ্যক্রম থেকে সরানোর উদ্যোগ নিয়েছে। অভিযোগকারীদের বক্তব্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত দেশের জাতীয় সংগীত নিয়েও নানা মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়। তাঁদের প্রচার, এই সংগীত রচিত হয়েছিল পঞ্চম জর্জের বন্দনায়। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই কথার প্রতিবাদ করে গিয়েছেন।
সমালোচকদের মতে, বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়কে ‘ব্রিটিশদের দালাল’ বলে চিহ্নিত করার প্রবণতা উদ্বেগজনক। রবীন্দ্রনাথের অসামান্য সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ রচিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে। পরে ১৯৭২ সালে এই সংগীতটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখন এই গানটি গাইলে তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা হবে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা।
ইতিহাস বলে, স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালিদের অবদান ছিল সুদূরপ্রসারী এবং আন্দামানের সেলুলার জেলে সর্বাধিক বন্দী ছিলেন বাঙালিরাই। বহু বাঙালি বিপ্লবীর নাম সেখানে ক্রমে আড়ালে চলে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
এখন নতুন করে বিতর্কের কেন্দ্রে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বন্দে মাতরম’ এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর অমর স্লোগান ‘জয় হিন্দ’। বাংলা সংস্কৃতি মহলের এই অভিযোগ ওঠা খুব স্বাভাবিক যে, বাঙালির আত্মপরিচয় গঠনে যাঁরা মুখ্য ভূমিকা নিয়েছেন, তাঁদেরই অবদানকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানো হচ্ছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই বিজেপি-আরএসএসের এই প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে বলে অভিমত তাঁদের।