সংসদের উভয় কক্ষেই অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত বাদল অধিবেশন

ফাইল চিত্র

এক মাসের টানাপড়েন, হট্টগোল এবং সীমিত কার্যক্রমের পর বৃহস্পতিবার অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে গেল সংসদের বাদল অধিবেশন। ২১ জুলাই শুরু হওয়া এই অধিবেশন প্রায়ই বিরোধী দলগুলির প্রতিবাদ, স্লোগান, ওয়াকআউট এবং হট্টগোলে বিপর্যস্ত হয়েছে। স্বাধীনতা দিবসের সরকারি কর্মসূচির জন্য ১২ থেকে ১৭ আগস্ট অধিবেশন স্থগিত থাকার পর ১৮ আগস্ট আবার অধিবেশন শুরু হলেও সেই কার্যক্রমে খুব একটা গতি আসেনি।

এক মাসের এই অধিবেশনে লোকসভা ও রাজ্যসভা মিলিয়ে মোট ২৬টি বিল পাস হয়েছে—লোকসভায় ১২টি এবং রাজ্যসভায় ১৪টি। তবে প্রায় প্রতিদিনের হট্টগোল সংসদে অধিবেশনের অগ্রগতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লা সমাপনী ভাষণে জানান, এই অধিবেশনে পরিকল্পনা ছিল অন্তত ১২০ ঘণ্টা আলোচনার, কিন্তু ক্রমাগত বিঘ্নের কারণে কাজ হয়েছে মাত্র ৩৭ ঘণ্টা। তিনি জানান, ৪১৯টি তারকা চিহ্নিত প্রশ্নের মধ্যে মাত্র ৫৫টির উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বিড়লা বলেন, ‘এটি আত্মসমালোচনার সময়। জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে পর্যাপ্ত আলোচনা সম্ভব হয়নি, যা সংসদীয় ঐতিহ্যের পরিপন্থী।’

এই অধিবেশনে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে অনলাইন গেমিং নিয়ন্ত্রণ বিল, জাতীয় ক্রীড়া প্রশাসন বিল, জাতীয় ডোপিং বিরোধী সংশোধনী বিল, ভারতীয় বন্দরের বিল, খনন ও খনিজ সংশোধনী বিল এবং আয়কর সংশোধনী বিল। রাজ্যসভায় পাস হয়েছে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন বিল, উপকূলীয় নৌচালনা বিল এবং ব্যবসায়ী নৌচালনা বিলসহ একাধিক সমুদ্রবিষয়ক বিল, যেগুলোকে সরকার ভারতের নৌবাণিজ্যকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছে।


অধিবেশনের শেষ সপ্তাহে কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন, যাতে গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পদ থেকে অপসারণের বিধান রাখা হয়েছে। এই আইন কার্যকর হলে প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরাও এই আওতায় পড়বেন। পাশাপাশি, সংবিধান সংশোধনসহ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।

তবে বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, সরকার আলোচনার সুযোগ না দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে বিলগুলি পাস করিয়ে নিয়েছে কেন্দ্র। বিশেষ করে বিহারের ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা চেয়েও বিরোধীরা তা পাননি। বিরোধী দলগুলির দাবি, বিজেপি এবং নির্বাচন কমিশন মিলে রাজ্যে ভোটার তালিকায় কারচুপির ষড়যন্ত্র করছে। এই দাবি ঘিরে লোকসভা এবং রাজ্যসভা উভয় কক্ষেই তুমুল হট্টগোল হয়েছে।

সরকারি শিবির অবশ্য এই অধিবেশনকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে দাবি করেছে। কেন্দ্রীয় বন্দর, জাহাজ ও জলপথ মন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল বলেছেন, ‘এই বাদল অধিবেশন ভারতের উন্নয়নযাত্রার একটি মাইলফলক। সমুদ্রক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিল ভবিষ্যতের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত তৈরি করবে, যা আমাদের ২০৪৭ সালের উন্নত ভারতের স্বপ্ন পূরণে সহায়ক হবে।’ বিরোধীদের ক্রমাগত হট্টগোল নিয়ে সোনোয়াল কটাক্ষ করে বলেন, ‘সংসদের কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিরোধীদের গঠনমূলক ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তাঁরা  জেদী অবস্থানে অনড় রয়েছেন।’

একই সুরে লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লাও বিরোধীদের পরিকল্পিত বিঘ্ন ঘটানোর রাজনীতির সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটি দুঃখজনক যে, জনগণের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনা হয়নি।’ রাজ্যসভায়ও একই পরিস্থিতি দেখা গিয়েছে। বিল পাসের সময় একাধিকবার ওয়াকআউট করেছে বিরোধী দলগুলো। কেবল প্রথম দিনের বিল অফ ল্যাডিং বিলই কোনও বাধা ছাড়াই পাস হয়েছিল।

বাদল অধিবেশনের এই চিত্র স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিল, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিল পাস করালেও কার্যকর বিতর্ক এবং গঠনমূলক সংলাপের অভাব সংসদের গুণগত মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এক মাসের হট্টগোলপূর্ণ অধিবেশন শেষে সংসদের উভয় কক্ষেরই লক্ষ্য—আগামী অধিবেশনে কার্যকর, আলোচনাভিত্তিক কাজকর্ম ফিরিয়ে আনা।