বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্যানক্রিয়াস ক্যান্সার সবথেকে মারাত্মক ক্যানসার। কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে প্যানক্রিয়াস ক্যান্সার শনাক্ত করা কঠিন। এর অন্যতম কারণ হল, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর কোনও লক্ষণ থাকে না। শুধু তাই নয়, এমন কোনও স্ক্রিনিং পরীক্ষাও নেই যা প্রাথমিকভাবে লক্ষণগুলি দেখা দেওয়ার আগেই প্যানক্রিয়াস ক্যানসারকে শনাক্ত করতে পারে। ফলে এই রোগে মৃত্যুর সম্ভাবনাও অনেক বেশি। ২০১৮ সালের হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪ লক্ষ ৩২ হাজার ২৪২ জন প্যানক্রিয়াস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন, এবং ওই বছরেই ৪ লক্ষ ৩২ হাজার ২৪২ জন প্যানক্রিয়াস ক্যানসারে মারা গিয়েছিলেন। যেহেতু এই রোগে বেঁচে থাকার হার কম, ফলে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যাও প্রায় একই রকম থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, শুধুমাত্র ২০২২ সালেই বিশ্বব্যাপী ৫ লক্ষ ১০ হাজার ৯৯২ টিরও বেশি নতুন প্যানক্রিয়াস ক্যান্সারের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, এই রোগটি প্রাথমিকভাবে ধরা যায় না, যতক্ষণ না এটি স্টেজ থ্রি বা স্টেজ ফোর-এর পর্যায়ে পৌঁছয়। ফলে চিকিৎসা করাও চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। সম্প্রতি ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট বেশ কয়েকটি বড় গবেষণা প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার মাধ্যমে এই রোগের প্রাথমিক শনাক্তকরণ সম্ভব হয়।
পেটের পেছনদিকে অবস্থিত প্যানক্রিয়াস এমন একটি গ্রন্থি বা গ্ল্যান্ড, যা রক্তে শর্করার হার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ইনসুলিন হরমোন ছাড়াও বিভিন্ন হরমোন এবং হজমে সহায়ক এনজাইম তৈরি করে প্যানক্রিয়াস। প্যানক্রিয়াস আমাদের শরীরের এমন একটি জায়গায় থাকে যে, প্যানক্রিয়াসে কোনও সমস্যা দেখা দিলে তা বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে। ডিরেক্টর অফ ল্যাব সার্ভিসেস, ন্যাশনাল অ্যাক্রিডিটেশন বোর্ড ফর টেস্টিং অ্যান্ড ক্যালিব্রেশন ল্যাবরেটিজ এবং অঙ্কো প্যাথলজিস্ট চিকিৎসক সুকান্ত চক্রবর্তী এই রোগের শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেছেন দৈনিক স্টেটসম্যানের প্রতিনিধি পিয়ালী হাজরার সঙ্গে। তিনি জানালেন, প্যানক্রিয়াস ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এই রোগের শনাক্তকরণ সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। তিনি জানান, এই রোগে যেহেতু প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ ধরা পড়ে না, তাই শনাক্তকরণেও দেরি হয়ে যায়।
সাধারণ আলট্রাসাউন্ড, এমনকি সিটি স্ক্যানেও অনেক সময় ভাল করে প্যানক্রিয়াসের কোনও সমস্যা বোঝা সম্ভব হয় না। তবে সেই টেস্টে কিছু সন্দেহজনক মনে হলে তখন এন্ডোস্কোপিক আলট্রাসাউন্ড বা পিইটি স্ক্যান প্রয়োজন পড়ে। তাতেও যদি শনাক্ত করা সম্ভব না হয়, তখন ইআরসিপি-র প্রয়োজন হয়। এই ইআরসিপি পরীক্ষায় একটি এন্ডোস্কোপ মুখ দিয়ে প্রবেশ করিয়ে খাদ্যনালী, পাকস্থলি এবং ডিওডেনামের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর এক্স-রে করা হয়। এতে টিউমার, বা ব্লকেজ বা পাথর থাকলে তা ধরা পড়ে। টিউমার ধরা দিলে তখন তার বায়োপসি করা হয়। ফলে এই রোগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় বলে জানালেন অঙ্কো প্যাথলজিস্ট সুকান্ত চক্রবর্তী।
চিকিৎসক সুকান্ত চক্রবর্তী জানালেন, ব্রাশ সাইটোলজি ডায়াগনসিস এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে পরীক্ষকরা একটি ছোট ব্রাশ ব্যবহার করে প্যানক্রিয়াসের নির্দিষ্ট স্থানের কোষ সংগ্রহ করে তারপর সেগুলি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এতে রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এছাড়াও রয়েছে প্যানক্রিটিকোডুওডেনেক্টমি বা হুইপল অপারেশন। এটি এমন একটি অস্ত্রোপচার যা প্যানক্রিয়াসের মাথা থেকে ক্যানসারাস টিউমার অপসারণের জন্য করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে এটি ডুওডেনাল ট্রমা বা দীর্ঘস্থায়ী প্যানক্রিয়াটাইটিসের চিকিৎসার জন্যও ব্যবহার করা হয়।
প্যানক্রিয়াসের মোট তিনটি অংশ, হেড, টেল এবং বডি। প্যানক্রিয়াসের রস বা পাচক রসকে ডিওডেনামে বহন করে নিয়ে যায় প্যানক্রিয়াটিক ডাক্ট, যা প্যানক্রিয়াসের মধ্যে অবস্থিত একটি টিউব। এই টিউবটি পাচক রসকে বাইল ডাক্ট বা পিত্ত থলির সঙ্গে মিলিয়ে দেয়, যা হজমে সাহায্য করে। সেটি এসে খোলে খাদ্যনালীর ডিওডেনামে। সেখানে যদি ক্যানসার হয় তাকে বলা পেরি অ্যাম্পুলারি ক্যান্সার। এক্ষেত্রে ক্যানসার হয় প্যানক্রিয়াসের হেড বা মাথায়। এর লক্ষণ সাধারণভাবে জন্ডিস। জন্ডিস ছাড়াও অন্যান্য কিছু শারীরিক অসুবিধে দেখা দিতে পারে। যেহেতু প্যানক্রিয়াস আমাদের শরীরে পিছন দিকে রয়েছে, তাই এক্ষেত্রে পিঠে ব্যথাও একটি অন্যতম প্রধান লক্ষণ। এছাড়াও পেটে ব্যথা, খেতে ইচ্ছে না করার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। একইভাবে অরুচি, ওজন কমে যাওয়া, এবং সেই সঙ্গে দুর্বলতা, বমি বমি ভাব বা খাওয়ার পর বমি হওয়া কিংবা ডায়াবেটিস বা রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
প্রাথমিকভাবে এর লক্ষণগুলি সাধারণ কিছু শারীরিক সমস্যা বলে মনে হতে পারে। ফলে সবাই পরীক্ষা নিরীক্ষাও করান না। আবার অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষায় ধরা না পড়ায় রোগ নির্ণয় করাও সম্ভব হয়না। সেই কারণেই এই ক্যানসার দ্রুত শরীরের অন্যান্য অংশে বিশেষত লিভার বা ফুসফুসে থাবা বসাতে পারে। প্যানক্রিয়াস ক্যানসারের সঠিক কারণ এখনও অজানা। তবে কিছু কারণ এই রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। যেমন ধূমপান এই ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা, ডায়াবেটিস, কিংবা জিনগত কারণেও প্যানক্রিয়াস ক্যান্সার শরীরে বাসা বাধতে পারে।
অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতাল এবং অ্যাপোলো ক্যান্সার সেন্টার কলকাতার কনসালট্যান্ট অঙ্কো-সার্জন সুপ্রতিম ভট্টাচার্যও জানাচ্ছেন, প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে স্টেজ ওয়ান বা স্টেজ টু-তে সার্জারি করার পর প্যানক্রিয়াস ক্যান্সারের রোগীর সেরে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। স্টেজ থ্রিতে কেমোথেরাপি দিয়ে ডাউন স্টেজ করে তারপর সার্জারি করা হয়। কিন্তু স্টেজ থ্রি বা ফোর-এ ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারও খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা ধরে অস্ত্রোপচার চলে। কারণ এই অপারেশনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে স্টমাক, প্যানক্রিয়াস, গল ব্লাডার, স্মল ইনটেস্টাইন, বাইল ডাক্ট এবং লিম্ফনোডের মতো শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হল, রোগ দেরিতে ধরা পড়লে রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। তাই সময় থাকতে প্যানক্রিয়াসের ক্যান্সার শনাক্ত করা খুবই জরুরি, কারণ দেরিতে ধরা পড়লে এটি প্রায়ই মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে।
ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের একটি নতুন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্যানক্রিয়াস ক্যানসারে অন্যতম ঝুঁকির কারণ হল ডায়াবেটিস। এই সংস্থার একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ১ জনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ৩ বছরের মধ্যে প্যানক্রিয়াসের ক্যানসার ধরা পড়ে এবং প্যানক্রিয়াসে ক্যান্সারে আক্রান্ত ৪ জনের মধ্যে ১ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। এনসিআই-সমর্থিত নিউ অনসেট ডায়াবেটিস (এনওডি) স্টাডি বা গবেষণা শুরু হয়েছে ২০২৫-এ। সেখানে বর্তমানে নতুন-শুরু হওয়া ডায়াবেটিস বা হাইপারগ্লাইসেমিয়া (প্রিডায়াবেটিস নামেও পরিচিত)-র ১০ হাজার জনকে তালিকাভুক্ত করেছে। এনওডি গবেষকরা একটি নতুন রক্ত পরীক্ষা নিয়ে গবেষণা করছেন, যার মাধ্যমে নতুন ডায়াবেটিস নির্ণয়ের সঙ্গে সঙ্গে, যাঁদের প্যানক্রিয়াস ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ রয়েছে তাও ধরা পড়া সম্ভব হবে। প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার ডিটেকশন কনসোর্টিয়ামের (পিসিডিসি) মাধ্যমে এনসিআই-গবেষক দলগুলি এই রক্ত পরীক্ষা তৈরি করার চেষ্টা করছেন যা প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ ধরতে সক্ষম হবে।
ক্যান্সার যদি প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে তবে অস্ত্রোরপচারের মাধ্যমে টিউমার সরিয়ে ফেলা হয়। কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপি ক্যান্সার কোষের ধ্বংস করতে ব্যবহার করা হয়। টার্গেটেড থেরাপি ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি এবং বিস্তার বন্ধ করতে সাহায্য করে থাকে। তবে এই রোগ প্রতিরোধ করতে ধূমপান অবশ্যই ছাড়তে হবে। এড়াও ডায়াবেটিস ও অন্যান্য রোগের চিকিৎসা যথাসময়ে করানো, এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা মেনে চলতে হবে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা।