রোগ প্রতিরোধ ও আয়ু বৃদ্ধির জন্য গবেষণাগারে একক কৃত্রিম ডিএনএ তৈরির চেষ্টায় বিজ্ঞানীরা

প্রতীকী চিত্র

অসাধ্য সাধন করায় মানুষের কাজ। এবার গবেষণাগারে তৈরি হবে কৃত্রিম ডিএনএ। মানবদেহের রহস্য করায়ত্ত করতেই এই উদ্যোগ। এই গবেষণা সফল হলে মানবদেহের রোগ নিরাময় সম্ভব হবে। এমনকি দেহের ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গ মেরামত করাও সম্ভব হবে। বেড়ে যাবে মানুষের আয়ু।

বিশ্বের অন্যতম চিকিৎসা বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ওয়েলকাম ট্রাস্ট’-এর উদ্যোগে শুরু হচ্ছে কৃত্রিম ডিএনএ প্রকল্প। প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি করা হবে একক কৃত্রিম ডিএনএ। আগামী পাঁচ বছর ধরে ‘সিন্থেটিক হিউম্যান জিনোম’ নামের এই প্রকল্পে গবেষণাগারে কৃত্রিম ডিএনএ তৈরির উপায় খুঁজে বের করবেন বিজ্ঞানীরা। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পে ১১৬ কোটি টাকার অনুদান দিয়েছে ‘ওয়েলকাম ট্রাস্ট’। এই গবেষণার কাজে যুক্ত হয়েছেন অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ এবং ইম্পেরিয়াল কলেজ-সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক বিজ্ঞানী।

জানা গিয়েছে, ‘হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট’-এর প্রথম ধাপে বিজ্ঞানীরা বার কোডের মতো সমস্ত মানব-জিন পড়তে সক্ষম হয়েছেন। ‘সিন্থেটিক হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট’ নামে যে নতুন কাজটি শুরু হয়েছে তাতে বিজ্ঞানীরা শুধু ডিএনএ-র রহস্য উদ্‌ঘাটনই করবে না, ডিএনএ-র কিছু কিছু অংশ তৈরিও করতে পারবেন। এমনটাই ধারনা করছেন বিজ্ঞানীরা।


এই প্রকল্পের অন্যতম সদস্য কেমব্রিজের ‘এমআরসি ল্যাবরেটরি অফ মলিকিউলার বায়োলজি’র গবেষক জুলিয়ান সেল। তিনি দাবি করেছেন, এই গবেষণায় ক্ষতির থেকে উপকার পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এই গবেষণা প্রবীণদের জীবনের মান উন্নত করবে। সুস্থতার সঙ্গে বাড়বে বয়স। তিনি জানিয়েছেন, বার্ধ্যকের সঙ্গে সঙ্গে মানবদেহে বাসা বাধে রোগ। কিন্তু এই পদ্ধতির সাহায্যে ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গগুলিতে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এ জন্য তাঁরা সম্পন্ন কোষ তৈরির চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি

গবেষক জুলিয়ান সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, তাঁরা এমন একটি জিন থেরাপির সন্ধানে ব্রতী হয়েছেন, যা বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনকে আরও উন্নত করতে পারবে। একই সঙ্গে রোগের প্রকোপও কমাতে পারবে।

প্রসঙ্গত, প্রতিটি প্রাণীর কোষের ভিতর তাঁর অন্তর্নিহিত সত্ত্বা ধরা রয়েছে। যেটি ডিঅক্সি-রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা ডিএনএ নামে পরিচিত। এই ডিএনএ-এর ভিতর লুকিয়ে রয়েছে প্রাণ সৃষ্টির যাবতীয় রহস্য। এই ডিএনএ-তে কোন ধরনের প্রাণ কীভাবে সৃষ্টি করা হবে, তার তথ্য আগে থেকেই ধরে রাখা থাকে।

অন্যান্য প্রাণীর মতো মানব শরীরের প্রতিটি কোষেও ডিএনএ নামক একটি উপাদান থাকে, যা প্রয়োজনীয় জিনগত তথ্য বহন করে। জিনের রহস্যের চাবিকাঠি সম্পূর্ণরূপে জানা গেলেই যাবতীয় অসুখবিসুখের উৎস-রহস্যও জানা যায়। বিজ্ঞানীরা তাঁদের ধারাবাহিক গবেষণা থেকে জানতে পেরেছেন, মানবদেহের প্রতিটি কোষে উপস্থিত ডিএনএ-র মধ্যে অ্যাডেনিন (এ), থায়ামিন (টি), গুয়ানিন (জি), সাইটোসিন (সি) নামে চারটি নিউক্লিওটাইড রয়েছে। এছাড়া রয়েছে ২০ রকমের অ্যামাইনো অ্যাসিড, হাজার হাজার প্রোটিন বা অন্য রকমের অণু অথবা নানা রকমের কোটি কোটি কোষ বানানোর জন্য আর একটি অণুকে খুব জরুরি কিছু তথ্য বা ইনফরমেশন দিতে হয় ডিএনএ-কে। সেই উপাদানের নাম ‘রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড’ বা ‘আরএনএ’। এই পদ্ধতির নাম ‘ট্রান্সস্ক্রিপশন’। বিজ্ঞানের পরিভাষায় ওই আরএনএগুলিকে বলে ‘মেসেঞ্জার আরএনএ’ বা ‘নিউক্লিওটাইড্‌স’ বা ‘নিউক্লিওবেসেস’। গোপনে এমআরএনএ বা মেসেঞ্জার আরএনএ-কে বলে আসে, প্রাণ কীভাবে তৈরি করতে হবে। কিছু কিছু আরএনএ তাদের মধ্যে ‘বার্তাবাহক’ হয়ে ওঠে।

তাহলে এবার প্রশ্ন আসছে, এই একক কৃত্রিম ডিএনএ আবিষ্কারের মাধ্যমে কীভাবে মানবদেহের রোগমুক্ত করা সম্ভব হবে? এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা ধারনা করছেন, মানবদেহে যে অজস্র কোষের সমষ্টি রয়েছে, তার গভীরেই লুকিয়ে রয়েছে সমস্ত রোগের কারণ। সেই রহস্য বুঝতেই জিনের হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টের গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সেই উদ্দেশ্যেই গবেষণা করবেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের প্রথম লক্ষ্য, কৃত্রিম উপায়ে মানুষের ডিএনএ আরও বৃহত্তরভাবে তৈরির উপায় খুঁজে বের করা। কারণ কৃত্রিমভাবে একটি মানব ক্রোমোজোম তৈরি করতে না পারলে উদ্দেশ্য সফল হবে না। কারণ এই ক্রোমোজোমের মধ্যে এমন জিন রয়েছে, যা মানবদেহের মেরামতি বা রোগ নিরাময়, এমনকি বার্ধক্য নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে।

ওয়েলকাম স্যাঙ্গার ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ম্যাথিউ হার্লস। তাঁর মতে, যখন জিনের মধ্যে পরিব্যক্তি (মিউটেশন) ঘটে, তখন সেগুলিতে নানারকম ত্রুটি দেখা যায়। আর তখনই শরীরে বিভিন্নরকম রোগ বাসা বাঁধে। কৃত্রিম উপায়ে তৈরি জিনোমের মাধ্যমে সেই ত্রুটি সারিয়ে মারণব্যাধিকে দূর করা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গও পুনর্গঠন করা সম্ভব হবে।

সেজন্য যদি কৃত্রিম জিন একবার আবিষ্কার করা সম্ভব হয়, তাহলে সেগুলি দিয়ে রোগ প্রতিরোধী কোষ তৈরি করা সম্ভব হবে। এমনকি ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গগুলি সারাই করে বার্ধক্য রোধ করাও সম্ভব হবে। কারণ এই সম্ভাবনার মাঝে রয়েছে জীবন্ত কোষ। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এর সাহায্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বিরুদ্ধে আক্রমণ বা অটোইমিউন রোগে আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ করে তোলাও সম্ভব হবে। শুধু তাই নয়, সেই সঙ্গে এই কোষ ব্যবহার করে দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণে ক্ষতিগ্রস্থ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করাও সম্ভব হবে। ফলে মানুষকে একপ্রকার অমরত্বের সন্ধান দেবে এই আবিষ্কার।

উল্লেখ্য, প্রথম বার মানুষের জিনোমের খসড়াটি প্রকাশ্যে আসে ২০০১ সালে। জানা যায়, মানুষের জিনোমে রয়েছে ৩০০ কোটি বেস-পেয়ার। আবার প্রতিটি ডিএনএ সিকোয়েন্স পরস্পরের থেকে আলাদা। প্রায় ২০-২৫ হাজার জিন রয়েছে মানুষের জিনোমে। অথচ এই কোষগুলোকে দখেতে প্রায় একই রকম লাগে। এদের মধ্যে কোন কোষে কোন জিনগুলি সক্রিয় রয়েছে, তার উপর ভিত্তি করে চরিত্র তৈরি হয়। কোনও পেশির কোষে যে জিন স্নায়ুর কোষ কিংবা হৃৎপিণ্ডের কোষের থেকে আলাদা। সেজন্য কোষের ধরন বুঝতে হলে তার কোন জিনগুলি সক্রিয় রয়েছে, সর্বপ্রথম সেটা বোঝা দরকার।