‘প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া দৌড়, কিন্তু লাভ হল না’  

One of the trapped workers is checked out after he was rescued from the collapsed tunnel site in Uttarkashi in the northern state of Uttarakhand, India, November 28, 2023. Uttarkashi District Information Officer/Handout via REUTERS THIS IMAGE HAS BEEN SUPPLIED BY A THIRD PARTY. EDITORIAL USE ONLY. NO RESALES. NO ARCHIVES.

উত্তরকাশী, ২৯ নভেম্বর – সব যন্ত্রণা, সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে উত্তরকাশীর ভেঙে পড়া টানেল থেকে ৪২২ ঘন্টা পর মুক্তি মিলেছে ৪১ জন শ্রমিকের। ১২ নভেম্বর সকালেই ঘটেছিল অঘটন। টানেলের মধ্যে ধস নেমে বন্ধ হয়ে যায় বেরিয়ে আসার রাস্তা। অন্ধকার টানেলের মুখ্যে আকস্মিক এই দুর্ঘটনায় প্রথমে হতভম্ব হয়ে যান শ্রমিকেরা, তারপর ধীরে ধীরে ঘিরে ধরে মৃত্যুভয়। টানেল ভেঙে পড়ার পর প্রথম ২৪ ঘন্টা তাঁদের সব থেকে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। দমবন্ধ পরিবেশ, পেটেতে খিদের টান, মনে অনিশ্চিত বেঁচে থাকার ভাবনা। ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে তাঁরা যে সহজে বেরোতে পারবেন না তা বুঝতে পেরেছিলেন আটকে থাকা ৪১ কর্মী। তারপর টানা ১৭ দিন সেই সুড়ঙ্গেই কেটেছে তাঁদের। চলেছে বেঁচে থাকার লড়াই। মাঝেমধ্যে মনোবল ভেঙেছে, হতাশা গ্রাস করেছে , কিন্তু পরক্ষনেই একে অপরের মনোবল বাড়িয়ে শক্তি জুগিয়েছেন নিজেরা নিজেদেরই। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ফের পৃথিবীর আলো নতুন করে তাদের চোখে। তা সইয়ে নিয়ে প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা।  প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে তাঁদের সেই অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন বিশ্বজিৎ কুমার, জমরা ওঁরাও।

সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গে আটকে পড়া শ্রমিকদের মধ্যে ছিলেন ঝাড়খণ্ডের শ্রমিক বিশ্বজিৎ কুমার। বুধবার সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে তাঁদের জীবনের এই অন্ধকার অধ্যায়ের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন তিনি। বিশ্বজিৎ বলেন, ‘‘ সুড়ঙ্গের একাংশ ভেঙে পড়ার পড়ি আমরা বুঝতে পেরেছিলাম আমরা আটকে গিয়েছি। ভয় গ্রাস করলেও আমাদের আশাও ছিল।’’

বিশ্বজিৎ আরও বলেন, ‘‘আটকে পড়ার পর প্রায় গোটা একটি দিন আমরা নানারকম অসুবিধার সম্মুখীন হই। কিন্তু পরে একটি পাইপের সাহায্যে আমাদের চাল, ডাল এবং শুকনো ফল পাঠানো হয়েছিল। পাঠানো হয় একটি মাইকও। সেই মাইকের সাহায্যে আমি এবং আমার সহকর্মীরা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলি। এর পর থেকে শুধুই অপেক্ষা।’’


ঝাড়খণ্ডের খুঁটি জেলা থেকে শ্রমিক হিসাবে উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে কাজ করতে গিয়েছিলেন ৩২ বছরের জমরা ওঁরাও। এক সংবাদমাধ্যমে জমরা জানান, ১২ নভেম্বর ভোরে সুড়ঙ্গে কাজ করার সময় একটা বিকট শব্দ শুনতে পান তাঁরা। তাঁদের চোখের সামনেই হুড়মুড়িয়ে ধসে পড়ে সুড়ঙ্গের একাংশ। জমরার কথায়, “নিজেদের বাঁচাতে আমরা প্রাণপন দৌড়েছিলাম। কিন্তু লাভ হয়নি। আমরা কেউই বেরোতে পারিনি। সে মুহূর্তে আমরা সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারি, অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আমরা আটকে পড়েছি। সবাই খুব অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। খুব খিদে পেয়েছিল। নানা রকম ভয়-ভাবনা মনকে গ্রাস করছিল। সাহায্যের জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা শুরু করি। কিন্তু আমরা আশা ছাড়িনি।”

জমরা জানান, টানেলে আটকে পড়ার পর টানা ২৪ ঘণ্টা অভুক্ত থাকতে হয়েছিল তাঁদের। এরপর প্রশাসনের পাঠানো খাবার পৌঁছয়। প্রথম খাবার পাঠানো হয়েছিল মুড়ি ও এলাচ।  তিনি বলেন, “২৪ ঘণ্টা পর যখন আমরা প্রথম খাবার খেলাম, তখন উপলব্ধি করলাম যে বেঁচে আছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে কেউ ঠিক আমাদের কাছে পৌঁছবে। আমাদের উদ্ধার করা হবে বলে বারবার আশ্বাসও দেওয়া হয়। ফলে আমাদের আশাও বাড়ে।’’ ঝাড়খণ্ডের ওই শ্রমিক আরও জানিয়েছেন, কংক্রিটের ওই বন্দিজীবনে মোবাইল গেমই ছিল তাঁদের ভরসা। মোবাইলে লুডো খেলে অনেক সময় পার করেছেন তাঁরা। বাইরে থেকে আমাদের চার্জার পাঠানোয়  ফোন চার্জ করতে অসুবিধা হয়নি। তবে নেটওয়ার্ক না থাকায়, কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। এছাড়াও বেশির ভাগ সময় অন্যান্যদের সঙ্গে কথা বলে হালকা হয়েছেন , মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। 

উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে যে ৪১ জন আটকে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই ঝাড়খণ্ডের শ্রমিক।জমরা জানিয়েছেন, স্ত্রী এবং তিন সন্তানকে রেখে মাসে ১৮ হাজার টাকার জন্য তিনি ওই সুড়ঙ্গে কাজ করতে যান। জমরা জানিয়েছেন যে, তিনি শারীরিক এবং মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। যদিও তিনি আর টানেল খোঁড়ার কাজ করবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত বাড়িতে পৌঁছে নেবেন বলে জানিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, গত ১২ নভেম্বর উত্তরকাশী জেলার সিল্কিয়ারায়  নির্মীয়মাণ টানেলের একাংশ ধসে পড়ে আটকে পড়েন ৪১ জন শ্রমিক । সেই ঘটনার ১৭ দিন পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ে ৪১ জনকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পরেই ওই কর্মীদের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য । সব কিছু ঠিক থাকলে খুব শীঘ্রই তাঁদের বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছে উত্তরাখণ্ড প্রশাসন।অন্ধকার দিন পেরিয়ে ফের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে বিশ্বজিৎ , জমরাদের জীবন। সেই স্বস্তি আর শান্তিই এখন ঘিরে রয়েছে ৪১ শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারকে।