পশ্চিমবঙ্গের জন্য কৃষিনির্ভর উন্নয়নের রূপরেখা

রাণা ঘোষদস্তিদার

গত সংখ্যায় বাংলার জন্য আদর্শ কৃষিনির্ভর শিল্পের নমুনা হিসাবে ইথানল-বায়োডিজেল উৎপাদনের উল্লেখ করেছিলাম৷ সেজন্য আখচাষ বাড়াতেই হবে যেমন, তেমনি বাড়াতে হবে ভোজ্য ও অভোজ্য তেলবীজ চাষ৷ ভোজ্য তেলবীজ বলতে রবিতে অনায়াসে সর্ষেচাষ বাড়ানো যায় আরো লাখ পাঁচেক হেক্টর অনাবাদী কৃষিজমিতে৷ খরিফে বিস্তীর্ণ এলাকায় চীনাবাদামের চাষ বাড়ানো যায়৷ বস্তুত, শুখা রাঢ়বঙ্গ, বিশেষত জঙ্গলমহল এলাকায় খরিফে ধানের বদলে অল্প স্থায়িত্বের চীনাবাদাম চাষ বাড়লে মূল্যবান জলসম্পদ বাঁচানো যায়, রবিতেও ঠিক সময়ে সর্ষে বপন করে সঠিক ফলন পাওয়া যায়৷ ভোজ্য তেলের নীট আমদানিকারক পশ্চিমবঙ্গ তেল উৎপাদনে স্বয়ম্ভর হয়ে উঠলে নানা লাভ, যার মধ্যে একটি হল নয়া তেলকল স্থাপন ও তাদের বছরভর কর্মব্যস্ততা৷ ফলে, বাড়বে কর্মসংস্থান৷ অন্যদিকে, চাহিদার ষাট শতাংশ ভোজ্যতেল যাকে আমদানি করতে হয়, সেই ভারতে ভোজ্যতেল উৎপাদন যে সবসময়েই লাভজনক থাকবে, এ আন্দাজ করার জন্য পুরস্কার না দিলেও চলবে৷ তেলবীজ থেকে তেল নিষ্কাশনের পর পড়ে থাকা খোল নানা কাজে লাগে৷ আর কিছু না করে উঠতে পারলে, অন্তত পুব এশিয়ায় রপ্তানি করে দিলেও চলবে৷ ভারত কয়েক হাজার কোটি টাকার সয়াবিন আর সর্ষে খোল ফি বছর সেখানে রপ্তানি করে পশুখাদ্য হিসাবে৷ সূর্যমুখী চাষও বাড়ানো যায়৷ সেক্ষেত্রে সূর্যমুখী ও সর্ষেচাষের দরুণ, বাংলায় মৌমাছি পালন বাড়তে পারে বিরাট ভাবে এবং, এক্ষেত্রেও আরেকটি কর্মসংস্থানদায়ী কৃষিনির্ভর শিল্প গড়ে উঠতে পারে৷ অবশ্য, এ ব্যাপারে বিরাট সম্ভাবনা আছে সুন্দরবনের৷ পর্যটন বাদ দিলে সুন্দরবনের যে জিনিসটির বিরাট চাহিদা আছে, তা হল মধুর৷ জঙ্গলে ঢুকে বাঘের শিকার না হয়েই সুন্দরবনে মৌমাছিপালন করে মধু উৎপাদন বাড়ানো যায়, যদি, নদী বা খালে নোঙ্গর করে রাখা চওড়া পাটাতনের নৌকায় রেখে দেওয়া যায় মৌমাছির বাক্স৷ মনে রাখবেন, যে কোন দেশের সমৃদ্ধি বর্ণনার অব্যর্থ উল্লেখ হল সেই দেশে দুধ ও মধুর বন্যা বইছে৷ মধু ছাড়া দুধ অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখ্য কৃষিনির্ভর শিল্প হতে পারে৷

তার আগে ইথানল, বায়োডিজেল নিয়ে আরো দু কথা জরুরি৷ বায়োডিজেল তৈরির জন্য কিন্ত্ত তাজা, সদ্য পেষাই করা ভোজ্য তেল চাই না৷ তা যাক মানুষের হেঁসেলে৷ কিন্ত্ত, একই তেল বারবার গরম করে ভাজা রাস্তার ধারের তেলেভাজা যেমন স্বাস্থ্যের জন্য বিষবৎ, তেমনি বাড়ির রান্নাঘরে একই ভোজ্য তেল বারবার ব্যবহার করে রান্না মাছের ঝোল বা তরকারিও অস্বাস্থ্যকর৷ যে কোন মেলায় গেলেই দেখা যাবে, জিলিপি বা পাঁপড় ভাজার জন্য পুরনো তেল ফেলে দিয়ে টাটকা নতুন তেল ব্যবহার হয় না, টপ আপ করা হয়, অর্থাৎ, তেল কমে গেলে কড়াইতে উপর থেকে নতুন তেল ঢেলে দেওয়া হয় মাত্র৷ অথচ, নীচের ব্যবহৃত পুরনো তেলের ফ্যাটি অ্যাসিডের কার্বন দ্বিবন্ধনী ভেঙেচুরে গিয়ে বেড়েছে বা তৈরি হয়ে গেছে ট্রান্স ফ্যাট, বা, ঘুরে বেড়াচ্ছে ফ্রি র্যাডিক্যালস, যা নানাবিধ অসুখের সাথে সাথে ক্যান্সার তৈরি করতেও সরেস৷ এজন্যই, সারা বিশ্বে হোটেল- রেস্তোরাঁগুলিকে কঠোর নিয়মাবলী মেনে চলতে হয়, ভোজ্য তেল অনেকসময় একবার ব্যবহারের পরেই ফেলে দিতে হয়৷ অসাধু ব্যবসায়ীরা একদা এই ফেলে দেওয়া তেল ভারতের মত দেশে অপরিশোধিত ভোজ্য তেল হিসাবে আমদানি করত৷ বর্তমানে, এই ব্যবহৃত তেলের সেরা ব্যবহার হল বায়োডিজেল উৎপাদনে৷ বাড়ি বাড়ি বা হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে ব্যবহৃত ভোজ্য তেল সংগ্রহ করে, তা দিয়ে বায়োডিজেল উৎপাদন যে এক জবরদস্ত কর্মসংস্থানকারী শিল্প হয়ে গড়ে উঠতে পারে, বোঝা শক্ত কি? তবে, বায়োডিজেল হল মূলত উদ্ভিজ্জ তেল ও মিথানলের এস্টার৷ এজন্য, ব্যবহৃত ভোজ্য তেলের পাশাপাশি সুযোগ আছে সামাজিক বনসৃজনের অঙ্গ হিসাবে অভোজ্য উদ্ভিজ্জ তেল যথা ভ্যারেণ্ডা তেলের উৎপাদন করার৷ আমের আঁটি থেকে নিষ্কাশিত তেলও চলতে পারে৷ অন্যদিকে, শহরের সবুজ বর্জ্য বা কৃষিজ বর্জ্যকে গেঁজিয়ে তোলাই হল মিথানল উৎপাদনের সবচেয়ে সহজ রাস্তা৷ ধানের খড় না জ্বালিয়ে দিয়ে, তাকে গ্যাসিফিকেশন ও সিন্থেসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মিথানল উৎপাদন করলে দূষণ কমানো থেকে শুরু করে সস্তা বায়োফুয়েল উৎপাদন সবই হতে পারে৷ মনে রাখবেন, এসব কাজে প্রচুর শিক্ষিত ছেলেমেয়ের দরকার, বিশেষত কেমিস্ট্রি, বায়োকেমিস্ট্রি বা মাইক্রোবায়োলজির ছাত্রছাত্রীর কর্মসংস্থান হতে পারে৷গবেষণা আরো এগোলে, ধানের বা ভুট্টার খড়, পাটকাঠি, কাঠকুটো থেকে উৎপাদন করা যেতে পারে উন্নততর বায়োফুয়েল বিউটানল৷ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এ ধরনের বিষয়ে গবেষণার খাতে দশ টাকা ঢাললে একশো টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা বেশি, মনে রাখা ভালো৷ অন্য অনেক বিষয়ে ব্যাপারটা উল্টো বটে, আর বিশদ নাই বা করলাম৷


এই প্রসঙ্গেই উল্লেখ করা যায় আরো দুটি জবরদস্ত কৃষিনির্ভর শিল্পের কথা৷ প্রথম হল অ্যালকোহল উৎপাদন বা মদ্যশিল্প৷ ইটালি, ফ্রান্স বা স্কটল্যাণ্ডের অর্থনীতির এক স্তম্ভ হল মদ্যশিল্প৷ পশ্চিমবঙ্গে বছরে বাইশ হাজার কোটি টাকার বিয়ার, ওয়াইন বা হার্ডলিকার গোছের মদ বিক্রি হচ্ছে৷ এর কতটুকু পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হয়? জঙ্গলমহলে মহুয়া থেকে তৈরি ওয়াইনকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করা যায়? বিশেষ যব চাষ করে তা থেকে বিয়ার বা হুইস্কি উৎপাদন? আলু থেকে ভোদকা? চাল থেকে বিয়ার? বাঁকুরা-পশ্চিম মেদিনীপুর-পুরুলিয়াতে কিছু নতুন ফসল উৎপাদন করার চেষ্টা করা উচিত, যথা কিন্নু, বেদানা, অলিভ ও আঙুর৷ আঙুর চাষ সফল হলে বাংলার ব্র্যাণ্ডেড ওয়াইন হতে পারে? আপনারা নিশ্চয় জানেন অনূ্যন দুটি ভারতীয় হুইস্কির ব্র্যাণ্ড বিদেশেও জনপ্রিয় হচ্ছে, পুরস্কারও পাচ্ছে৷ সুলা ওয়াইন উৎপাদক বাগিচায় পর্যটন চালু হয়ে গেছে বহু বছর হল, এও জানেন নিশ্চয়ই৷ পশ্চিমবঙ্গে এমন কিছু চেষ্টা হোক! বেলজিয়াম-জার্মানি-নেদারল্যাণ্ডে গ্রামে গ্রামে বিয়ার ব্রুয়ারি আছে৷ তাতে সরাসরি কর্মসংস্থান হয়, বিশেষ যব বা রাই বা গম উৎপাদক চাষি সাধারণ ফসলের দেড়া দাম পায়৷ আর, প্রতি বিয়ার ব্র্যাণ্ডের নিজস্ব ডিজাইনের গ্লাস থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন সর্বত্র সৃজনশীল লোকের প্রয়োজন হয়৷ তাহলে, উত্তরবঙ্গে ভুট্টা, বর্ধমানে চাল হুগলীতে আলু আর পুরুলিয়ায় মহুয়া, যেখানে যা কিছু থেকেই বিয়ার বা ভোদকা বা ওয়াইন তৈরি হোক, কলকাতার বিজ্ঞাপন সংস্থা বা ডিজাইনারদেরও উল্লসিত হবার কারণ থাকছে, কী বলেন!

উত্তরবঙ্গে চা শিল্পকে আরো শক্তপোক্ত করে তোলা হল প্রাথমিক কাজ৷ চায়ের উৎপাদনশীলতা ও গুণমান দুইই বাড়াতে গেলে গবেষণায় বিনিয়োগ জরুরি৷ সেই সঙ্গে চা-পর্যটন ও আনুষঙ্গিক আয়বৃদ্ধিতে দৃষ্টি দিতে হবে৷ এর পাশাপাশি, পাহাড়ে বা তরাইতে কফি উৎপাদন নিয়ে গবেষণা চালানোও জরুরি৷ বাংলা নভেল-সিনেমা-সিরিয়ালে কফিপানের একেবারে ধূম দেখা যায়৷ চা ফেলে ভিনরাজ্যের বা ভিনদেশের পানীয়র প্রতি এত দরদ যখন, বাংলাতেই তা উৎপাদনের চেষ্টা করলে কেমন হয়?

উত্তরের পাহাড়ে বাঁশ, পলিথিন শীটের পলিহাউস বানিয়ে তাতে বছরভর শীতকালীন সবজি উৎপাদন কেন নয়? আপেল বাগিচা কেন করা যাবে না? ভারতে এই ফলের চাহিদা অদূর কেন, দূর ভবিষ্যতেও মিটবার নয়৷ এই তালিকা সুদীর্ঘ৷ পীচ, প্লাম, কিউই, স্ট্রবেরি ইত্যাদি ফল? রাজস্থানের গঙ্গানগর থেকে পঞ্জাবের ভাটিন্ডা যদি কিন্নু চাষ করতে পারে, বা অলিভ, অথবা গুজরাটের বনসকান্থা যদি পাইকারি হারে বেদানা ফলাতে থাকে, তাহলে অনেকটা একই মাটি বা আবহাওয়ার বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর কেন নয়? এই প্রসঙ্গে বলা যায়, আবহাওয়া ও জল-মাটির গুণে, দক্ষিণবঙ্গ একেবারে প্রাকৃতিক গ্রিনহাউস এবং সেখানে বছরভর নানা ধরনের ট্রপিক্যাল ফুল ও সবজি ফলানো সহজ ব্যাপার৷ শুধু, কলকাতার বাজারে সস্তায় না পাঠিয়ে, দেখতে হবে উন্নততর পরিবহনকে কাজে লাগিয়ে ভারতের কোন প্রান্তে ফসল পাঠিয়ে সবচেয়ে বেশি লাভ করা যায়৷ সব ব্যবসা প্রফিট ম্যাক্সিমাইজেশনের থিয়োরি মানবে, শুধু কৃষককে আবেগের সুড়সুড়ি অথবা পরিকাঠামোর দুর্বলতার প্যাঁচে ফেলে সস্তায় খাদ্য বিক্রি করতে বাধ্য করা হবে, এ তো উচিত কথা নয়! এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, শুধু কাঁঠাল উৎপাদনে ও রফতানিতে মন দিলেই পশ্চিমবঙ্গ কর্ণাটক-কেরালার মনোপলি এক লাভজনক ব্যবসায় ভাগ বসাতে পারে৷ আগামীতে বিশদ ব্যাখ্যা করা যাবে৷