শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতা ও সমালোচনামূলক চিন্তার বিকাশ

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

দেবপ্রিয় মুখার্জি
প্রাক্তন বরিষ্ঠ বিজ্ঞানী, কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ

একটি টিউশন সেন্টারে দেখা গেল, ছোট ছোট বাচ্চারা মাটিতে বসে নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে গল্প করছে, আর তাদের শিক্ষক বীজ অঙ্কুরোদগম ও উদ্ভিদের বৃদ্ধি সম্পর্কে শেখানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তার সঙ্গে ছিল উদ্ভিদের জীবনচক্র-সম্পর্কিত কিছু ছবি। ক্লাসরুমের বাইরে ছিল একটি বাগান, যেখানে নানা ধরনের ফুল ও সবজি গাছ লাগানো ছিল। কৌতূহলী শিশুরা সেই বাগানের দিকে ইশারা করে শিক্ষককে দেখাতে চাইছিল। কিন্তু শিক্ষক তাদের দৃষ্টি আবার ক্লাসের দিকে ফেরালেন, যাতে তারা পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারে।
অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্র হাত তুলে জিজ্ঞেস করল— পৃথিবীতে এমন কোনো জায়গা আছে কি, যেখানে গাছপালা নেই? শিক্ষক কথার মাঝপথে থেমে বললেন, “এখন কোনো প্রশ্ন নয়, এখন শেখার সময়।” এই ধরনের শেখানোর পদ্ধতি বাচ্চাদের বাগানে বীজ বপনের অভিজ্ঞতা এবং অঙ্কুরোদ্গমের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে। এ দৃশ্য প্রায় যেকোনো স্কুলেই দেখা যায়। বাচ্চারা যাদের মনে হাজার প্রশ্ন— স্কুলে এসে শিখছে কীভাবে প্রশ্ন না করতে হয়। এতে শিক্ষকের দোষ নেই— তাদের তো অনেক লক্ষ্য পূরণ করতে হয়।

পরীক্ষা ও লক্ষ্য-নির্ধারিত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে অপ্রস্তুত প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলে না এবং শেখার অনেক সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। মানুষ জন্মসূত্রেই কৌতূহলী। ছোট শিশুদের প্রশ্নের পরিমাণ অসীম মনে হয়— এটাই মানুষের শেখার অন্যতম প্রধান উপায়। গবেষণা অনুযায়ী, শিশুরা গড়ে প্রতি ঘন্টায় ১০৭টি প্রশ্ন করে। কোনো কোনো শিশু প্রতি মিনিটে তিনটি প্রশ্ন পর্যন্ত করতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্কুলজীবনে শিক্ষকরা ক্লাসে প্রশ্ন করতে উৎসাহ দেন না, ফলে শিশুর সৃজনশীলতা ও কথোপকথন দক্ষতা তেমন বাড়ে না। অথচ কৌতূহল বাড়ানোই হলো প্রাথমিক শিক্ষার মূল ভিত্তি, যা প্রকৃত শিক্ষাগত সাফল্যের সঙ্গে যুক্ত।


যখন শিক্ষকরা শিশুদের লেকচারের সময় প্রশ্ন করতে নিষেধ করেন, তখন দেখা যায় মেধাবী শিশুরা কম কৌতূহলী হয়ে ওঠে, কারণ তারা ভাবে— কৌতূহল প্রকাশ করলে তাদের রেজাল্টের ক্ষতি হতে পারে। অথচ যারা বেশি প্রশ্ন করে, তারা বিষয়গুলো গভীরভাবে বুঝতে পারে এবং ভালো ফল করে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই বাচ্চাদের প্রশ্ন করার হার দ্রুত কমে যায়। সবচেয়ে ছোট বাচ্চারাও দুই ঘন্টার মধ্যে দুই-তিনটির বেশি প্রশ্ন করে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা প্রশ্ন করা প্রায় ছেড়েই দেয়। প্রাইমারিতে পৌঁছামাত্র তারা চুপ করে বসে শেখার প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। সত্যি হলো— শিশুরা যে স্বাভাবিক কৌতূহল নিয়ে জন্মায়, তা শিক্ষা ব্যবস্থাই ধ্বংস করে দেয়। অনেক শিক্ষানীতি ও প্রশাসনিক কাঠামো শিক্ষার্থীদের আচরণ, নিয়মকানুন ও পরীক্ষার ফলকেই বেশি গুরুত্ব দেয়— শেখা ও কৌতূহলকে নয়।
আমরা অনেকেই— অভিভাবক, শিক্ষক, ছাত্র বা নীতিনির্ধারক হিসেবে— ভুলে যাই যে শিক্ষা শুধু বর্ণমালা শেখানোর জন্য নয়, বরং আত্মবিশ্বাস, ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা ও বিশ্বকে মোকাবিলা করার শক্তি গড়ে তোলার জন্য। তবে আশার কথা, জাতীয় শিক্ষা নীতি (NEP-2020) rote learning বা মুখস্থ-শিক্ষা থেকে দূরে রেখে গভীর উপলব্ধিসম্পন্ন শিক্ষার দিকে নিয়ে যেতে চায়। পাঠ্যক্রম থেকে অপ্রয়োজনীয় বিষয় বাদ দিয়ে আলোচনা, বিশ্লেষণ, সমালোচনামূলক চিন্তাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। শিখন-পদ্ধতি আরও অনুসন্ধানমূলক, অংশগ্রহণমূলক ও অভিজ্ঞতানির্ভর হবে। ৩–৬ বছর বয়সী শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য এই সময়টিকে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়।

শিক্ষা শুধু সমস্যা সমাধান শেখানো নয়— বরং নতুন পথ খুঁজে বের করা, নতুন মান তৈরি করা এবং সীমা অতিক্রম করার শিক্ষা দেওয়া। গবেষণায় দেখা যায়— যখন শিশু জন্ম থেকে প্রি-স্কুল পর্যন্ত কৌতূহল দিয়ে পৃথিবীকে বোঝে, তখন স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর সেই শিশুর পড়াশোনা, গণিত ও আচরণ অন্যদের তুলনায় ভালো হয়। বিশেষ করে আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা শিশুদের ক্ষেত্রে কৌতূহল তাদের সাফল্যের সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে দাঁড়ায়।

এই বাস্তবতা মাথায় রেখে আমি আমার নিজ গ্রামের (মৌতোর, পুরুলিয়া জেলা, পশ্চিমবঙ্গ) একটি “গ্রামীণ বিজ্ঞান কেন্দ্র” প্রতিষ্ঠা করি— বাচ্চাদের বোঝানোর জন্য যে শিক্ষা মানে আনন্দ। শুরুতে শেখাতে গিয়ে বুঝলাম— পুরোদিন একইভাবে লেকচার শুনে বাচ্চাদের মনোযোগ ধরে রাখা অত্যন্ত কঠিন। তাই পাঠ্যসূচি শেখানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো— সেটিকে মজার এবং জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত করা। কারণ সব বাচ্চার মধ্যে একটি সাধারণ বিষয় ছিল— তারা বই পড়তে পছন্দ করত না।

আমি লক্ষ্য করলাম— যখনই তাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে উদাহরণ দেওয়া হয়, তারা শেখার বিষয়ে উৎসাহী হয়ে ওঠে। এখন প্রতি বিকল্প দিনে একটি করে পরীক্ষা-ভিত্তিক কার্যক্রম করা হয়, যাতে তারা অনুভব করতে পারে— বিজ্ঞান মজার বিষয়। ধীরে ধীরে তারা বই খুলতে শুরু করেছে, প্রশ্ন করছে, এবং নীরব ছাত্ররাও বাড়িতে অভিভাবকদের সাথে শেখা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে।

গণিত শেখানোর সময় আমি বাস্তব উদাহরণ ব্যবহার করেছি। ২০টি কল্পিত আপেল ভাগ করার পরিবর্তে, আমি বলেছি— “২০ জন বন্ধুকে দলে ভাগ কর”— এতে তারা সমস্যাটি কল্পনায় দেখতে পেরেছে এবং সঠিক সমাধান পদ্ধতি বুঝেছে। বায়োলজি শেখানোর সময় বলেছি— mutualism মানে দুই বন্ধুর সমান ভাগে শেয়ার করা, আর parasitism হলো সেই বন্ধুর মতো— যে শুধু তোমার খাবার খায়, কিন্তু কখনো নিজেরটা শেয়ার করে না। এগুলো শুনে তারা হেসেছে— কিন্তু মনে রেখেছে।

সুতরাং শেখার প্রক্রিয়াকে যত সহজ, আনন্দদায়ক ও অভিজ্ঞতানির্ভর করা যায়, ততই ভালো। কারণ কোনো কিছু শেখার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হলো— মজা।

এখন সময় এসেছে— বাচ্চাদের নিজেদের শেখার সময়সূচি বানাতে দেওয়া, তাদের পছন্দের বিষয়ে গবেষণা করতে উৎসাহিত করা এবং শিখে তা সৃজনশীল প্রজেক্ট হিসেবে প্রকাশ করতে দেওয়া— সেটা মাটি দিয়ে কিছু বানানো হোক, মডেল হোক, পেপার-মেশে হোক বা প্রেজেন্টেশন।

প্রশংসাও হতে হবে উদ্দেশ্যমূলক— “কাজটা করেছ” বলার চেয়ে “আজ তুমি খুব মনোযোগ দিয়ে চেষ্টা করেছ” বলা বেশি মূল্যবান। মাঝে মাঝে নাচ, খেলা বা গেম-ভিত্তিক বিরতি দিলে শিশুরা আবার মনোযোগ ফিরে পায়। মনে রাখতে হবে— শেখা যেন আনন্দের হয়, চাপের নয়।