তোমাদের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান

ফাইল চিত্র

নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়

বাহাত্তর সালের ষোলই জুলাইয়ের ভোর। এন্টালি এলাকার এক বস্তিতে, বারান্দায় নোংরা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা লোকটির দিকে পুলিশ অফিসার রুনু গুহনিয়োগী একটা দামি সিগারেট বাড়িয়ে ধরতে, সেই লোক লুব্ধ ভঙ্গিতে সেটা নিয়ে নিতেই রুনু বুঝে গেলেন, ইনিই সেই সিএম, মানে চারু মজুমদার। দামি সিগারেটের ওপর সিএমের আকর্ষণের কথা রুনুর জানা ছিল। তাঁর আত্মজৈবনিক বইতে তেমনই লেখা। বারো দিন বাদে, ২৮ জুলাই, কারান্তরালে তাঁর মৃত্যু। অনেকে বলে, হত্যা।

সবটাই মনে পড়লো নাম্বালা কেশব রাও ওরফে বাসবরাজুর মৃত্যুর খবরে। একুশে মে-র এনকাউন্টার ও তার পরের ব্যাপারস্যাপার সকলেই জানেন। এখনকার এইসব সংঘাতের ধরন অনেক অন্যরকম। বামপন্থী দলগুলো আওয়াজ তোলে, এসব হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের ব্যাপারটা ভুলিয়ে দিতেই যেন বলতে থাকে, কেন্দ্রীয় সরকার কেন আলোচনায়
বসছে না ?


অপারেশান গ্রিন হান্ট নামে অভিযানের পরিকল্পনা করেছিলেন পি চিদাম্বরম। তখন তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পরিত্যক্ত হল শেষ মুহূর্তে, ইউপিএ-র চেয়ারপার্সন সোনিয়া গান্ধিকে নাকি পিছিয়ে আসতে অনুরোধ করেছিলেন ন্যাক, ওরফে ন্যাশনাল এডভাইসরি কাউন্সিলের সভ্য, আরবান নকশাল বলে পরিচিত ক’জন বুদ্ধিজীবী। মাওবাদীদের একদিনের আক্রমণে ছত্তিশগড়ের কংগ্রেস নেতৃত্বের অনেকে নিহত হবার পর অবশ্য সংবেদনশীলতার সমস্ত বার্তা বাতাসে উড়ে গেল। গত দশ বছরে মাওবাদীদের সঙ্গে রাষ্ট্রের যুদ্ধ আরও জোরদার হয়েছে।

চারু মজুমদারের সূত্রে বাহাত্তর সালের অবস্থাটা ফিরে দেখা যাক। একাত্তর সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জিতে, বাংলাদেশের জন্মের পর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা তখন এশিয়ার মুক্তিসূর্য অভিধা পেয়েছেন। দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হচ্ছে, বিশ্বে আনবে নতুন দিন/ ইন্দিরা মুজিব কোসিগিন। চিন ও সোভিয়েতের আকচাআকচিতে ইন্দিরা চিনের বিরুদ্ধে থাকবেন, জানা কথাই! এই বাংলায়, জনমত তখন দ্বিধাবিভক্ত। নির্বাচনে, মাথায় ডাণ্ডা মেরে, শোনা যায়, ইন্দিরাপন্থী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় জিতে এসেই নকশালপন্থীদের ঠাণ্ডা করতে উদ্যোগী হলেন। যুক্তফ্রন্টের অন্দরে অনবরত খেয়োখেয়ি আর খুনোখুনি দেখতে দেখতে বাঙালি তখন ক্লান্ত। নকশালরাও নানান উপদলে ভাগ হয়েছে, হয়েই চলেছে।

দলের ভেতরকার দ্বন্দ্বই ধরিয়ে দিল চারু মজুমদারকে, অনেকেই এমন বলেন। কোনও কোনও গোষ্ঠী নাকি আত্মসমর্পণে উদ্যোগী হচ্ছিলেন, কিন্তু চারু মজুমদার চাইছিলেন সবাইকে নিয়ে বসে আলোচনা করতে। কেউ বা বলেন, উনি নিজে আত্মসমর্পণে আগ্রহী বলেই দুর্গাপুরে নিরাপদ আশ্রয়ে যাননি, এমন কি কাছাকাছি সোদপুর অঞ্চলের গোপন ডেরায় না থেকে, রইলেন মধ্য কলকাতার খোলামেলা বস্তিতে। কিন্তু ধরাই যদি দেবেন, তবে তাঁকে মেরে ফেলতে হবে কেন? জীর্ণশীর্ণ মানুষটাকে বাগ মানানো যায়নি কিছুতেই৷ কাজেই, বিপ্লবীদের চিরকালের সেই কথাটাই কি মান্যতা পেয়ে যায় না যে, রাষ্ট্র যাকে ভয় পায়, হত্যা করে তাঁকেই?
সিদ্ধার্থশঙ্কর গর্ব করে বলতেই পারেন, সব নিকেশ করেছি, ভিনরাজ্যে খেদিয়ে দিয়েছি। চারু মজুমদার যে আটটি দলিল লিখেছিলেন, নবপ্রজন্মের নকশালপন্থীরা তা মানতে চায়নি। কৃষকদের জাগরণের চেয়ে আদিবাসীদের অধিকাররক্ষার আন্দোলন আরও বেশি দগদগে, রক্তাক্ত; অনেকদিন থেকেই। শ্রেণীশত্রুর ধারণা সেখানে আলাদা। খনিজ সম্পদ তুলে নিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাশালীরা, অরণ্যের অধিকার হারিয়ে যাচ্ছে আরোপিত আধুনিকতার ধারণায়, এটা একদিকে সত্যি। আবার এও সত্যি, মহারাষ্ট্রে গড়চিরৌলি জেলায় গ্রামের মানুষ এই প্রথম বাস চলাচল করতে দেখছে, দেশ স্বাধীন হবার পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে যাবার পর! ছত্তিশগড়ের অবুঝমাড়ের মতন, সেও তো ছিল মাওবাদী এলাকা।

বস্তার একদা ছিল স্বাধীন রাজ্য। রাজধানী, জগদলপুর। শেষতম কাকাতিয়া রাজা প্রতাপরুদ্র দেবের ভাই এসেছিলেন তেলেঙ্গানার ওয়ারঙ্গল থেকে। দেবী দন্তেশ্বরী বস্তার অঞ্চলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, দন্ত্যেওয়াড়া নামটা সেইভাবে এসেছে। প্রবীরচন্দ্র ভঞ্জদেও ছিলেন শেষ রাজা, ১৯৪৭ সালে ভারতভুক্তির পর আদিবাসী উন্নয়নে অনেক কাজ করে গেছেন তিনি। আজীবন আদিবাসীদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের পক্ষে কথা বলে, নিহত হয়েছেন পুলিশের গুলিতে। ১৯৬৬ সালের ঘটনা। নকশালবাড়ি আন্দোলন আরম্ভের খুব কাছাকাছি সময়; সমীকরণ পাওয়া যায় কি কিছু? নিজেদের খনিজ সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে বাইরে, এই কঠিন সত্যের মধ্যে কিন্তু চিনের চক্রান্ত নেই; সে দেশের বেতার বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ বলে বিজ্ঞাপিত করবে না, চিকেন্স নেক ঘ্যাঁচ করে কেটে দখল করার গল্পও চালানো কঠিন! আদিবাসীদের এই সংগ্রাম প্রতিদিনের সংগ্রাম। অবুঝমাড়ের অরণ্যকে বলা হয় ব্ল্যাক ফরেস্ট। সরকারি অফিসার কি মন্ত্রীশান্ত্রী সহসা সেখানে পা দেন না। মাওবাদীদের নানান দল উপদল এখানেও, কিন্তু তিরুপতি থেকে পশুপতি, মানে দাক্ষিণাত্য থেকে নেপাল অবধি তারা প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছে আদিবাসী উন্নয়নের কথা বলে। নাগরিক ন্যাকামি কী বুদ্ধিজীবী ভাণ নেই এখানে। গরিব দেশের আদিম হিংস্র মানুষের সৎভাবে বেঁচে থাকার হিসেব বুঝে
নেওয়া আছে!

পথঘাটের উন্নতি হয়েছে, বিদ্যুৎ এসেছে কিছু গ্রামে, গত কয়েকবছরে। ওদিকে, বাইরের রাজ্য থেকে উড়ে এসে বসা নেতাদের বলা শ্রেণীসংগ্রামের কথা উড়ে গেছে অনেকেরই মাথার ওপর দিয়ে। তবু, গরীব মানুষরা দেখছে, দল উপদলে তাদের লড়াই বিভক্ত করে রাখার জন্য, অথবা দেশের শহরাঞ্চলে থাকা মানুষদের বোঝানোর জন্য ন্যারেশান তৈরি করার পেছনে অর্থব্যয় না করে নাগরিক সুবিধার পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে।
উন্নয়ন, সেও কি বুলডোজার একরকম? নিজস্বতা নাশ করে সমস্ত জাতিকে যা এক ছাঁচে সমান উচ্চতায় বেঁধে রাখতে চায়? তবু, উঠে আসুক নীচুতলার মানুষরা, উন্নতি হোক দেশের, আমরা নিশ্চয়ই চাইবো!

চারু মজুমদারের কথায় এই লেখা শুরু করার কারণ, এইবার বলি। বাসবরাজুর মৃত্যুর পর, তুরস্কের মাওবাদী দল থেকে যে প্রতিক্রিয়া এসেছে, তাতে চারু মজুমদারের কথাই কিছুটা কিন্তু উদ্ধার করা হয়েছে। বিপ্লবের বিনাশ নেই। বন্ধুরা, ওঠো, জাগো … দুঃখ করার সময় এখন নয়, এইবার আগুন হয়ে জ্বলে উঠতে হবে!
ভিন্ন অর্থে, এও চিরন্তন সত্য। যে স্বপ্ন দেখতে পারে না, স্বপ্ন দেখাতে শেখায় না সহচরদের, সে আদৌ বিপ্লবী নয়। কী জানি, ধনতান্ত্রিক সভ্যতা, সত্যের সংজ্ঞার্থও পাল্টে দিতে পারে কি না!