কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনস্ত ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’ (এনসিআরবি) দেশজুড়ে সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ঘটে চলা অপরাধের ছবি ‘ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া’ শীর্ষক রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে। নিয়মমাফিক ২০২৩ সালের রিপোর্ট পরের বছর সেপ্টেম্বরে প্রকাশের কথা থাকলেও তা প্রকাশিত হলো এ বছরে সেপ্টেম্বরের শেষে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে দেশজুড়ে মহিলাদের সঙ্গে সাড়ে চার লক্ষ অপরাধমূলক ঘটনা ঘটেছে। তার আগের দু’বছরের থেকে এই সংখ্যা বেশি— মোট ৪ লক্ষ ৪৮ হাজার ২১১টি অপরাধের ঘটনা ঘটে ওই বছর। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪ লক্ষ ৪৫ হাজার ২৫৬ এবং ২০২১ সালে ছিল ৪ লক্ষ ২৮ হাজার ২৭৮। এই পরিসংখ্যান তৈরি করা হয় রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির পুলিশ রেকর্ডের ভিত্তিতে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, অভিযোগ দায়েরে বাধা বা ভয়ের কারণে বহু ঘটনাই ধামাচাপা পড়ে যায়। তবে যে অভিযোগগুলি নথিভুক্ত হয়েছে, তার নিরিখে দেখা যাচ্ছে, প্রতি এক লক্ষ মহিলা জনসংখ্যার অনুপাতে অপরাধের হার ৬৬.২ শতাংশ। এর মধ্যেও আবার সবকটি ঘটনায় চার্জশিট দাখিল হয়নি। ৭৭.৬ শতাংশ অপরাধের ক্ষেত্রে চার্জশিট দাখিল হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদীর আমলে সব ধরনের অপরাধ কমেছে বলে তাঁবেদারি আত্মপ্রচার চললেও এনসিআরবি-র রিপোর্টের ফাঁকফোকর দিয়ে কঠিন বাস্তব সামনে চলে এসেছে। দেখা যাচ্ছে, যোগী ও আদিত্যনাথের রাজ্য অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশে মহিলা, দলিত ও তফসিলি অংশের উপর অত্যাচার বেড়েছে। আবার বিজেপি শাসিত মহারাষ্ট্রে বেড়েছে মানব পাচার। দেশজুড়ে শুধুমাত্র পণের দাবিতে অত্যাচার বেড়েছে ১৪ শতাংশ, আর এই কারণেই ৬ হাজারেরও বেশি মহিলাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। বাল্যবিবাহ বেড়েছে ছ’গুণ। দেশের বড় শহরগুলির মধ্যে বাণিজ্য নগরী মুম্বইয়ে আর্থিক প্রতারণার ঘটনা সব থেকে বেশি। দেশে কার্যত প্রতি সেকেন্ডে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অপরাধ ঘটে গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিযোগ দায়ের করা হয় না বা সঙ্ঘ-বিজেপি আশ্রিত দুষ্কৃতীরা ভয় দেখিয়ে দাবিয়ে রাখে। একঘরে করে দেয় নির্যাতিত-নিপীড়িতদেরই। আবার বিজেপি সরকারের পুলিশ অভিযোগ দায়েরও করতে দেয় না। অভিযোগ দায়ের হলেও বিচার হয় না, দোষী সাব্যস্তের হারও তাই অত্যন্ত কম। পাঁচ বছরে দিনমজুরদের আত্মহত্যা বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। এই রিপোর্টই মোদী সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতার আরও এক প্রমাণ হয়ে উঠেছে। তফসিলি সম্প্রদায়ভুক্তদের বিরুদ্ধে অপরাধের হার ২০২২ সালের (১০,০৬৪) থেকে ২৮.৮ শতাংশ বেড়ে ২০২৩ সালে ১২,৯৬০ হয়েছে। সামগ্রিক অপরাধের হারও ২০২২ সালের (৯.৬ শতাংশ) থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ১২.৪ শতাংশে পৌঁছেছে।
বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধে নিজেদের জায়গা ধরে রেখেছে। এই রিপোর্টেও শীর্ষে উজ্জ্বল যোগী রাজ্য। সেখানে মহিলাদের বিরুদ্ধে বছরভর ৬৬ হাজার ৩৮১টি অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছে। এরপর তালিকা যে দু’টি রাজ্য রয়েছে, সেগুলি বিজেপি শাসিত মহারাষ্ট্র (৪৭.১০১) এবং রাজস্থান (৪৫,৪৫০)। তারপরই পশ্চিমবঙ্গ (৩৪,৬৯১) এবং বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশ (৩২,৩৪২)। মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধে দেখা যাচ্ছে, গার্হস্থ্য হিংসার অভিযোগ সব থেকে বেশি। পাশাপাশি অপহরণ, পণের দাবিতে অত্যাচার এবং হত্যা, ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টার মতো সমস্ত ধরনের নৃশংস অত্যাচার দেশজুড়ে হয়ে চলেছে। পকসোয় ৪০ হাজারের বেশি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। অর্থাৎ শিশুদের উপরও ভয়াবহতার হার ক্রমশ বাড়ছে। এমন দূরবস্থার মধ্যে গালভরা নাম দিয়ে মহিলা সুরক্ষার বিজ্ঞাপন দিলেও মোদীর আমলে এই সংক্রান্ত ২১ লক্ষ ৮৪ হাজার ৭৫৬টি মামলা ঝুলে রয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে নানা বয়সের মেয়েদের উপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার হলেও লোক দেখিয়ে গ্রেপ্তারি ছাড়া আর কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না। এনসিআরবি-র রিপোর্টেও সেই নির্মম সত্য প্রকাশিত হয়েছে যে, মোদী-শাহের আমলে উমর খালিদ, শারজিল ইমামরা বিনা বিচারে বছরের পর বছর আটকে থাকেন জেলে এবং বিলকিস বানোর ধর্ষকদের বেকসুর খালাস করে মালা পরিয়ে সম্বর্ধনা দিয়ে সরকারি মঞ্চে তোলা হয়।
এনসিআরবি-র রিপোর্টে মোদীর আমলে মহিলারা কেমন অবস্থায় আছেন, তা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।