স্বপনকুমার মণ্ডল
আজ যখন বাঙালির ভাষাপ্রেমের সংকট নিয়ে নানারকম কথা শোনা যায়,তখন একজন অবাঙালি বাংলাভাষাপ্রেমীর কথা বিশেষ ভাবে স্মরণীয় হয়ে ওঠে । বাংলাভাষার জন্য তাঁর অবদান অবিস্মরণীয় । বিগত বছরের (২০২৪) শেষের দিকে ১০ নভেম্বর সেই মহাপ্রাণ ইহলোক ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তিনি বাংলাভাষাপ্রেমী কবি ও অনুবাদক উইলিয়াম রাদিচে (১৯৫১-র জন্ম) । সেদিন আবার বাংলার বিশিষ্ট নাট্যকার ও অভিনেতা মনোজ মিত্রের প্রয়াণ ঘটে । তার মধ্যেও উইলিয়ামের অভাববোধ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্যে বেরিয়ে আসে। মৃত্যুর আগে ২০১২-র মে মাসে লণ্ডনের পথে চলন্ত গাড়ির ধাক্কায় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে দীর্ঘ একদশকের বেশি সময় ধরে তাঁর কলম একপ্রকার অচল হয়ে পড়ে । চিকিৎসকের পরামর্শই ছিল একাডেমিক কাজ না করার । তাঁর মধ্যেও তাঁর কবিতা লেখা চললেও বাংলাভাষার চর্চা নীরব থেকে যায় । অথচ তিন দশকের বাংলাভাষার চর্চায় তাঁর আত্মনিবেদিত প্রকৃতি কখনও হলুদ হয়ে ওঠেনি । সেখানে উইলিয়াম রাদিচের আত্মিক সংযোগ বিস্ময়কর । সুদূর ইংল্যাণ্ডে থেকে বাংলাভাষাকে ভালবেসে যেভাবে তিনি সযত্নে লালন করে বিদেশি ভাষাকে আত্মস্থ করে নিয়েছেন, তা শুধু অসাধারণ নয়ই, বিস্ময়করও বটে । তাঁর মতো করে আর কোনও বিদেশি বাংলাভাষাকে ভালবাসেনি। অন্যেরা যেখানে গবেষণার কাজে বা অনুবাদে অথবা অন্য কোনও প্রয়োজনবোধে বাংলাভাষা শিখেছেন, সেখানে উইলিয়াম নিজে থেকে ভাষাটিকে আয়ত্ম করে বাঙালির পরম আত্মীয় হয়ে উঠেছেন । সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা জীবনান্দ দাশের লেখা পড়ে নয়, বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধই তাঁকে বাংলাভাষার প্রতি আকৃষ্ট করে তুলেছিল । মাতৃভাষার আন্দোলন থেকে সে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাণপ্রবাহে তাঁর প্রাণের সংযোগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি তীব্র অনুরাগই সেখানে রসদ জুগিয়ে চলে । সেখানে উইলিয়াম ১৯৬৯-এ আঠারো বছর বয়সে অক্সফোর্ডের ম্যাগডালেন কলেজে ইংরেজি নিয়ে পড়া শুরু করতে না-করতেই ভারতে চলে আসেন এবং হিমাচল প্রদেশের লরেন্স স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর সিমলা পাহাড়ি অঞ্চল ছেড়ে দিল্লি হয়ে দিনকয়েকের জন্য কলকাতায় এসেছিলেন। কুড়ি বছর বয়সে তাঁর বাংলাভাষা শেখা শুরু হয় । তবে তা প্রথাগত শিক্ষা ছিল না, একান্তভাবেই স্বশিক্ষিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উইলিয়ামের ঠাকুরদাদা এবং কাকা এদেশে আইসিএস ছিলেন । স্বাভাবিক ভাবেই এদেশের পাশাপাশি ভাবী বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক কথাই তিনি ছোটবেলা থেকে শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল । বাংলাভাষা শেখার সেই আকুতি দেশে ফিরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম এ পাশ করার পর জনৈক বন্ধুর কথায় আর তীব্রতা লাভ করে । লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (SOAS)-এ বাংলায় গ্রাজুয়েশনে ভর্তি হন এবং সেখানে বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের কাছেই তাঁর বাংলাভাষা ও সাহিত্যের পরিচয় নিবিড় হয়ে ওঠে । মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখের লেখার সঙ্গে তাঁর পরিচিতি ঘটে । একদিকে চলে তাঁর বাংলাভাষা চর্চার নিবিড় আয়োজন, অন্যদিকে সেই ভাষার অমূল্য সম্পদকে ছড়িয়ে দেওয়ায় তাঁর আন্তরিক উদ্যোগ সক্রিয়তা লাভ করে। রাদিচের সেই বাংলাভাষাপ্রেমী প্রকৃতিই বলে দেয় তাঁর সদিচ্ছার নৈবেদ্য কত গভীর শ্রদ্ধাজাত, কত আত্মীয়তাবোধে আন্তরিক।
পারিবারিক ভাবেই উইলিয়াম ভাষা শেখার আনুকূল্য পেয়েছিলেন । তাঁর মা বেটি রাদিচেই ছিলেন স্বনামধন্য অনুবাদক। মায়ের সাহচর্যে উইলিয়ামের বাংলাভাষার প্রতি তীব্র অনুরাগ স্বাভাবিকভাবেই লক্ষ্যভেদী হয়ে ওঠে । সেখানে তাঁর বাড়তি ভাষা শেখার কোনও বালাই ছিল না, ছিল না শখের বেসাতি। সত্য ও নিষ্ঠায় ভাষাটিকে বুঝে নেওয়ার জন্য তাঁর সদিচ্ছায় সুগভীর অধ্যবসায় ও লক্ষ্যভেদী আত্মসংযোগ বিস্ময়কর । অক্সফোর্ডের ইংরেজির কৃতী ছাত্রটির অচিরেই কবিপ্রতিভার প্রকাশ ঘটে । উলিয়ামের প্রথম কবিতার বই Eight Sections প্রকাশিত ১৯৭৪-এর মাঝামাঝি । অর্থাৎ উইলিয়ামের নিজের ভাষায় সাহিত্যচর্চার সঙ্গেই তাঁর বাংলাভাষার শেখাও চলতে থাকে । শুধু তাই নয়, তাঁর বাংলাভাষার প্রতি তীব্র অনুরাগ ক্রমশ প্রসারিত হয় । এজন্য সোয়াস(SOAS)-এ বাংলায় গ্রাজুয়েশন করে পোস্ট-গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা করার পর আশির দশকের গোড়ায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্য নিয়ে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরীর অধীনে ডক্টরেট (ডিফিল) শুরু করেন । সেই সময় তিনি একটি স্কুলে পড়াতেন। তাঁর গবেষণা শেষ হয় ১৯৮৭-তে । অন্যদিকে উইলিয়াম রাদিচে বাংলাভাষা শিক্ষাকেই তাঁর উচ্চতর কর্মজীবনের সোপান করে তোলেন । ১৯৮৮-এ তিনি তাঁর নিজেরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সোয়াসের লেকচারার নিযুক্ত হন । ১৯৯৯ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেখানে বাংলার বিভাগীয় প্রধান ছিলেন তিনি । তখন তাঁর পঞ্চাশ বছর বয়স । সেই বয়সে আরও বেশি কাজ করার জন্য সেখানে কর্মজীবনে ইতি টানায় মনস্থির করেন । আবার তাঁরই অধীনে পিএইচডি করা তাঁর দুই ছাত্র সোয়াসের বাংলা বিভাগের শিক্ষকতায় সামিল হয়েছেন । তাঁর মধ্যে একজন হান-রুথ টমসন বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে একটি বই লিখেছেন। সেদিক থেকে বিদেশে বাংলাভাষার বিস্তারে উইলিয়ামের আন্তরিকতায় আত্মীয়তার ছায়া ক্রমশ দীর্ঘস্থায়ী কায়া বিস্তার করে । সেক্ষেত্রে বিদেশিরা যাতে সহজে বাংলাভাষা শিখতে পারেন, তার জন্য বাংলা শেখার বইও লিখেছেন উইলিয়াম । তাঁর সেই বইটি ‘Know yourself Bengali’ (১৯৯৪) তাঁর বাংলাভাষা বিস্তারের অসাধারণ প্রয়াসও তাঁকে স্বতন্ত্র করে তোলে । আর কোনও বিদেশি বাংলাভাষাপ্রেমী স্বতন্ত্র প্রতিভাদীপ্ত হয়েও এভাবে বাংলা শেখার বই লেখেননি বা প্রকাশ করেননি। অন্যদিকে তাঁরই উদ্যোগে সোয়াস-এ বাংলা শেখার নতুন কোর্স শুরু হয়। সেই ‘Modern Bengal : The Evolution of Society and Culture from 1690 to the Present Day’ কোর্সটি সেখানে সাফল্য লাভ করে । অন্যদিকে দেশবিদেশে রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে বক্তৃতার মাধ্যমে প্রচারের আলোতে ছড়িয়ে দিয়েছেন, তার মধ্যেও তাঁর বাংলাভাষার প্রতি গভীর প্রেম বেরিয়ে পড়েছে ।
বাংলাভাষার অমূল্য সম্পদের পরশ দিতে উইলিয়াম রাদিচের নিরন্তর প্রয়াস প্রথম থেকেই সক্রিয় হয়ে ওঠে । বিশেষ করে কবি রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে চেনানোর প্রতি তাঁর সক্রিয় উদ্যোগ দারুণ ভাবে সাড়া ফেলে । এর আগে নোবেল পুরুস্কারের ধন্য ‘গীতাঞ্জলি’র আধ্যাত্মিক বা অতীন্দ্রিয় কবিতাগুলি প্রচারের ফলে রবীন্দ্রনাথের কবিত্বের আধ্যাত্মিক চেতনাই বিদেশে প্রচার লাভ করেছিল । সেখানে রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী চেতনার বিচিত্র আয়োজনে অসংখ্য কাব্য থেকে বিচিত্র আঙ্গিকের ও নানা স্বাদের বাছাই করা ৪৮টি অনুবাদিত কবিতার একটি সংকলন ‘Rabindranath Tagore : Selected Poems’(১৯৮৫) প্রকাশ করে তিনি পশ্চিমা বিশ্বের মাটিতে রবীন্দ্রচর্চাকে নতুন করে প্রাণিত করেন । সেক্ষেত্রে সংকলনটি যেমন পাশ্চাত্যের কাছে রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে আবিষ্কারের আনন্দ বয়ে আনে, তেমনই উইলিয়াম রাদিচের অনুবাদক পরিচিতিকে জনপ্রিয় করে তোলে । সেক্ষেত্রে অনুবাদকের ভাষা শিক্ষা কীভাবে সাধনায় পরিণত হয়েছিল, তার পরিচয়ও তার মধ্যে উঠে এসেছে । রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করার জন্য তিনি শান্তিনিকেতনে এসে থেকেছেন, কবি হিসেবে নিরন্তর গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন, তেমনই বাংলাভাষার সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন । সেখানে লরেন্স স্কুলের হেডমাস্টার মেজর সোম দত্ত রবীন্দ্রনাথকে ‘বাড়াবাড়ি’র মনে হওয়ায় তাঁর থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়ে তাঁকেই আরও নিষিদ্ধ ফলের আকর্ষণের মতো আকৃষ্ট করে তোলে । এজন্য তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে তাঁর রবীন্দ্রনাথকে চেনার পাঠ শুরু হলে অচিরেই উইলিয়াম রবীন্দ্রনাথের কাব্যের প্রতি গভীর ভাবে অনুরুক্ত হয়ে পড়েন। সেক্ষেত্রে তাঁকে গভীর ভাবে জানার জন্য রবীন্দ্র কবিতার অনুবাদের কাজ চলাকালীন সময়েই ১৯৮২-তে তিন মাসের জন্য উইলিয়াম সপরিবারে শান্তিনিকেতন এসে ছিলেন। পল্লিবাংলার গ্রামীণ পরিবেশের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে গভীর ভাবে অনুধাবন করতে চেয়েছিলেন উইলিয়াম । রবীন্দ্রনাথকে যত বুঝেছেন, ততই তাঁর বিস্তৃতি ও গভীরতা তাঁকে বিমুদ্ধ করেছে । এজন্য তাঁর অজানা খনির পরশমণির পরিচয় দিতে নতুন করে রবীন্দ্রনাথকে অনুবাদের মাধ্যমে আবিষ্কার করে প্রচারের আলোতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তাঁর আয়োজন প্রয়োজনকে ছাপিয়ে চলে । রবীন্দ্রনাথের অমূল্য রচনার একের পর এক অনুবাদ প্রকাশ করেন উইলিয়াম । সেক্ষেত্রে তাঁর প্রথম অনুবাদিত রবীন্দ্রনাথের কবিতার সংকলনটি শুধু জনপ্রিয়তা পায়নি, তাঁর অনুবাদও উচ্চ সমাদর লাভ করে । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৮৬-তে উইলিয়াম রাদিচে আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন ।
অন্যদিকে, কবিতার পর উইলিয়াম রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের অনুবাদে সক্রিয় হয়েছেন । তাঁর ফসল ‘Rabindranath Tagore : Selected Short-Stoies’(১৯৯১)। সেটি কবিতার সঙ্কলনের মতো জনপ্রিয়তা না পাওয়াও পাঠকসমাদরের জন্য তার আরও একটি পরিমার্জিত সংস্করণ করেন ১৯৯৪-তে। শুধু তাই নয়, ‘Kabuliwalla: Stories’(২০১১) নামে আরও একটি রবীন্দ্রনাথের গল্পের অনুবাদিত সংকলন প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের ‘কণিকা’, ‘লেখন’ ও ‘স্ফুলিঙ্গ’ প্রভৃতি কাব্যের ছোট ছোট কবিতারও অনুবাদ করে একটি সংকলন ‘Particles, Jottings, Sparks ; The Collected Brief Poems of Rabindranath Tagore’ (২০০০) নামে প্রকাশ করেছেন উইলিয়াম । শুধু তাই নয়, তিনি রবীন্দ্র নাটকেরও অনুবাদে সক্রিয় হয়েছেন । ‘ডাকঘর-এর অনুবাদ ‘Rabindranath Tagore : The Post Office’(১৯৯৫), ‘তাসের দেশ’-এর অনুবাদ ‘Card Country’(২০০৮) এবং ‘দেবতার গ্রাস’-এর অনুবাদ ‘Snatched By The God’(২০০৮) প্রভৃতি তাঁর অনন্য পরিচয়। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের গল্প বা নাটকের চেয়ে কবিতার অনুবাদই যে তাঁর পক্ষে শ্রেয় এবং লক্ষ্যভেদী হয়ে উঠবে, নিজে কবি হিসেবে তা উইলিয়াম গভীর ভাবে অনুধাবন করেছিলেন । শুধু তাই নয়, সেদিক থেকে তখন তাঁর রবীন্দ্র রচনার সবচেয়ে সাড়া জাগানো অনুবাদটি বাকি ছিল । সেটি রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষে (২০১১) প্রকাশিত ‘Rabindranath Tagore : Geetanjali’। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের বাংলা ‘গীতাঞ্জলি’ আর তাঁর ইংরেজিতে অনুবাদিত ‘গীতাঞ্জলি’ (‘Song Offerings) এক নয় ।
উইলিয়াম রাদিচের মনে হয়েছিল ১৯১২-তে ইংল্যাণ্ডে যাওয়ার সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতা ও গানের ইংরেজি অনুবাদে যেভাবে ‘গীতাঞ্জলি’কে রূপান্তর করে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা তাঁর কবিসত্তাকে তুলে ধরার পক্ষে যথাযথ ছিল না। শুধু তাই নয়, সেক্ষেত্রে ডব্লিউ বি ইয়েট্সও বাংলা না জানায় রবীন্দ্রনাথের অনুবাদের সম্পাদনা করতে গিয়ে তার মাজাঘষা থেকে রবীন্দ্রনাথের ক্রম পরিবর্তন করে তার সুবিচার করতে পারেননি । এজন্য উইলিয়াম নিজেই তার অনুবাদে সামিল হয়ে অসাধারণ একটি স্বতন্ত্র অনুবাদের মাধ্যমে কবি রবীন্দ্রনাথকে পাশ্চাত্যের মাটিতে নতুন করে তুলে ধরেছেন । এ বিষয়ে গোলাম মুরশিদ উইলিয়াম রাদিচের ‘দীর্ঘ দুরুহ পথ : বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পাঁচটি বক্তৃতা’(২০১৬) বইয়ের ভূমিকায় তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন । তাঁর কথায় : ‘কিন্তু ১০০ বছর পর ২০১২ সালে উইলিয়াম রাদিচে মূলের ক্রম ফিরিয়ে আনেন এবং রবীন্দ্রনাথের মূল অনুবাদের পাশাপাশি আধুনিক ইংরেজিতে রচনাগুলোর পদ্যানুবাদও প্রকাশ করেন। ফলে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির মাধ্যমে পাঠকদের হৃদয়ে যে রস সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, প্রথমবারের মতো পাঠকেরা তার স্বাদ পেলেন রাদিচের অনুবাদে।‘ সেক্ষেত্রে উইলিয়ামের অনুবাদ যে মূলানুগ বা আক্ষরিক ছিল না, তা একান্ত ভাবেই তাঁর আত্মিক সংযোগের প্রয়াস. সেকথাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথকে তিনি যেভাবে আত্মস্থ করে বুঝেছিলেন, তারই সফল রূপায়ণ করে তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’র মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কবিসত্তাকে নতুন করে চেনাতে চেয়েছিলেন । বইটির ভূমিকার শিরোনাম ‘Geetanjali Reborn’। সেক্ষেত্রে উইলিয়ামের অনুবাদটি নিছক Translation নয়, তা হয়ে উঠেছে Transcreation । ভূমিকাতেই সেকথাই স্পষ্ট করে তুলেছেন । এজন্য তাঁর অনুবাদ নন্দিত হয়েও বিতর্কে জড়িয়েছে । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উইলিয়াম রবীন্দ্রনাথের কবিসত্তার বহুমাত্রিক পরিচয়কে নিবিড় করতে চেয়েছিলেন। সেখানে তাঁর মধ্যে বাংলাকেও তুলে ধরার চেতনাও সক্রিয় ছিল। ‘বইয়ের দেশ’(অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০০৯)-এর সাক্ষাৎকারে উইলিয়াম জানিয়েছেন : ’হয়তো আমি সচেতনভাবেই রবি ঠাকুরের মানবিক এবং ধ্রুপদি দিকগুলির উপর বেশি জোর দিয়েছি। তাঁর প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনাটাই ছিল উদ্দেশ্য । তাই ১৯৮৫ সালে প্রথম প্রকাশিত পেঙ্গুইন সংস্করণে এবং পরবর্তী বহু পুনর্মুদ্রণে আমি ‘গীতাজ্ঞলি’ থেকে মাত্র একটি কবিতা রেখেছি এবং সেটাও ‘গীতাঞ্জলি’র প্রচলিত ধারার কবিতা নয়।……আমি একটু অন্যরকম কবিতাই বেছেছিলাম। কবির সবক’টি দিকই যাতে ফুটে ওঠে, যাতে সামাজিক দিকগুলির সঙ্গে বাংলা দেশ জড়িয়ে থাকে, বিভিন্ন ট্র্যাডিশন, প্রাচীন সংস্কৃতি, কালিদাসের প্রভাবে লেখা কবিতা ইত্যাদি বিভিন্ন দিকে লক্ষ রেখেছিলাম আমি । আমি সেই সব কবিতাই রেখেছিলাম যা তাঁকে নতুন ভাবে গুরত্ব এবং বিশ্বাসযোগ্যতা দিতে সক্ষম। ‘কোনও জাতির পরিচয়ে তার নিজস্ব ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ তার সাহিত্য । সেই সাহিত্যের পরিচয়ে উইলিয়ামের আত্মিক যোগ ও আন্তরিক অনুবাদ প্রয়াসের লক্ষ্যেই তাঁর বাংলাভাষাপ্রেম প্রকট হয়ে উঠেছে । অন্যদিকে নিজের ভাষায় যশস্বী কবিপ্রতিভা থাকা সত্ত্বেও যেভাবে তাঁর আত্মত্যাগের সোপানে বাংলাভাষার অমূল্য সম্পদের প্রচার-প্রসারে আত্মনিবেদিত প্রকৃতি ক্রমশ সবুজ হয়ে উঠেছে, তাতেই অদ্বিতীয় ‘অবাঙালি বাঙালি’র পরিচয় প্রকট মনে হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উইলিয়াম রাদিচে রসিকতা করে নিজেকে ‘অবাঙালি বাঙালি’ বলেছেন ।
অন্যদিকে, উইলিয়ামের অনুবাদের পরিসর নানা বিষয়ে ক্রমশ বিস্তার লাভ করে । বাংলা শিশুসাহিত্যের অনুবাদও করেছেন তিনি । উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘টুনটুনির বই’ ও ‘বোকা বাঘ’ তাঁর অনুবাদে হয়েছে ‘The Tailor Bird’s Book’ ও ‘The Stupid Tiger and othe Stories’ (১৯৮১) । অন্যদিকে ভারতের বিভিন্ন ধর্মীয় পুরাণের অনুবাদের প্রায় ৮০০ পৃষ্ঠার মহার্ঘ সংকলন ‘Myths and Legends of India’(২০০১)-এ তাঁর অসামান্য অবদান অনস্বীকার্য । শুধু তাই নয়, সেক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালির প্রতি তীব্র অনুরাগ নানাভাবে আবর্তিত হয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিয়ে তিনি শুধু গবেষণাই করেননি, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’কেও স্বকীয় ভাবে ‘The Poem of the Killing of Meghnad’(২০১০) নামে অনুবাদ করে পাশ্চাত্যের পাঠকের দরবারে হাজির করেছেন । এটিও তাঁর বাংলা সাহিত্যের প্রতি মহার্ঘ নিবেদন । ইতিপূর্বে তা কোনও বিদেশি অনুবাদ করে প্রচারের আলোতে আনেননি। এজন্য বাঙালি তাঁর কাছে ঋণী ও কৃতজ্ঞ । অন্যদিকে স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়েও উইলিয়াম ভেবেছিলেন । তার পরিচয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থেই(১৯৯৮) প্রতীয়মান । সবদিক থেকে মনেপ্রাণে তাঁর মতো আরও কোনও বিদেশি বাংলা ও বাঙালিকে আপন করে নেননি। উইলিয়াম রাদিচে যেভাবে বাংলাভাষার আভিজাত্যকে তার সাহিত্যের অনুবাদ থেকে সেই ভাষার বিস্তারের জন্য ভাষাশিক্ষার বই রচনা, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার নতুন পাঠক্রম চালু করা থেকে গবেষণা করানো, দেশবিদেশের বক্তৃতা প্রদান ও বাংলাভাষা শিক্ষা ও গবেষণায় আত্মনিয়োগ করে নিজেকে সঁপে দিয়ে সুদীর্ঘ কাল জীবনের অমূল্য সময় ব্যয় করেছেন, তাতে তাঁর স্বকীয় প্রতিভার মূলধনও সামিল ছিল । এজন্য তাঁর কবিপ্রতিভা তাঁর অনুবাদকে আলো ছড়িয়ে অনুবাদক পরিচিতিকে জনপ্রিয় করলেও সেই কবি-পরিচিতিই তুলনায় ম্লান হয়ে পড়ে । অথচ উইলিয়ামের যশস্বী কবিপ্রতিভার পরিচয় বিচিত্র অনুবাদের মধ্যেও বিস্তার লাভ করে । তার মধ্যেই তাঁর দশটি কাব্য প্রকাশিত হয় । শুধু তাই নয়, দুর্ঘটনায় শিকার হওয়ার পরে অনুবাদচর্চায় বিরতি এলেও স্বকীয় কবিসত্তায় তাঁর লেখনী সক্রিয় ছিল । অথচ তাঁর সেই অনির্বাণ কবিসত্তাকে সহচর করে বাংলাভাষার প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন, ভাবা যায় । আসলে উইলিয়াম রাদিচে বাংলাভাষার মধ্যে অবিরত নিজেকে খুঁজে ফিরেছেন। এজন্য বাংলাভাষার সঙ্গে তাঁর সুগভীর প্রেমই তাঁকে বাঙালির পরমাত্মীয় করে তুলেছে । তাঁর সেই শ্রদ্ধার সম্পর্কই তাঁর বাংলাভাষা থেকে বাঙালির সঙ্গে একাত্মতা গড়ে তুলেছে । সেই আত্মীয়তার সম্পর্ককেও উইলিয়াম প্রকট করে ব্যক্ত করেছেন।
আসলে তলিয়ে দেখলেই ফলিয়ে বলা যায় । সেখানে উইলিয়ামের বাংলাভাষার তৃণমূল স্তরে ‘ন্যাটিভের’ সঙ্গে একাত্ম হতে গিয়ে ভাবের সঙ্গে ভাষার হরগৌরীয় সম্পর্কেই আয়ত্ত করেননি, বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গেও নিজেকে অবিচ্ছিন্ন করে নিয়েছেন । এই একাত্মতাই তাঁকে বাঙালির পরমাত্মীয় করে তুলেছে । এজন্য নিজেকে স্বতন্ত্র রাখার আভিজাত্য বা মূল্যায়নের আধিপত্যবোধ কোনওটাই তিনি আমল দেননি। উল্টে বাঙালির সঙ্গে একাত্মতাবোধে নিজেকে সপে দিয়েছেন উইলিয়াম রাদিচে। জীবনানন্দ দাশের জন্মশ্তবর্ষে (১৯৯৮) ‘দেশ’ পত্রিকায় জীবনানন্দ দাশ সংখ্যায় লেখার আমন্ত্রণে তিনি জীবনানন্দকে নিয়ে প্রবন্ধ না লিখে খোলা একটি চিঠি লিখেছেন । তাতে পরতে পরতে জীবনানন্দ দাশের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশিত হলেও তাঁকে তাঁর পূর্বসূরি কবি মনে হয়েছে । সেজন্য তাঁর শ্রদ্ধার সঙ্গে আন্তরিকতার নৈকট্যবোধ নিবিড়ভাবে উঠে এসেছে । ‘দেশ’=এ (২৬ ডিসেম্বর ১৯৯৮) প্রকাশিত চিঠিটির শেষে উইলিয়াম রাদিচে লিখেছেন : ‘আপনি পথ না দেখালে আমার পক্ষে রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কবিতার শাখা প্রশাখায় বিচরণ করা সম্ভবপর হত না। আপনার জন্যই পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের কবিদের আমি আত্মীয় জ্ঞান করতে পারি (মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ আমার গুরুস্থানীয়, বান্ধবস্থায়ীয়ও বটে===কিন্তু আত্মীয় নন)।
এবং সেজন্যই আমার মনে হয় আমি আপনাকে খুব চিনি===যদিও আপনার মৃত্যুর সময় আমার বয়স মাত্র তিন, যদিও আপনার কবিতার ভাষা আমি শিখতে শুরু করি কুড়ি বছর বয়সে । এবং সেজন্যই, আমাকে যখন আপনার ওপর প্রবন্ধ লেখার কথা বলা হয়, তখন আমার ইচ্ছে হয় একটা কবিতা লিখি, অথবা এরকম একটা চিঠি ।
আপনারই
উইলিয়াম’
সেখানেই শেষ নয় । বাঙালির সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার পরশ অবারিত ও অবিরত। ২০০৪-এর ২৪ মার্চ শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরি হওয়ার পরে দেশ জুড়ে যে হৈচৈ পড়ে যায়, বিষণ্ণতার পরিসর তৈরি হয়, তাতেও তাঁর সেই আত্মীয়তার সংযোগ আরও নিবিড়তা লাভ করে । যেন তাঁরই একান্ত আপনজনের দুর্বিষহ শোকের শরিক হয়ে উঠেছেন উইলিয়াম । অথচ নোবেল চুরির চেয়ে তাঁর মনের শান্তিনিকেতনের ভয়মুক্ত উদার হাতছানির পরিসরকে রক্ষা করাই তীব্র আবেদনক্ষম হয়ে ওঠে । তাঁর ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ নিবন্ধে(আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩ এপ্রিল ২০০৪) ১৯৮২-র অভিজ্ঞতার কথা ফিরে ফিরে এসেছে । সেখানে শান্তিনিকেতনের নোবেলের চাইতেও বারে বারে গিয়ে মুক্তির আনন্দের হাতছানি পাওয়া পরশমণিই তাঁর কাছে অমূল্য মহার্ঘ মনে হয়েছে । কেননা তার মধ্যেই উইলিয়াম রবীন্দ্রনাথের আসল সৌরভ খুঁজে পেয়েছিলেন। তাঁর কথায় : ‘সেই বোধটাই রবীন্দ্রনাথের চেতনা===’এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয় ।‘ আজ একটাই জিনিস দেখার। শান্তিনিকেতনে এই বোধটাই যেন বিপন্ন না হয়, চোরেরা ওই বোধকে বিপন্ন করতে পারে না। কিন্তু চোরের ভয়? তস্করের ভয় ? সন্ত্রাসবাদের ভয়? এই ভয়গুলোই তো স্বাধীনতার ওঁই চেতনাকে, ওঁই বোধকে ধ্বংস করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
শান্তিনিকেতনের তাই তার পরম নিশ্চিন্ত নির্ভার ব্যক্তিস্বাধীনতা আর ব্যক্তস্বাতন্ত্র্যেই হয়ে থাকুক—চিত্ত যেথা ভয়শূন্য !’ বিষয় থেকে বিষয়ীর একাত্মতা থেকে উইলিয়াম রাদিচে বাংলাভাষাকে আয়ত্ম করে বাঙালির আপনজন হয়ে উঠেছিলেন, তা তাঁর আত্মিক যোগেই প্রতীয়মান । তাঁর ভাবলোকে বাঙালির সঙ্গে একাত্মতাবোধে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই বাংলাভাষার বিস্তার থেকে নিজেই বাঙালি হয়ে উঠেছিলেন।
শুধু তাই নয়, বাঙালির মননের আলো দিয়ে বিদেশি অবাঙালিদের পথ দেখাতে চেয়ে নিজেকে যেভাবে সঁপে দিয়েছিলেন, শুধু বিদেশিদের মধ্যেই নয়, বাঙালিদের মধ্যেও তাঁর দোসর মেলানো দুরূহ। সেদিকে থেকে উইলিয়াম রাদিচে বাংলাভাষার ধারক-বাহকই ছিলেন না, বিদেশি মুখপাত্র থেকে মুখপত্র হয়েছেন, সর্বোপরি পাশ্চাত্যে বাংলার দূত থেকে মুখ হয়ে উঠেছেন, অবাঙালি হয়েও সেরা বাঙালি হয়েছেন । শুধু তাই নয়, তাঁকেই অমর একুশের সেরা ঠিকানা মনে হয় ।