যেচে মান, কেঁদে সোহাগ

প্রতীকী চিত্র

নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়

উৎসব আপাতত সমস্তই সমাপ্ত, ছোট হয়ে আসছে দিনগুলো। ফসল তোলার বেলা, কবি যে অর্থেই বলে থাকুন; আমরা হিসেবনিকেশ করি কোন পণ্যে কেমন বাণিজ্য হল, জিডিপিতে তার কেমন মূল্য। সমস্ত দেশের ক্ষেত্রে দেখলে, দীপাবলিতে কত উপহার দেওয়া-নেওয়া হল, সেও বেশ আলোচনার ব্যাপার।

সামাজিক মাধ্যমে আমলাতান্ত্রিক কৌতুককথা দেখছি বেশ ঘোরাফেরা করছে নানান আলোচনায়। আইএএস পর্যায়ের অবসরপ্রাপ্ত কেউ একজন হয়তো গভীর বেদনায় নিজের উপলব্ধি কৌতুকের আবরণে ব্যক্ত করেছেন। আরেক আইএএসের আবেগে তা এসে পড়েছে আমজনতার মধ্যে। একটি গাধার গল্প। ঈশপের উপকথা থেকে ঈষৎ রূপান্তরিত হয়ে সে এল, নাকি উঠে এসেছে জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে, জানি না। বেচারির কষ্টটা আমরা অনেকেই হয়তো বুঝবো!


অবসর নেবার পরে আমলা ভদ্রলোক অনুভব করলেন, তিনি একজন ভারবাহী গাধাই ছিলেন। অনেক উপহার পেতেন দেওয়ালিতে। এখন পান না কিছুই। মনে হল সেই গাধাটাকে, পিঠে অনেক পুতুল টুতুল চাপিয়ে যখন সে যেত গ্রামগঞ্জের পথ দিয়ে, তখন বিস্তর লোকজন ভক্তিভরে প্রণাম করতো, সেলাম জানাত। সেই পুতুলের বোঝা নামিয়ে যখন সে শাকসবজির বস্তা নিয়ে ফিরছে, তখন কেউ তো আর অভিবাদন কি প্রণাম ট্রনাম করে না! গাধা বুঝল, প্রণাম ইত্যাদি আসলে তার পিঠের ওপর থাকা পুতুলগুলোর জন্যে। একজন আমলার জীবনে যা হয়। যখন ক্ষমতায় থাকেন, তখন তাঁর চেয়ারটাকে সবাই সমঝে চলে। নজরানা, উপঢৌকন কতোই যে আসে উৎসব উপলক্ষে! গাধার মন মানে না। সে ফের ঘুরে বেড়ায় গ্রামের রাস্তায়। যেচে মান পেতে চায়। জনগণ যে সবসময়ে লাঠি নিয়ে তাড়া করে তা নয়, তবে পাত্তা দেয় না কেউ।

স্ত্রীকে তিনি বলেন, আসলে আমি একটা গাধাই ছিলাম, বুঝলে! উদাসীন গাম্ভীর্যে স্ত্রী বলেন, সে তো সেই কবে থেকেই বলে আসছি, এতদিনে বুঝলে? ঘরের কোণে বসে বরং ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকো, ততক্ষণে আমি গ্রামে ঘুরে ফিরে, সবার সঙ্গে উৎসব উদযাপন করে আসি, কেমন?

গল্পটা তারপর নানান বিপজ্জনক বাঁকে এগিয়ে যেতে পারে। তুচ্ছ উপহার কি মিষ্টি নোনতা প্যাকেটের প্রসঙ্গে রামায়ণের সেই সোনার হরিণ, আসলে যা মারীচের মায়াবী ছদ্মবেশ,এসে পড়বে হয়তো। সীতাই রামকে প্ররোচিত করেছিল সেই হরিণের পেছনে ধাওয়া করতে, অমনটাই না কি হয়ে এসেছে চিরকাল— উঠবে এইসব তর্ক। দীপাবলি উপহার নিয়ে যখন কথা শুরু হয়েছে, তারই বাস্তব প্রেক্ষিতে ফিরি। আসলে সমস্ত গল্পই হাসির বলে ধরে নেওয়া যায়; সুতরাং ছোটবেলায় পড়া, রুশদেশ থেকে শিশুসাহিত্য অনুবাদ হয়ে আসা সেকালের কথা তো মনে পড়বেই! বইটার নাম: বাবা যখন ছোটো। স্কুলের নিচু ক্লাসের গল্প। শান্তশিষ্ট ছোট্ট বাবাটিকে রোজই খুব খোঁচায় সামনের বেঞ্চে বসা একটা বাচ্চা মেয়ে। বাবা একদিন খুব খেপে গিয়ে, মেয়েটাকে দিলো পেনসিলের খোঁচা। চ্যাঁ ভ্যাঁ লেগে গেল খুব, তারপর শিক্ষিকার ধমকে সারা ক্লাস চুপ। বাবা হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়ে বলে ওঠে, আমি ওকে খোঁচাইনি…
— ও, তাই? তা, কি দিয়ে খোঁচাওনি?
— এই পেনসিলটা দিয়ে… বাবার সরল স্বীকারোক্তি।

মনে আসে নানান পদস্থ লোকজনের সঙ্গে পারিবারিক ভ্রমণ। এমন উৎসবের ঋতুতেই। কতরকম দম্পতির কতরকম হাবভাব, ব্যবহারে কতরকম ভাঁজ। দেওয়ালি, হোলি, সমস্তই সর্বভারতীয় উৎসব, প্রসন্ন পর্যবেক্ষণই যে বাঞ্ছনীয়, কর্তারা মাথায় রাখলেও, তাঁদের স্ত্রীরা রাখেন না। কাণ্ডজ্ঞান তো সমান নয় সবার! এই দ্যাখো আমি/ আমরা কেমন আলাদা… সবার চেয়ে উঁচুতে, হোলিয়ার দ্যান দাও… এই ভাবটা হয়তো ঘরে বন্দী থাকা পতিগরবিনী বউদেরই বেশি। অমনই একজন বলে যাচ্ছেন যেন নিজের কর্তাকে উশকে দিতেই, সবার কোয়ার্টারে, সব্বার কতো কতো গিফটের প্যাকেট… দেওয়ালীর কত কতো কতো থালি… তারপর নতুন বছর আসতে না আসতেই ডায়েরীর পাহাড়, বল, বল? তুমি তো কিছুই নিতে না— বল? বল?

রাজস্ব আধিকারিক সত্ত্বার থেকে তখনই আমার মগজে বড় হয়ে উঠেছে রবীন্দ্রগান ভালোবেসে বেঁচে থাকার জীবনটা। দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে… এইসব বলতে যাচ্ছি, কোনও এক পদস্থ পুরুষের স্ত্রী বলে উঠলেন, বিলিয়ে বিলিয়ে শেষ হতো না, বল? নিজেদের আর লাগে কতটুকু?

ঘরের মধ্যে বসে থাকতে সাহস পেলাম না আর। আমার যা আছে, আমি সকল দিতে পারিনি তোমারে নাথ… বেসুরো চিৎকারে গেয়ে ওঠার চেয়ে, লাজ ভয় মান অপমান ভুলে, রাতের আহারের তদারকি করার ছুতোয় বারান্দায় চলে এলাম চেয়ারশুদ্ধু। হ্যাঁ,দপ্তরের চেয়ারে বসার আগে আমাদের যে আহরণমত্ততা নিয়ে নানান ভালো কথা শেখানো হয়! ওসব ভুলে, এই পাহাড়ে সুরম্য হোম স্টে তে বসে, গাইবো, এরে ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে?

তুমি তো ওই পেনসিলটা দিয়ে খোঁচাওনি, বল? বল? তুমি তো কখনও ঘুষ টুস নাও না, বল? যে শান্ত ভদ্রলোকটিকে বলা হচ্ছিল, পীড়িত পতির মতন বডি ল্যাঙ্গুয়েজে তিনি আমার পাশে নীরবে চেয়ার টেনে বসলেন। ভদ্রলোকের পদবি, সিংহ। গাধা নিয়ে গল্প শুনতে শুনতে, সহসা তাঁকেই মনে পড়ছে কেন যে!
জীবনটা এক চলমান উৎসব, তাই তো? যেচে মান, আর কেঁদে সোহাগ, তাকে স্বাদু করে আরেকরকম রঙে! কেউ ভোলে না, কেউ ভোলে…