অনিন্দ্য ভুক্ত
একত্রিশে ডিসেম্বরের রাত বারোটা তখনও বাজেনি। কিন্তু ঘড়ির কাঁটার দিকে সব সময় তাকাতে গেলে কি চলে? ঠান্ডায়, হিমে বাজিগুলো যে মিইয়ে যাবে শেষে! অতএব বারোটা বাজার আগেই অন্য এক দফা বারোটা বাজানোর পালা শুরু হয়ে গেছে চতুর্দিকে। যত না কান ঝালাপালা, তার চেয়ে মন ঝালাপালা হয়ে যায় বেশি। বাজির আওয়াজ তো নয়, যেন সেই কিংবদন্তি গান, শুধু শব্দগুলো একটু পাল্টে দিলেই হয়। সখি হ্যাপি কাহারে কয়!
এমনিতে আমি শীতকাতুরে। তবু কি মনে হল, একবার ছাদে উঠে গেলাম। যদিও শীত এবার একটু কম পড়েছে, তবুও কে বলে শীতের রাত্রি? প্রায় প্রতিটি ছাদে মানুষের ভিড়। ভেবেছিলাম দেখব শুধু ছেলে-ছোকরার দল। কিন্তু ওমা, এ যে দেখি আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা! প্রায় প্রতিটি বাড়ি থেকেই সশব্দে উড়ে যাচ্ছে শব্দবাজি। হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার।
বাড়ির ছাদ থেকেই চোখে পড়ে বড় রাস্তার ছবি। সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানেও মানুষের ভিড় কম নয়। হঠাৎই তীব্র এক শব্দে মনে হল যেন বধিরই হয়ে গেলাম। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে দেখলাম, রাস্তায় এক জায়গায় জড়ো হয়েছে দশ বারোটি ছেলে। সঙ্গে তাদের বাইক। সেই সব বাইকের হর্ণগুলি একসঙ্গে চেপে ধরে উল্লাসে ফেটে পড়ছে তারা। হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার।
এখন তো সব হাইরাইজ। তার মধ্যে ছোট ছোট অজস্র পায়রার খোপ। আমি নিজেও থাকি তেমনই একটি পায়রার খোপে। এখানে কেউ কারো সুখ-দুঃখের খোঁজখবর রাখে না। তবু সব হাইরাইজেই আছে একটি করে কমিউনিটি হল। সেখানে নাকি সবাই পরস্পরের সুখ এবং দুঃখ উদযাপন করে একত্রে। বিবাহ বা জন্মদিনের অনুষ্ঠানই হোক বা শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। এখন সেখানে গেলে কি ছবি দেখব তা জানি। জানি মানে পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে। ঘরে তারস্বরে বক্স বাজছে, ঘর ভরে উঠেছে ধোঁয়ায় আর মদের গন্ধে। আনন্দ, কি আনন্দ। হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার।
নিঃশব্দ ধীর পদক্ষেপে ঘরে ফিরে আসি। প্রশ্ন জাগে মনে, এ কিসের আনন্দ, কেমন আনন্দ? আনন্দের বহিঃপ্রকাশ কবে থেকে এতো উদগ্র হয়ে উঠল, কেন উঠল? এ কি কেবলই আনন্দ, নাকি আনন্দের আড়ালে বুক চেপে থাকা এক বেদনা? বিকট শব্দ, উৎকট চিৎকার আর মদের নেশায় বেদনা ভুলে থাকার এক প্রবল প্রচেষ্টা?
এই মুহূর্তে কলকাতার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ২৮০ থেকে ২৯০ এর মধ্যে ঘোরাফেরা করছে, শোচনীয়তার দিক থেকে যা কিনা দিল্লির ঠিক পরেই। শব্দদূষণের মাত্রার দিক থেকেও কলকাতা দ্বিতীয়, মুম্বইয়ের ঠিক পরেই। এই যে আজ যাদের শব্দ আর ধোঁয়ার উৎকট আনন্দে মেতে উঠতে দেখছি, এদের মধ্যে অনেকেই হয়তো এই তথ্য জানেন, কেউ কেউ আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় এই নিয়ে পোস্টও করেন, কখনও কখনও বা প্রতিবাদ সভাতেও হাত পা নাড়েন। এদের কারো কারো বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা আছেন, অসুস্থ সন্তানও থাকতে পারে। সমাজ বা পরিবার, আনন্দে মেতে উঠার সময় কারোর কথাই এদের স্মরণে থাকে না কেন, নিজেরা যা বিশ্বাস করেন না, তা নিয়ে প্রতিবাদই বা কেন করেন? তাহলে কি আমরা ধরে নেব, এ সমস্ত মানুষই অত্যন্ত স্বার্থপর? কিন্তু আনন্দ তো স্বার্থপরতার জিনিস নয়। এতদিন তো জেনে এসেছি, দুঃখ একান্ত আপনার, কিন্তু আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার জিনিস। যদি তাই হয় তাহলে স্বার্থপরের আনন্দ উদযাপন বলে তো কিছু হতে পারে না।
অথবা হতে পারে এই আনন্দ এক ধরনের হতাশার বহিঃপ্রকাশ। চতুর্দিকে সামাজিক অবক্ষয়, শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমন ছাঁচে গড়ে তোলা হচ্ছে যাতে প্রকৃত শিক্ষিত হয়ে এই অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো না যায়। চাকরি-বাকরির সুযোগ কেড়ে নিয়ে, পরিবর্তে ঘুরপথে কিছু পাইয়ে দিয়ে এমনভাবে মেরুদণ্ডহীন ভিক্ষুক শ্রেণীতে পরিণত করে দেওয়া হচ্ছে কর্মপ্রার্থী যুবসমাজকে যাতে তারা এক বোধবুদ্ধিহীন আনন্দে গা ভাসিয়ে থাকতেই অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এই যে সর্বগ্রাসী এক হতাশা হালকা কুয়াশার মত ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে ফেলছে চতুর্দিক, কিছুক্ষণ উৎকট আনন্দে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে হয়তো তা থেকে সাময়িক হলেও মুক্তি চাইছে সমাজ, ঠিক যেমন একদল মানুষ ঘোষিতভাবেই সিনেমা হলে ঢোকেন নাচ-গান, মারদাঙ্গার আড়ালে নিজেকে কিছুক্ষণ লুকিয়ে ফেলতে। এরা কোনও বাস্তবধর্মী সিনেমা দেখতে অস্বীকার করেন এ কথা বলেই যে, সারাক্ষণই তো এর মধ্যেই আছি, তার জন্য সিনেমা কেন দেখতে হবে? ঠিক এই মানসিকতাই কি আজকের উৎকট আনন্দের প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিচ্ছে? আনন্দের পেছনে কি আসলে লুকিয়ে আছে এক হতাশাগ্রস্থ জীবনের ছবি? ভাবতে হবে, ভাবতে হবে, ভাবছিও…
সখি হ্যাপি কাহারে কয়/ সে কি কেবলই বেদনাময়!