স্মৃতিতে জলরাশি ’৭৮

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

ময়ূরী মিত্র

পাড়ার সবথেকে বড়লোক জৈন লবাড়ির পোষা মোরগটা সেদিন ভোরে ডাকল না৷ ক’দিন মাত্র হয়েছিল, সে বাড়ির বাচ্চা ছেলেটার বায়নায় মোরগটাকে আনা হয়েছিল৷ তবু তার ডাকে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম৷ প্রিয়ের ডাকে অভ্যস্ত হতে মনই তখন ব্যস্ত হয়৷ মোরগটাও বুঝে গিয়েছিল– তার কাজ শুধু বাচ্চাটাকে খুশী দেওয়া৷ নিরামিষাশীর নিরাপদ আস্তানায় বসে রোজ সকালে বেজায় আনন্দে গলা ছাড়ত৷

ছুটির দিনে দুপুরে বেলগাছিয়া ভাড়াবাড়ির ছাদ থেকে আমি দেখতাম — বাবা মা লোক ডেকে মোরগ বিদায়ের চেষ্টা করছে আর ছেলেটা মোটা কোলের মধ্যে মোরগ ঠুসে বসে আছে৷ দূর থেকে দেখতে দেখতে সে আমারও বন্ধু হল৷ জীব যেমন আশ্রয় বোঝে তেমনি আপদও সে মানুষের আগে বুঝে যায়৷ ফলে যেরাতে আকাশ থেকে বন্যা নেমে মাঠ ডুবোলো সেদিন সে তার ভোরের ডাক ডাকল না৷ ওগো – সে ৭৮ -এর বন্যা গো দিদিরা৷ বয়স তখন আট৷ গৃহপালিত পশুকে তখন ভাই ভাবি -গাছের পাতায় সূয্যির আলোর ছটফটানি দেখে গাছ হতে চাই আর ভাবি বন্যা একবারে ডিরেক্ট আকাশ থেকে নেমে আসে৷ হা ভগবান!


বড়ঘরের মেঝেতে ঠাকুমার বুকে শুয়ে যখন প্রবল দুশ্চিন্তা করছি – সকাল হল তবু মোরগটা কেন ডাকছে না তখনই ঠাকুমা বলে উঠলেন –ওঠ ওঠ৷ ঘরে জল ঢুকছে৷ খাট উঁচু করতে হবে – তক্তায় উনুন তুলতে হবে৷ হাউহাউ করে ছোটকাকার জন্য কাঁদতে শুরু করলাম৷ এ কাকা তখন বাইরে চাকরি করতেন৷ আসতে দেরী হলে বা ঝড় বৃষ্টি রোদতাপ যে কোনো একটা বেশী হলেই ভাবতাম -সে মরে গেছে৷ শিশুকালে বিপদ মানে মৃত্যু আর সুখের খবর মানে গোটা ডিমের কালিয়া বা রবিবারের পাতে একটুকরো ছাগলের মেটে৷ চারপাশে ভাজা পেঁয়াজ লাগা৷

বিকেলে খবর পেলাম — বেলগাছিয়ায় নৌকো চলছে আর তার মধ্যে কেউ একজন ভেটকি বিক্রি করছে৷ মেজোকাকার ছিল উল্টোপাল্টা বুদ্ধি৷ দেখো দিকিনি দিদিরা –ওই বন্যায় সে নিয়ে এল ভেটকি আর কালো বেগুন৷ রাতে তক্তাপোষে বসে খেলাম রাঁধুনি ফোড়োন দিয়ে ভেটকি কালিয়া৷ আমি ও আমাদের বাড়িতে রয়ে যাওয়া এক সাধু মহারাজ৷ তিনি এসেছিলেন বাড়িতে রামকৃষ্ণের পুজো করতে৷ বন্যা শুরু হওয়ায় যেতে পারেননি৷ বুড়ো বলে তাঁর তখন দ্রুত খিদে পায় আর বাচ্চা বলে আমার খিদেটাই বেশী পায়৷ ফলে তক্তার ফার্স্ট ব্যাচ আমি আর সাধু৷ তখন বিপদ এলে মানুষগুলো বড় একসঙ্গে বাঁচত গো৷ সাধু থেকে সাপ — গেরস্ত কাউকে তাড়াতে পারত না৷ অতিথি চলে গেলে গেরস্তের বুক হা হা করত,কপাট খোলা দুয়োরের মতো৷ উনুন আর অতিথি গেরস্তের বুকের ধন ছিল গো৷

রাতে জল বাড়লে প্রতিবেশীরা আমাকে, সাধুকে আর একটা খাটো কুকুরকে দোতলায় নিয়ে গেলেন৷ ঠাকুরদাকে নিয়ে হাঁটা আমার অব্যেস৷ আমার জ্বালায় উনিও ওপরে৷ দোতলায় চারটি প্রাণী ঘুমোল – গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী, গৃহপালিত প্রাণী, গেরস্ত বাড়ির কর্তা আর একটা বাচ্চা মেয়ে — যে সকালে উঠে পাশের বাড়ির সদ্য আনা বন্ধুমুরগীর ডাক শুনতে চায়৷

সকালে উঠে দেখি দুগ্গাপুজোর প্যান্ডেল ভেঙে পড়েছে৷ বাঁশ তেরপল জলে ডুবো ডুবো৷ বেলগাছিয়ায় পরপর তিন মাঠের তিন সীমানা ভেঙে একটি নদী তৈরি হয়েছে৷ সব ঘাস সেই নদীর তলায়৷ কী ভয় গো তখন আমার! আরে! ঘাসগুলো কি জন্মের শোধ এই অচেনা নদীটির গর্ভে গেল নাকি? আর দেখতে পাব না? ঘাস আমার এত প্রিয়? কখন বুঝলাম? সে ডুবে যেতে৷

পরের বিকেলেও ঝিমঝিম বৃষ্টি৷ একতলায় জলে বাটি ঘটি human পটি সব ভাসছে৷ আবার মেজোকাকা ঠাকুরদার কাছে উৎপাত শুরু করল বাজার করবে বলে৷ পাঁঠার মাংস, খিচুড়ি৷ ফের উল্টোপাল্টা মেনু৷ সেদিন মোরগ বেঁচে আছে দেখে আমিও খুশি৷ তবে সে বুঝি বৃষ্টিতে ছুটে গিয়েছিল— তাই পালকগুলো তীরের মতো খোঁচা খোঁচা হয়ে গেছে শুধু৷ মেজকাকার বাজার করার হামলা বাড়ছিল৷ ঠাকুরদা গম্ভীর হচ্ছিলেন৷ বললেন –বন্যা কমলে মানুষ নাহয় রোগে নয় দানার অভাবে মরবে৷

তরুণ যুবকরা ঘুরে ঘুরে রিলিফের চাল, সবজি, জামা বিলোেচ্ছেন৷ শরতের জল গায়ে লেগে নেপালী পাড়ার বাচ্চাদের কফ কাশি হল৷ খুব নেচেছে তো কদিন৷ নাও ভোগো এখন! সারাতে ওষুধ লাগবে৷ কংগ্রেসি ঠাকুরদা বামপন্থী কর্মীদের অনেক টাকা চাঁদা দিলেন৷ সবার মুখে শুনছিলাম— অশোকবাবু অনেক টাকা দিয়েছেন৷
‘অনেক’ যে কী তা তখন বুঝিনি গো দিদিরা৷ তবে সেই প্রথম মনে হয়েছিল— কিছু মানুষ খুব বড়৷ মা দুগ্গার প্যান্ডেলের থেকেও বড়৷ বন্যা তাদের কাছে ডুবে ছোট খুকিটি হয়ে যায়৷

বন্যা সরে যেতে প্রিয় ঘাস এসেছিল মাঠে৷ তারা নাকি ঘাসের নতুন বাচ্চা৷ মোরগটাকে আর দেখিনি৷ আর খুঁজিওনি৷ ভেবেছিলাম, পৃথিবী নিরাপদ হয়েছে এখন৷ চলে যদি যায়ও নিরাপদেই থাকবে কোথাও৷ আবার হয়ত প্রকৃতি উল্টিপাল্টি খেলে খুঁজব ছোটকালের প্রাণীবন্ধুদের!

শুধু অনেক মানুষের খাদ্য বানানো হত যে উনুনে তাকে আর দেখতে পাব না৷ সে গুলকয়লা— বড় ডেকচি, বড় গামলা সব পুড়ে স্রেফ একরাশ ছাই হয়ে গেছে গো৷