মহারাষ্ট্র বা ওড়িশার মতো রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের পুলিশি নিগ্রহকে রাষ্ট্রীয় হিংসা ছাড়া কী-ই বা বলা চলে? নাগরিকত্বের বৈধ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মুর্শিদাবাদের শ্রমিকদের বাংলাদেশে ছেড়ে আসার স্পর্ধা অকল্পনীয়। পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকদের উপরে এই আক্রমণ তিনি মানবেন না, কলকাতার পদযাত্রা থেকে সে কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কোন আইন, কোন বিধিতে এই রাজ্যগুলিতে বাংলাভাষী শ্রমিকদের পুলিশ বন্দি করছে, কেড়ে নিচ্ছে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, সেগুলিকে ‘জাল’ ধরে নিয়ে চূড়ান্ত হয়রানির পর বার করে দিচ্ছে রাজ্য থেকে, এমনকি দেশ থেকে? কোন সরকারি বিধির বলে দিল্লিতে পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকদের বাসস্থানের বিদ্যুৎ, জলের সংযোগ কেটে দেওয়া হচ্ছে?
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও জানাচ্ছে যে, নাগরিকত্ব প্রমাণের কোনও সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না ভারতের মুসলিম শ্রমিকদের। থানায় আটক রাখা, দেশ থেকে বহিষ্কার বিষয়ে আইন-বিধি, কিছুই মানা হচ্ছে না। পরিযায়ী শ্রমিক বিবিধ ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে যান, কিন্তু হিংসার এই প্রচণ্ডতা অভূতপূর্ব। বাংলাভাষী মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিক মানেই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, এই ধারণা এক আদ্যন্ত রাজনৈতিক নির্মাণ— হিন্দুত্বের রাজনীতি সুপরিকল্পিত ভাবে নিশানা করছে বাংলার শ্রমিকদের। তার পিছনে নির্বাচনী রাজনীতির সমীকরণ স্পষ্ট।
কলকাতার পদযাত্রায় মুখ্যমন্ত্রী বার্তা দিয়েছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকের অপমান বাংলার অপমান, বাঙালির অপমান। তাঁর এই বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়েও বলা প্রয়োজন যে, পরিযায়ী শ্রমিকের এই বিপন্নতাও রাজনীতিরই নির্মাণ। পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরক্ষা, তাঁদের রোজগার ও স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার জন্য যে ব্যবস্থাগুলি করার নির্দেশ দিয়েছে আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক আইন (ইন্টার-স্টেট মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কমেন অ্যাক্ট, ১৯৭৯), সেগুলি প্রায় কোনও রাজ্যই যথাযথ ভাবে পালন করেনি। আইন অনুসারে অন্য রাজ্যে কর্মরত পরিযায়ী শ্রমিক, এবং সে রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের মধ্যে থাকার কথা ছিল আর একটি স্তর, তা নিয়োগকারীর, অথবা শ্রমিক-ঠিকাদারের।
যে বাণিজ্যিক সংস্থা পাঁচ জনের বেশি আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক নিয়োগ করছে, তার নথিভুক্তি দরকার। ভিন রাজ্যে শ্রমিক নিয়ে যাচ্ছে যে ঠিকাদার, তাকেও নথিভুক্তি করতে হবে। এই আইন বাস্তবে অনুসরণ করলে কোনও শ্রমিকের বৈধতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে নিয়োগকারী, বা মালিক-শ্রমিকের মধ্যস্থতাকারী সংস্থাকে তলব করা যেত। প্রশাসন নথিভুক্তির প্রতি দৃষ্টি দেয়নি, তাই দরিদ্র, স্বল্পশিক্ষিত শ্রমিকরা চিরকালই অপর রাজ্যে অতি সহজে ‘অপরাধী’ বলে প্রতিপন্ন হয়ে আসছেন। উন্মত্ত জনতা বা পুলিশের নিগ্রহে সর্বস্বান্ত, ক্ষত-বিক্ষত, এমনকি নিহত হয়েছেন, এমন দৃষ্টান্ত কম নয়। নিয়োগকারী শ্রমিকদের ন্যূনতম সুরক্ষা দেওয়ার দায় অস্বীকার করলে তার ফল কত ভয়ানক হতে পারে, তার সাক্ষী ছিল কোভিড লকডাউন।
মমতা দাবি করেছেন, ভিন রাজ্যের শ্রমিকরা পশ্চিমবঙ্গে নিরাপদ। তাঁর দাবি অনেকাংশেই সত্য। কিন্তু তবু প্রশ্ন থেকে যায়, শ্রমিকদের সুরক্ষার আইনি পরিকাঠামো কি রাজ্যে প্রস্তুত? তাঁদের নিয়োগকারী সংস্থাগুলি কি নথিভুক্ত? কেরল পরিযায়ী মজুরের স্বার্থরক্ষায়, শ্রমিক পরিবারগুলির জন্য আবাসন, ক্রেশ প্রভৃতি তৈরিতে যতখানি সক্রিয়, পশ্চিমবঙ্গ তেমন নয়। অপর দিকে, বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের নথিভুক্তি এখনও সম্পূর্ণ হয়নি— পোর্টালে নাম একুশ লক্ষের, যা বাস্তবের ভগ্নাংশ। অসরকারি মতে মালদহেরই অন্তত দশ লক্ষ শ্রমিক অন্য রাজ্যে যান, শ্রম দফতরে নাম লেখা আড়াই লক্ষের। আইন ও প্রশাসনিক সুরক্ষা-ব্যবস্থার এই শিথিলতা সর্বত্র, সব স্তরে। শ্রমিক-স্বার্থের প্রতি উদাসীন রাজনীতি বহু দশক ধরে এই সঙ্কট তৈরি করেছে। ধর্ম-বিদ্বেষী রাজনীতির মারের সামনে অসহায়তা তাই আরও বেশি।আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বাঙালি অস্মিতাই যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধানতম রাজনৈতিক অস্ত্র হতে চলেছে, তা তিনি নিজেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিভাজন ও মেরুকরণের রাজনীতির প্রতিস্পর্ধী হিসাবে বাঙালি পরিচিতির সংহতির রাজনীতি অধিকতর গ্রহণযোগ্য হবে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর আপাতত ভবিষ্যতের গর্ভে। পরিচিতিকেন্দ্রিক দুই রাজনীতির মধ্যে ফারাকটি অবশ্য প্রশ্নাতীত— একটি রাজনীতি বর্জনের, অন্যটি গ্রহণের; একটি রাজনীতি অপরায়ণের, অন্যটি সর্বজনীনতার। এমন আশঙ্কা অমূলক নয় যে, শেষ অবধি বাঙালি অস্মিতার পুরোটাই ঘেঁটে গিয়ে হাতে থাকবে কিছু পুরনো তরজা; কিন্তু অন্তত এই মুহূর্তে অস্ত্রটিতে তৃণমূলের উভয় গোত্রের প্রতিদ্বন্দ্বীই চমকিত। মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য তার প্রমাণ। কিন্তু, বাঙালি অস্মিতার এই রাজনীতিতে একটি মোক্ষম খামতি থেকে গিয়েছে। তার নাম অর্থনীতি। মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে, এই প্রথম বার বাঙালি ভিন রাজ্যে বিদ্বেষের সম্মুখীন হচ্ছে— আর্থ-সামাজিক শক্তির জায়গা থেকে নয়— বরং, প্রশ্নাতীত রকম দুর্বল এক অবস্থান থেকে। বিভিন্ন রাজ্যে যে বাঙালি নানাবিধ হিংসার সম্মুখীন হচ্ছে, সে বাঙালি সেই রাজ্যগুলিতে উপস্থিত সমাজের অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বলতম অংশের প্রতিনিধি হিসাবে— তারা এক দিকে দরিদ্র, অন্য দিকে স্বভূমি থেকে (স্বেচ্ছা)বিচ্যুত। এই বাঙালির পাশে দাঁড়াতে গেলে রাজ্যের নিজস্ব জোর থাকা প্রয়োজন। অতীত গৌরবের জোর নয়, এমনকি দেশের শাসক দলের বিরুদ্ধে প্রবলতম বিরোধী নেত্রীর রাজ্য হিসাবে পরিচিতির জোরও নয়— অর্থনৈতিক জোর প্রয়োজন।
দরিদ্র অভিবাসীদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের ক্ষোভ এক বৈশ্বিক সত্য। রাজনীতি সেই ক্ষোভকে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি যেমন তার মুসলমান-বিরোধিতার তিরকে ঘুরিয়ে দিয়েছে দরিদ্র বাঙালি অভিবাসীদের বিরুদ্ধে। ঘটনা হল, অদক্ষ, অর্ধদক্ষ, এমনকি দক্ষ কায়িক শ্রমিকের বিরুদ্ধেও এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ তুলনায় সহজ— বিশেষত, সেই শ্রমিকরা যদি আর্থিক ভাবে দুর্বলতর রাজ্য থেকে আসেন। তার একটি কারণ হল, ভিন রাজ্যে মার খেয়েও পড়ে থাকাই অনেকের কাছে তুলনায় অধিকতর গ্রহণযোগ্য বিকল্প— কারণ, ফিরে এলে এ রাজ্যে কাজের সংস্থান হবে না। যাঁদের প্রত্যাঘাত করার জোর নেই, এমনকি মার খেয়ে পালিয়ে যাওয়ারও উপায় নেই, তাঁদের মারা বড় সহজ কাজ। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমজীবী বাঙালি আজ তেমন অবস্থানে আছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর বাঙালি অস্মিতার রাজনীতি তাঁদের হয়তো খানিক সাহস দেবে, কিন্তু গ্রহণযোগ্য কোনও বিকল্পের ব্যবস্থা করবে না। ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, এ রাজ্যে যথেষ্ট কাজ আছে। সত্যই কি আছে যথেষ্ট অর্থপূর্ণ কাজ? একশো দিনের প্রকল্পে মাটিকাটার কাজ নয়, এমন কাজ যা ভিন রাজ্যের কাজের সমান না হোক, অন্তত কাছাকাছি বেতন দিতে পারে? রাজ্যবাসী এই প্রশ্নের যে উত্তর জানেন, তাতে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে ফেরার আহ্বানে সাড়া দিতে সাহস পাওয়া মুশকিল। বাঙালি অস্মিতার রাজনীতিকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে হলে অতএব অর্থনীতির দিকে মন দেওয়া প্রয়োজন। বৃহৎ শিল্পের আবাহন যদি না-ও হয়, ক্ষুদ্র বা মাঝারি শিল্পের বিকাশকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়। মুখ্যমন্ত্রী খেয়াল করে দেখতে পারেন, ভারতের যে রাজ্যগুলিতে গত তিন-চার দশকে প্রাদেশিক অস্মিতার রাজনীতি সফল হয়েছে, তার প্রতিটিই আর্থিক ভাবে সফল।
গুজরাত বা মহারাষ্ট্রে কেন অস্মিতার রাজনীতি বলীয়ান, আর বিহার বা মধ্যপ্রদেশে কেন নয়, সে প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করলেই বাঙালি অস্মিতার রাজনীতির সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হয়ে যাবে।প্রশ্ন হল, মমতা কি সুযোগ কাজে লাগাতে পারবেন? এ পথে সবচেয়ে বড় বাধা হল বর্ণহিন্দু জনগোষ্ঠী। ঐতিহাসিক কারণে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’র মালিকানাটি সেই জনগোষ্ঠীর হাতে। এবং, প্রায় নিশ্চিত ভাবে অনুমান করা চলে, বৃহত্তর বাঙালি জাতিসত্তা নির্মাণের বিরুদ্ধেও তাদের অস্ত্র হবে সেই সাংস্কৃতিক কৌলীন্যমণ্ডিত বাঙালিত্বই— যেখানে ‘প্রকৃত বাঙালি’ হওয়ার পূর্বশর্ত সত্যজিৎ-ঋত্বিকের সিনেমা দেখা, লিটল ম্যাগাজ়িনচর্চা, এবং সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ। হাতেগোনা ‘এলিট’ বাদে বাঙালিত্ব থেকে বাকিদের বর্জনের মাপকাঠি হিসাবে এই সাংস্কৃতিক এককগুলির— বিশেষত রবীন্দ্রনাথের— ব্যবহারের মধ্যে যে আশ্চর্য পরিহাস রয়েছে, আপাতত সে কথায় ঢোকার দরকার নেই। প্রশ্ন হল, এই দখলদার ‘এলিটতন্ত্র’-কে অতিক্রম করার অস্ত্র মমতার তূণে আছে কি?
বঙ্গ রাজনীতি, আরও এক বার, আক্ষরিক অর্থেই এসে দাঁড়িয়েছে একটি ঐতিহাসিক মোড়ে। উভয়ার্থেই ঐতিহাসিক— এক দিকে রয়েছে সওয়াশো বছরের ইতিহাস; আর অন্য দিকে, প্রাদেশিক এবং সর্বভারতীয় রাজনীতিতে একটি নতুন ভাষ্য তৈরি করার ঐতিহাসিক সুযোগ।