ধ্রুবজ্যোতি মন্ডল
সম্প্রতি বন্দে মাতরম-এর সার্ধশতবর্ষ উদযাপনে দেশ যখন নানা অনুষ্ঠানে মেতে উঠেছে তখন অন্যদিকে এই সংগীতকে ঘিরে কিছু বিতর্কও শোনা যাচ্ছে। যদিও এটা নতুন কিছু নয়। যেদিন থেকে এই গান প্রচারের আলোয় আলোকিত হয়েছে সেদিন থেকেই সমালোচনার সূত্রপাত। তবুও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রতিবাদের হাতিয়ার বা স্লোগান হিসেবে বন্দে মাতরমের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। এবং আজও তা অব্যাহত। অথচ তাজ্জব কি বাত, বন্দে মাতরমের এই জনপ্রিয়তা ও উদ্ভূত সমালোচনা কোনটাই বঙ্কিমবাবু তাঁর জীবদ্দশায় প্রত্যক্ষ করে যেতে পারেননি।
সম্ভবত ১৮৭৫ সালে তিনি এই গান রচনা করেছিলেন। সম্ভবত বলা এই কারনে যে এই গান কবে কোথায় লেখা হয়েছিল তা নিয়ে খানিক মতভেদ আছে। অনেকের মতে, বঙ্কিমচন্দ্র ওই সময় হুগলিতে সরকারি কাজে যোগ দেবার আগে অসুস্থতার কারণে আট মাসের একটা লম্বা ছুটি নিয়ে কাঁঠালপাড়ার বাড়িতে এসেছিলেন। সেই অবসরে তিনি কয়েকটি গানের খসড়া করেন। তারমধ্যে বন্দে মাতরম্ও ছিল। তারপর গানটি প্রায় পাঁচ বছর বাক্সবন্দি হয়ে থাকে। এরপর ১৮৮০ সাল অর্থাৎ বাংলার ১২৮৭-র চৈত্র ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে তিনি বন্দে মাতরম্ গানটি জুড়ে দেন। আবার পণ্ডিতমহলের আর এক অংশের বক্তব্য, ১৮৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে মুর্শিদাবাদের লালগোলার মহারাজা যোগেন্দ্রনারায়ণ রায়ের আমন্ত্রণে বঙ্কিমচন্দ্র রাজবাড়িতে আসেন এবং সেখানে অতিথিশালায় থাকাকালীন রাজবাড়ির কালীমন্দিরে বসে তিনি নাকি আনন্দমঠ উপন্যাস ও বন্দে মাতরম্ গানটি লিখেছিলেন। সেই প্রাসাদভূমি আজ আগাছায় ভরে গেলেও ফটকের ওপর লেখা বন্দে মাতরম্ মনে করিয়ে দেয় সেই দাবিকে। আবার একথাও শোনা যায় আনন্দমঠে যে তিনটি মাতৃমূর্তির উল্লেখ আছে সেগুলি একমাত্র এখানেই আছে।
তবে যে গান এত ঘটনার সাক্ষী বহন করছে তার যে কি শক্তি তা দেখে যেতে না পারলেও সাহিত্যসম্রাটের বিশ্বাস ছিল একদিন এই গান নিয়ে বাংলা উন্মত্ত হবে। সেকথা তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যাকে বলেও গিয়েছিলেন। হলোও তাই। ১৮৯৬ সালে কংগ্রেস অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং বন্দে মাতরম্ সুরারোপিত করে প্রকাশ্য জনসভায় গেয়ে শোনালেন। সেই প্রথম বন্দে মাতরম্ এল রাজনীতির আঙিনায়। তারপর তো কাণ্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হল এই মহাসংগীত। ১৯০৫ সালে ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে বিদেশি পণ্য বর্জনের সভায় স্বেচ্ছাসেবকরা সমস্বরে বন্দে মাতরম্ ধ্বনিতে সোচ্চার হয়ে উঠলেন। দেশ স্বাধীন না হওয়া পযর্ন্ত এই সংগীত এই স্লোগান হয়ে উঠলো বিপ্লবীদের মূল মন্ত্র। মূল শক্তি। এবং আজও স্বাধীনতার আটাত্তর বছর পরও বন্দে মাতরম্ প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে। কিন্তু কেন আজও এই স্বদেশ সংগীত বা স্লোগান আমাদের এত উজ্জীবিত করে। আসলে এই গানে জননী জন্মভূমির এক সুন্দর বন্দনা রয়েছে। বন্দে মাতরম্/সুজলাং সুফলাং, মলয়জশীতলাং,/শস্যশ্যামলাং, মাতরম্…। বঙ্কিমচন্দ্র স্বদেশ উদ্ধারের জন্য আনন্দমঠ উপন্যাসে যে সন্তান সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছেন সেই সন্তানেরা স্বদেশ প্রেরণার উদ্দীপন সংগীত হিসেবে কখনো একক কখনো সমবেত ভাবে এই গান গেয়েছেন। যতদূর জানা যায়, ঋষি সাহিত্যিকের এই অমর সৃষ্টি নাকি অতীতের সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের ভাবনা থেকে উঠে এসেছে। তখনকার কালে এই সংগীত যেমন সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করেছিল তেমন সারা জাগিয়েছিল জ্ঞানীগুণী মহলেও। বিপিনচন্দ্রকে এই গান অভিভূত করেছিল কেননা তিনি এরমধ্যে দিয়ে দেশমাতৃকাকে গভীর ভাবে অনুভব করেছিলেন। তাঁর কথায়, জন্মভূমি মায়ের বিগ্রহ। বন্দে মাতরম্ তাঁর সাধনমন্ত্র। এই মন্ত্র জপ করতে করতে মায়ের স্বরূপ প্রকাশিত হয়। মায়ের এই সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা, শস্যশ্যামলা বিগ্রহ রচনা কবি বঙ্কিমের এক অসামান্য কবিকৃতি, যাকে অরবিন্দ বলেছিলেন, The vision of our Mother আর গান্ধীজির মতে, When we sing that ode to Motherland, ‘Bande Mataram’ we sing it to the whole of India।
মহাত্মা বরাবরই বন্দে মাতরম্-কে গুরুত্ব দিয়েছেন। ১৯১৯ সালে খিলাফৎ আন্দোলনের সময় গান্ধীজি খিলাফৎ এবং অসহযোগ কর্মসূচির মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে ইংরেজদের উপর চাপ বাড়াতে চাইলেন। পথেঘাটে শোনা যাচ্ছে আল্লাহ হু আকবর, ভারতমাতা কি জয়, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য কি জয় ইত্যাদি। এ ব্যপারে বিস্তারিত লিখেছেন মহাত্মা গান্ধীর জীবনীকার ডিজি তেন্ডুলকার। সেখানে পলাশী থেকে অমৃতসর অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন, মহাত্মা চেয়েছিলেন, আন্দোলনকারীরা আল্লাহ হু আকবর, ভারতমাতা কি জয় ইত্যাদির সঙ্গে বন্দে মাতরম্ ধ্বনিও তুলুন। তাহলে তাঁরা আর একটি গুরু দায়িত্ব পালন করবেন। কী সেই দায়িত্ব? গান্ধীজির মতে, তাহলে দেশের মধ্যে মননশীলতায় বাঙালি যে অগ্রগণ্য এই বিষয়টি সসম্মানে স্বীকৃত হবে। পরবর্তীকালে ‘হরিজন’ পত্রিকায় অনেক লেখায় গান্ধীজি বন্দে মাতরম্ সম্পর্কে তাঁর আবেগ প্রকাশ করেছেন। সুভাষচন্দ্রও বন্দে মাতরম্ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, এই এক মন্ত্র যা কত মানুষকে নির্ভয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
সেই সময় বন্দে মাতরম্ এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে, এই শব্দটি অনেকেই নিজের লেখা গানে ব্যবহার করেছিলেন। সতীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, আপনি বিধাতা সেনাপতি আজ/ ওই ডাকিছেন সাজরে সাজ,/ স্বদেশ সংগ্রামে চাই আত্মদান / বন্দে মাতরম্ গাওরে ভাই…। কালীপ্রসন্ন কাব্য বিশারদ লিখেছিলেন, মা গো! যায় যেন জীবন চলে / শুধু জগৎ মাঝে তোমার কাজে/বন্দে মাতরম্ বলে…।
যোগীন্দ্রনাথ সরকার ১৯০৫ সালে বন্দেমাতরম্ নামে একটি গানের বই প্রকাশ করলেন। তার ভূমিকা লিখলেন, বৈপ্লবিক গুপ্ত সমিতির সদস্য, লেখক সখারাম গণেশ দেউস্কর। সেখানে তাঁর বক্তব্য ছিল, জাতীয় সংগীত ভিন্ন জাতীয় চিত্তের অবসাদ দূর হয় না। জাতীয় ভাব যথোচিত বলবেগ লাভ করে না।
বন্দে মাতরমের উত্তাপ শুধু বাংলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। পরাধীন ভারতের পথে প্রান্তরে এমনকি বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল দাবানলের মত। বম্বেতে এর প্রভাব পড়েছিল দারুণ। পুনা থেকে বন্দে মাতরম্ নামে একটি ইংরেজি সংবাদপত্র প্রকাশিত হল। সেটা ১৯০৬ সালের ঘটনা। মহারাষ্ট্রের যুবসমাজ আন্দোলনের সামনের সারিতে এগিয়ে এলেন। তিলক ও সাভারকরের নেতৃত্বে বিলিতি বস্ত্র পোড়ানো হল। শাসকদের নিষেধ সত্ত্বেও নাগপুরের নীল সিটি স্কুলের ছাত্ররা স্বদেশি সভায় যোগদান করে বন্দে মাতরম্ গাইলে অধ্যক্ষ তাদের বহিষ্কারের নির্দেশ দিলেন। আর ছাত্ররা বন্দে মাতরম্ ধ্বনি দিতে দিতে ক্লাসরুম থেকে নিদ্ধির্ধায় বেড়িয়ে গেল।
১৯০৮ সালের জুন মাসে লোকমান্য তিলক গ্রেপ্তার হলেন। তাঁর ছয় বছর নির্বাসন দণ্ড হল। ২৯ জুন বিচারের দিন পুলিশ আদালতের চারপাশে বিশাল জনতা ঘনঘন বন্দে মাতরম্ ধ্বনি দিতে লাগলেন।
বিপিনচন্দ্র পালের সঙ্গে মাদ্রাজের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তাঁর মাধ্যমেই দক্ষিণ ভারতে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের জয়ধ্বনি বন্দে মাতরম্ এবং স্বদেশি-গ্রহণ সংকল্প প্রচারিত হয়। মাদ্রাজের স্বনামধন্য কবি সুব্রহ্মণ্য ভারতী বন্দে মাতরম্ মন্ত্রে প্রবুদ্ধ হন। তিনি ছিলেন ভগিনী নিবেদিতার ভক্ত। নিবেদিতার অনুপ্রেরণাতেই তিনি লিখলেন, ‘জয় বাংলা’। তারপর তাঁর তিনটি গীতিকবিতা ‘বন্দে মাতরম্’, ‘নমো ভারত’, ও ‘ভারত আমাদের দেশ’ বিখ্যাত প্রকাশক জিএ নটেশন বিনামুল্যে পনেরো হাজার কপি ছেপে প্রচারের ব্যবস্থা করলেন। দক্ষিণ ভারতের এই আন্দোলন কিছুদিনের মধ্যেই পশ্চিম ভারতে পৌঁছল। পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বন্দে মাতরমের প্রতি আকৃষ্ট হল। অন্যদিকে বিদেশেও তখন ঋষিকবির এই মন্ত্রগান আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। লন্ডনে থাকা ভারতীয় যুবকরা স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মারক হিসেবে বুকে বন্দে মাতরম্ লেখা অভিজ্ঞান লাগিয়ে সদর্পে সেখানকার রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। ফ্রান্সে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেত্রী শ্রীমতী ভিখাজি রুস্তম কামা এবং বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ কয়েকজন মিলে প্যারিসে বন্দে মাতরম্ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করলেন। আসলে ১৯০৬ সালে আগস্ট মাসে বিপিনচন্দ্র পাল যে ইংরেজি দৈনিক বন্দে মাতরম্-এর সূচনা করেছিলেন এবং তার সম্পাদনার দায়িত্ব অরবিন্দ ঘোষের হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেই কাগজ ইংরেজ সরকার বন্ধ করে দিলে তার বদলা স্বরূপ প্যারিসে ওই নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। আবার এই প্যারিসেই তৈরি হয় ভারতের জাতীয় পতাকা। অবশ্য এর আগে ভগিনী নিবেদিতা ভারতের একটি জাতীয় পতাকার পরিকল্পনা করেছিলেন মর্ডান রিভিউ -তে। মাদাম কামার নেতৃত্বে এখানে সেই পতাকা প্রস্তুত হলে তার বুকে দেবনগরী হরফে লেখা হয় বন্দে মাতরম্। এখানেই শেষ নয় বন্দে মাতরমের ঢেউ পৌঁছেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও। গদর আন্দোলনের নেতারা যখন কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে মিলিত হতেন তখন তাঁদের পারস্পরিক অভিবাদনবাণী ছিল বন্দে মাতরম্। গদর ছিল আন্তর্জাতিক স্তরের রাজনৈতিক আন্দোলন যার মাধ্যমে ব্রিটিশদের চাপে রাখার একটা প্রক্রিয়া জারি থাকত। এটা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের ঘটনা।
বলতে গেলে, এই ভাবেই এই মন্ত্র জনমনে দেশপ্রেমের জোয়ার এনেছে। রেকর্ডে দেশপ্রেমের গানের প্রথম জোয়ার এনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর স্বদেশ পর্যায়ের গানগুলি ছাড়াও সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দে মাতরম্। এই একটি মাত্র গান এত কন্ঠে এবং এত বিচিত্র সুরে আর কখনও কোথাও রেকর্ড হয়েছে বলে জানা যায় না। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৯২২ সালে হরেন্দ্রনাথ দত্তর গাওয়া বন্দে মাতরমের রেকর্ড। হরেন্দ্রনাথ ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছাত্র। তাঁর কাছেই হরেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রসংগীত ও ব্রহ্মসংগীতের তালিম নিয়েছিলেন। এছাড়া ভবানীচরণ দাসের বন্দে মাতরম্ সংগীতের রেকর্ড মেগাফোন কোম্পানি প্রকাশ করে ১৯৩৫ সালে। এটি সবচেয়ে দীর্ঘতম। রেকর্ডের দুই দিক মিলিয়ে প্রায় ছয় মিনিট ধরে গাওয়া। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপকুমার রায় ও এমএস শুভলক্ষ্মীর দ্বৈত কন্ঠে বন্দে মাতরমের রেকর্ড আমাদের কাছে আর একটি উপহার। প্রকাশ পায় ১৯৪৮ সালে। রেকর্ডের অন্যপিঠে ছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ধনধান্যে পুষ্পভরা গানটি। রেকর্ডটির লেবেলে ছিল চরকার চিহ্ন। পরবর্তীকালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া বন্দে মাতরম্ গানটিও আমাদের হৃদয়কে উদ্বেলিত করে। তাই একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বন্দে মাতরম্ যেমন বিপ্লবীদের আত্মিক শক্তি জুগিয়েছে তেমন আমাদের দেশাত্মবোধের বোধের বিকাশে আজও এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে।