উন্নাওয়ের নাবালিকা ধর্ষণ মামলা ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসে শুধু একটি অপরাধের ঘটনা নয়– বরং ক্ষমতা, রাজনীতি ও বিচারব্যবস্থার পারস্পরিক সম্পর্কের এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশের উন্নাও জেলায় সংঘটিত এই ঘটনায় অভিযুক্ত ছিলেন শাসক দলের প্রভাবশালী বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গার।
দীর্ঘ আইনি লড়াই, নির্যাতিতার পরিবারকে ভয় দেখানো, দুর্ঘটনার নামে হত্যাচেষ্টা এবং সাক্ষীদের মৃত্যু— এই সব মিলিয়ে মামলাটি ক্রমশ এক ভয়াবহ রাজনৈতিক-সামাজিক দলিলে পরিণত হয়েছিল। সেই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত সেঙ্গারের সাজা স্থগিত রেখে জামিন দেওয়ার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত ফের নতুন করে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে– আইন কি সত্যিই সকলের জন্য সমান?
দিল্লি হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কুলদীপ সিং সেঙ্গার ইতিমধ্যেই দীর্ঘ সময় কারাবাস করেছেন এবং তাঁর আপিল বিচারাধীন থাকাকালীন সাজা স্থগিত রেখে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেওয়া যেতে পারে। আদালতের যুক্তি আইনগতভাবে ব্যাখ্যাযোগ্য হলেও সামাজিক ও নৈতিক স্তরে এই সিদ্ধান্ত তীব্র অস্বস্তি তৈরি করেছে। কারণ এখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি শুধু একজন ধর্ষক নন– তিনি একজন ক্ষমতাসীন জনপ্রতিনিধি ছিলেন, যাঁর প্রভাব খাটিয়ে নির্যাতিতার পরিবারকে দীর্ঘদিন ন্যায়বিচার থেকে দূরে রাখা হয়েছিল।
উন্নাও মামলার বিশেষত্ব এখানেই। সাধারণ কোনও ধর্ষণ মামলা নয় এটি। নাবালিকা নির্যাতিতার বাবাকে মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠানো হয়েছিল, যেখানে রহস্যজনকভাবে তাঁর মৃত্যু ঘটে। পরে নির্যাতিতা ও তাঁর পরিবারের উপর বারবার হামলা চালানো হয়। গাড়ি দুর্ঘটনায় দু’জন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর মৃত্যু হয়। এই সমস্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে মামলাটি কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআইয়ের হাতে যায় এবং শেষ পর্যন্ত সেঙ্গার দোষী সাব্যস্ত হন। অর্থাৎ, এখানে আদালত ইতিমধ্যেই অপরাধের গভীরতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার স্বীকার করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে সাজা স্থগিত রেখে জামিন দেওয়ার সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের কাছে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের জন্ম দেয়। ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধে, তাও নাবালিকার ক্ষেত্রে, যেখানে পকসো আইনের কঠোর ধারা প্রযোজ্য, সেখানে আদালতের এই নমনীয়তা কি ন্যায়বিচারের মূল দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? নাকি এটি আইনের অক্ষর ও ন্যায়ের আত্মার মধ্যে ক্রমবর্ধমান দূরত্বের আরেকটি দৃষ্টান্ত?
আইন অবশ্যই আবেগের দ্বারা চালিত হতে পারে না। প্রতিটি অভিযুক্তের আপিলের অধিকার আছে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্য, ন্যায়বিচার শুধু অভিযুক্তের অধিকারের প্রশ্ন নয়; নির্যাতিতার সুরক্ষা, সামাজিক আস্থা এবং ভবিষ্যতের জন্য বার্তা দেওয়াও এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। যখন একজন সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষক জামিনে মুক্তি পান, তখন সেই বার্তা সমাজের কাছে কী দাঁড়ায়, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের কাছে?
এই মামলায় উদ্বেগ আরও বাড়ে কারণ অভিযুক্ত ব্যক্তি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। ভারতে বহু ধর্ষণ মামলায় দেখা গিয়েছে, ক্ষমতাশালী অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে তদন্ত ও বিচার দীর্ঘসূত্রী হয়ে পড়ে। উন্নাও মামলা ব্যতিক্রম ছিল বলেই দেশজুড়ে তা এত আলোচিত হয়েছিল। সেই ব্যতিক্রমী মামলাতেই যদি শেষ পর্যন্ত এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে সাধারণ মামলাগুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক।
দিল্লি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া এবং শীর্ষ আদালতের স্থগিতাদেশ এই কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ। সুপ্রিম কোর্ট আপাতত সেঙ্গারের মুক্তি স্থগিত রেখেছে, যা অনেকের কাছে স্বস্তির। কিন্তু মূল প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, নাবালিকা ধর্ষণের মতো অপরাধে সাজা স্থগিত রেখে জামিন দেওয়ার নজির কি তৈরি হওয়া উচিত? যদি হয়, তাহলে পকসো আইনের কঠোরতা কোথায় দাঁড়ায়?
এই বিতর্ক নতুন নয়। এর আগেও বিভিন্ন মামলায় দেখা গিয়েছে, দীর্ঘদিন কারাবাসের যুক্তিতে সাজা স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু উন্নাও মামলায় সমস্যা এখানেই যে এটি শুধুই ‘কারাবাসের মেয়াদ’ নয়; এটি ক্ষমতার অপব্যবহার, সাক্ষী-সন্ত্রাস এবং বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার এক ধারাবাহিক ইতিহাস। এই অতীতকে উপেক্ষা করে কেবল সময়ের হিসাব কষে সিদ্ধান্ত নেওয়া কি যথেষ্ট?
নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলির ক্ষোভ তাই অমূলক নয়। তাঁদের মতে, এমন সিদ্ধান্ত নারী-নিরাপত্তা নিয়ে রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। দীর্ঘ লড়াই করে যে নির্যাতিতা ন্যায়বিচার পেয়েছিলেন, সেই ন্যায়বিচারই যদি বারবার অনিশ্চিত হয়ে ওঠে, তাহলে ভবিষ্যতে কতজন নির্যাতিতা আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার সাহস পাবেন, সে প্রশ্নও উঠছে।
অন্যদিকে, আইনজীবীদের একাংশ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বিচারব্যবস্থা প্রতিহিংসার যন্ত্র নয়। আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় সাজা স্থগিত রাখার বিধান আইনেই আছে। কিন্তু এখানেই সূক্ষ্ম পার্থক্যটি গুরুত্বপূর্ণ– আইনের সুযোগ আর ন্যায়ের ন্যূনতম নৈতিক মান এক নয়। বিচারব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা টিকে থাকে শুধু রায়ে নয়, সেই রায়ের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতায়ও।
উন্নাও মামলা তাই আজ একটি ব্যক্তিগত মামলার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। এটি হয়ে উঠেছে ভারতের বিচারব্যবস্থা কোন পথে হাঁটছে, তার একটি দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক ক্ষমতা কি এখনও আইনের ঊর্ধ্বে? নাবালিকা নির্যাতনের ক্ষেত্রে ‘শূন্য সহনশীলতা’র যে কথা বলা হয়, তা কি কেবল স্লোগানেই সীমাবদ্ধ?
সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে দেশ। সেই রায় শুধু কুলদীপ সিং সেঙ্গারের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে না, বরং এটি স্থির করবে— ভারতের বিচারব্যবস্থা নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিয়ে কী বার্তা দিতে চায়। উন্নাও মামলার শিক্ষা যদি শেষ পর্যন্ত ম্লান হয়ে যায়, তবে তা হবে শুধু একটি মামলার পরাজয় নয়, তা হবে ন্যায়ের ধারণারই এক গভীর অবনমন।
সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে দেশ। সেই রায় শুধু কুলদীপ সিং সেঙ্গারের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে না, বরং এটি স্থির করবে— ভারতের বিচারব্যবস্থা নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিয়ে কী বার্তা দিতে চায়। উন্নাও মামলার শিক্ষা যদি শেষ পর্যন্ত ম্লান হয়ে যায়, তবে তা হবে শুধু একটি মামলার পরাজয় নয়, তা হবে ন্যায়ের ধারণারই এক গভীর অবনমন।