পৃথিবীর উপাদানদের যথেচ্ছভাবে ব্যবহার, প্রকৃতির ভারসাম্যের নিরিখে অনেকটাই অবৈজ্ঞানিক এবং অদূরদর্শিতার প্রকাশ। লাগামহীন চাহিদা ও চাহিদার রকমফেরে পৃথিবীকে ইদানীং অতিমাত্রায় বিরক্ত করে আসছে মানুষ। পরিকল্পনা রূপায়ণে পাহাড়, নদী, সমুদ্র, জঙ্গল পরিবর্তন হয়ে চলেছে প্রতি নিয়ত। পরিকল্পনার খাতায় যেখানে পাহাড়ের প্রয়োজন নেই, সেখানে পাহাড় হটাও, জনবসতিকে নদী বিরক্ত করছে তো তাকে ঘুরিয়ে দাও, সমুদ্র উপকূলের অগভীর জায়গাকে ভরাট করে বসতি তৈরি করে নাও। আসলে প্রযুক্তির দম্ভে মানুষ মশগুল। বর্তমানই বিচার্য, ভবিষ্যৎ থাকুক ভবিষ্যতে।
অবশ্য পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এই ভূপ্রকৃতির পরিবর্তন নিয়ে নতুন ভাবে চিন্তিত। কারণ পাহাড়ের পাথর নিধন করে ভূমিরূপের পরিবর্তন ঘটানোর উদাহরণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে সারা পৃথিবী জুড়ে। যেখানে ভূমিরূপের ভারসাম্যের প্রশ্ন উঠে আসছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের কৈফিয়ৎ করতে যেন না হয়। তোমরা যে পাহাড়টাকে নষ্ট করলে বর্তমান চাহিদার নিরিখে, তোমাদের চাহিদাকে মেটাতে, সে যে ভবিষ্যতে আরো অনেককিছু দেবে বলে তৈরি ছিল।
আমাদের প্রজন্মকে বঞ্চিত করেছে তোমাদের চাহিদা ও পৃথিবীর সম্পদকে অবৈজ্ঞানিক ভাবে ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে। তাই বর্তমানে এই পাহাড়-নদী-সমুদ্র উপকূল-বনজঙ্গল সংরক্ষণের কথা সবার আগে ভাবা উচিৎ।
মানুষই পারে নিজের ভুল স্বীকার করে নিতে। তবে মানুষ পরিবেশ রক্ষার পদক্ষেপ নেয় নানান ভাবে। পাহাড়কে ও তার পাথরদের বাঁচাতে ইতিমধ্যে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে নানান প্রকল্প গ্রহণ করে নিয়েছে মানুষ। এই নিবন্ধে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের পাথরদের অভিনব কায়দায় সংরক্ষণের প্রয়াসকে তুলে ধরা হ’ল।
অযোধ্যা পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা বা গা থেকে গড়িয়ে নেমে আসা ছোট-বড় পাথরগুলোর একটা নিজস্বতা আছে। স্থানীয় মানুষদের কাছে আকাশে সূর্যের আসা-যাওয়ার মতো সত্যি এইসব পাথরের দলবল। শুধু স্থানীয় মানুষদের কাছেই নয়, বাইরের মানুষদের কাছেও এদের আদর কম নয়। অনেক শিল্পীর চোখে এইসব ছোটো-বড় পাথরগুলো এক-একটা ভরাট ক্যানভাস। আবার অন্যদিকে ব্যাবসায়িকদের কাছে এইসব পাথর অর্থ উপার্জনের গুদামঘর। এদের ভাঙ্গতে পারলেই রাস্তা-ঘাট, বাড়ি-ঘর, মস্ত বড় বড় বাঁধ তৈরির বিশ্বাসী উপাদান। তাদের কাছে অর্থ উপার্জনের অঢেল প্রতিবাদহীন বোবা পাথরের বোল্ডার ছাড়া আর কিছুই নয়।
যথেচ্ছভাবে অযোধ্যা পাহাড়ের গা থেকে পাথর চুরির ফলে অযোধ্যার স্থায়ীত্বের প্রশ্ন দানা বাঁধে স্থানীয় অসহায় মানুষদের মনে। চোখের সামনে রোজের সঙ্গী পাথরগুলো চলে যায় গাড়ি ভর্ত্তি করে শহরের পথে পাথুরে ধুলো উড়িয়ে। প্রতিবাদ যে স্থানীয় আদিবাসী মানুষরা করেননি, তা নয়। তবে টাকার আদান-প্রদানের শক্তির কাছে হার মেনে যায়। যেমন প্রথমটাতে হার মেনেছিল বীরভূম জেলার ‘মামা-ভাগ্নে’ পাহাড়ের পাথর লুট হয়ে যাওয়া আটকানোর প্রতিবাদ মিছিল।
মালদা-মুর্শিদাবাদের গঙ্গার ভাঙ্গন রুখতে হাজার হাজার পাথর চলে যেতে শুরু করেছিল মামা-ভাগ্নে পাহাড়ের গা থেকে। গড়িয়ে নেমে আসা বোল্ডারদের নিয়ে চলে যেতো ঝক্ঝকে দিনের আলোকে সাক্ষী রেখে। তবে এক জোড়ালো প্রতিবাদে স্থানীয় মানুষরা পেরেছিলেন মামা-ভাগ্নে পাহাড়ের সৌন্দর্য্যকে স্থায়িত্ব দিতে। আজ একটা ছোটো পাথরের টুকরোও কেউ নিয়ে যেতে পারেন না লম্বা পাঁচিল দিয়ে ঘিরে রাখা মামা-ভাগ্নে পাহাড় থেকে।
অযোধ্যাকে ঘিরেও প্রতিবাদ হয়। তবে সে প্রতিবাদ হয় অন্য ধারায়। শিল্পী চিত্ত দে, নিজের চেষ্টায় অযোধ্যায় গায়ে খোদাই করে এঁকে দিলেন এক ঝাঁক উড়ন্ত পাখি। গড়িয়ে নেমে আসা পাথর খণ্ডের ওপর স্থানীয় জীবজন্তুদের ছবি আঁকলেন খোদাই করে। যাকে বলে ‘ইন্ সিটু রক কার্ভিং’। সঙ্গে নিলেন শিল্পীমনস্ক পাহাড়-জঙ্গলের সেইসমস্ত মানুষদের যাঁরা জন্মগতভাবে শিল্পী মনস্ক প্রকৃতির উঠোনে। অযোধ্যা পাহাড়ের গন্ধ গায়ে নিয়ে।
পাথরের ওপর খোদাই-এর মাধ্যমে ভূমিরূপ সংরক্ষণের কাজ হ’ল ভীষণ ভাবে। পাথর ব্যবসায়ীরা বাধা পেলেন। চিত্ত বাবুকে থানা-পুলিশ করতে হ’ল না অযোধ্যার স্থায়ীত্বের জন্য। শিল্পীমনস্ক স্থানীয় মানুষরা তাদের সুঠাম দেহে আর নিষ্পাপ চোখের চাহনিতে আটকে দিলেন অযোধ্যার গা থেকে পাথর ভেঙ্গে নিয়ে যাওয়াকে।
সমালোচনা সব কাজেরই করা যায়। প্রথম দিকে চিত্ত দের এই কার্যকলাপ সমালোচিত হয়েছিল ভীষণভাবে। উনি নাকি অযোধ্যা পাহাড়ের গায়ে এইসব রক্ কার্ভিং করে পাহাড়টার সর্বনাশ করছেন। স্থানীয় মানুষদের ভুলভাবে ব্যবহার করছেন। বিপথে চালিত করছেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, সমাজমাধ্যমে চিত্তবাবু চর্চিত হতে থাকেন নানানভাবে।
প্রকৃতি প্রেমের মানসিকতায় চিত্ত দে আমার খুব কাছের মানুষ। ওনার এই ইন্ সিটু রক কার্ভিং বিষয়টা আমি আমার বিষয় ভূগোলের জ্ঞানবুদ্ধিতে বিশ্লেষণ করে বহুল প্রচারিত কলকাতার একটি পত্রিকায় সবিস্তার চিঠি লিখি। লিখি যে, মানুষের চাহিদায় পৃথিবীর নানান পাহাড়, পর্বত, নদী-নালা আজ আক্রান্ত। ভূমিরূপের অবৈজ্ঞানিক পরিবর্তন পাহাড়, নদীদের স্থায়িত্বের প্রশ্নের সামনে এনে দিয়েছে। যাকে আমরা ভূগোলবিদ্রা ‘ল্যাণ্ডস্কেপ সাস্টেনেবিলিটি’-র সমস্যা বলে বিবেচনা করি। ভূমিরূপের স্থায়িত্ব আজ ভীষণভাবে বিপন্ন।
চিত্তবাবু এই পাহাড়ের গায়ে ও তার আশপাশে ছড়িয়ে থাকা পাথরের ওপর খোদাই করে ছবি আঁকা স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে নিয়ে, আমার চোখে এক অনন্য উপায়, যাতে করে আমার-আপনার স্বপ্নের অযোধ্যা পাহাড় স্থায়িত্ব পেয়ে যাবে। যাবে শুধু নয়, পেয়ে গেছে। কারণ স্থানীয় মানুষরা দু’হাত দিয়ে আগলে রাখছেন তাদের নিজেদের আঁকা ছবিদের। আর পর্যটকদের ঘুরে ঘুরে গল্প করতে করতে সমস্ত পাহাড়টাকে দেখিয়ে রোজগারের রাস্তা পেয়েছেন। অযোধ্যা এখন স্থানীয় মানুষদের স্বপ্ন দেখার গল্প শোনায়।
অযোধ্যা পাহাড়ের স্থায়িত্ব শুধু নয়, পাশাপাশি স্থানীয় মানুষদের অযোধ্যা পাহাড়ের গা ঘেঁষে জীবনগাথা আজ আত্মতৃপ্তি পেয়েছে আপনার ভাবনায়, আপনার প্রচেষ্টায়। আপনাকে এক আকাশ প্রকৃতি ছোঁয়া অভিনন্দন জানাই। চিত্ত দে মহাশয় আপনাকে নমস্কার।