দুই থেকে তিন সন্তান

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

ভারতের জনসংখ্যা এই মুহূর্তে ঠিক কত তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকারিভাবে বলা হয়নি। কিন্তু তরুণদের তুলনায় বয়স্কদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। এটা দেশের পক্ষে ভালো লক্ষণ নয়। তরুণদের সংখ্যা সত্যিই যদি বাড়তেই থাকে, তাহলে দেশে কর্মসংস্থান যেভাবে সঙ্কুচিত হচ্ছে, বেকারের সংখ্যা আরও বাড়বে। কারণ দেশে নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের পরিমাণ ক্রমশই কমে যাচ্ছে। যার ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে বেকারদের হাহাকার। কেন্দ্রীয় এনডিএ সরকারেরও বেকারের সংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেদিকে কোনও নজর নেই। ঘরে ঘরে বেকার। আর উচ্চশিক্ষায় ডিগ্রিধারীরা উপযুক্ত কাজের সুযোগ না পেয়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে।

এই অবস্থা যখন চলছে, তখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান মোহন ভাগবত তাঁর উল্টো পথে হেঁটে সম্প্রতি বলেছেন, সন্তান উৎপাদনের হার কমে যাওয়া দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে উঠছে। এর ফলে দেশের জনসংখ্যা কমে যাবে এবং সমাজে একটি অস্থির অবস্থার সৃষ্টি হবে। তাই তিনি বলেছেন, নতুন বিবাহিত দম্পতিদের অন্তত দুই থেকে তিনটি সন্তানের জন্ম উচিত। সম্প্রতি এক জনসভায় বক্তৃতাকালে আরএসএস প্রধান বলেছেন, সন্তান উৎপাদনের হার প্রতি মহিলা পিছু ২.১ হলে জনসংখ্যাও ঠিক থাকবে। কিন্তু মোহন ভাগবতের কথায়, প্রতি মহিলা পিছু সন্তানের হার ২.১ থেকেও কমে যাচ্ছে, যা উদ্বেগের। তাই তিনি বলেছেন, নতুন বিবাহিত দম্পতিদের দুই থেকে তিনটি সন্তানের জন্ম দেওয়া উচিত।

আরএসএস প্রধান যা বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সমীক্ষায় তাতে সায় দিয়ে বলা হয়েছে, সন্তান উৎপাদনের হার ২.১ হলে জনসংখ্যা আগের মতই থাকবে। সমীক্ষা বলেছে সন্তান উৎপাদনের হার এর থেকে কমে যাচ্ছে, ফলে দেশে তরুণদের সংখ্যা কমছে আর বয়স্কদের সংখ্যা বাড়ছে। দেশের পক্ষে সেটা ভালো লক্ষণ নয়। আর বয়স্কদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তাদের কাছ থেকে দেশের উন্নতির জন্য কিছু পাওয়া যাবে না, উল্টে তারা সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু যে প্রশ্ন দেশের সব মানুষকে নাড়া দিচ্ছে, তা হল, শুধু সন্তান উৎপাদন করলেই হবে না, সেই সঙ্গে এরা যখন বড় হবে, পড়াশুনো শেষ করে ডিগ্রিধারী হবে, সঙ্গে সঙ্গে তাদের জন্য কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে বাড়তি যুবক-যুবতীরা হন্যে হয়ে চাকরির জন্য ঘুরবে এবং নিরক্ষররা নানা অসামাজিক কাজে লিপ্ত হবে, যা সমাজের পক্ষে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।


সুতরাং জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থানেরও বৃদ্ধি পাওয়া বিশেষ জরুরি। দেশের তিন-চতুর্থাংশ রাজ্যে সন্তান উৎপাদনের হার কমছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কয়েক বছর আগে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে চ্যালেঞ্জ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। বলেছিলেন কেন্দ্র ও রাজ্যে সরকারকে এর মোকাবিলা করতে হবে। ভারতের জনসংখ্যা কেউ বলে ১৪০ কোটি, কেউ বলে তার চাইতে কম ১৩৭ কোটি।

আরএসএস প্রধান জনসংখ্যার হার বাড়াতে বলায়, অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে কি তিনি হিন্দুদের বেশি করে সন্তান উৎপাদন করতে বলছেন? এই ভাগবতই কয়েক বছর আগে জনসংখ্যার ভারসাম্য রক্ষার নীতি তৈরি করার কাজ নিয়েছিলেন। কিন্তু সে ডাকে সাড়া মেলেনি কেন্দ্রীয় সরকারের। এই ভারসাম্য রক্ষা করার কথায় তিনি আসলে বলতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে মুসলিম জনসংখ্যা উদ্বেগের সঙ্গে বাড়ছে। কারণ অনেক মুসলিমরাই সন্তান উৎপাদন কমানোর পক্ষপাতি নয়। তাঁরা মনে করে এটা শরিয়ত বিরোধী। ফলে সীমান্তবর্তী কয়েকটি রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। বাড়ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির মুসলিম জনসংখ্যাও। আর হিন্দুদের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। ফলে ভারসাম্য বজায় থাকছে না। এই ভারসাম্য যদি কমতেই থাকে, তা দেশের পক্ষে মঙ্গলকর নয়।

যদিও প্রধানমন্ত্রী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ডাক দিয়ে বলেছিলেন সমাজের একটি অংশ অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে সচেতন— অপর অংশ তা ভাবছে না। তারা কখনও মনে করে না ছোট পরিবার সুখী পরিবার। মুখে প্রধানমন্ত্রী জনসংখ্যা নিয়ে এইসব বললেও, গত পাঁচ বছরে মোদী সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতি নিয়ে কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুযায়ী, ধর্মমত নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়েরই সন্তান উৎপাদনের হার ২.১ এর নীচে। অর্থাৎ অদূর ভবিষ্যতে জনসংখ্যা কমে যাওয়া এবং জনসংখ্যায় তরুণদের সংখ্যার তুলনায় বয়স্কদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কাছেই চিন্তার কারণ।

স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুযায়ী হিন্দুদের সন্তান উৎপাদনের হার ১.৬, মুসলিমদের ১.৮, খ্রিস্টানদের ১.৭। সব থেকে কম বৌদ্ধদের, মাত্র ১.২। গোটা বিশ্বে এই মুহূর্তে ভারতের লোকসংখ্যা সবচাইতে বেশি। রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের লোকসংখ্যা ২০৩২ সালে ১৭০ কোটিতে গিয়ে পৌঁছতে পারে। চিনের জনসংখ্যা আগে সবচাইতে বেশি ছিল, কিন্তু জন্ম নিয়ন্ত্রণ করার ফলে এই দেশের জনসংখ্যা আগের তুলনায় কম।