স্বপনকুমার মণ্ডল
সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না, কিন্তু তার জন্য বস্তুবিশ্বের অনেককিছুই প্রতীক্ষা করে থাকে । মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির আধারে সময়ের অপরিমেয় ভূমিকা আপনাতেই অধীর আগ্রহ ও আস্থায় ক্রমশ বিস্তৃতি লাভ করে। এজন্য তাতে গরমিল হলে আবারও তার প্রতীক্ষার প্রস্তুতি চলে, আস্থায় প্রহর গোনে। ‘একদিন চিনে নেবে তারে’ থেকে ‘সময়ই শেষ কথা বলবে’র মধ্যে তার সুদৃঢ় প্রত্যয় ভর করে। আবার সব সময় যে তা প্রত্যাশা পূরণ করে, তাও নয় । অনেক ক্ষেত্রেই তার প্রাপ্তিতে ‘চেনা’র মধ্যে ‘শেষ কথা’র পরিচয় স্পষ্ট নয়, প্রত্যাশা পূরণ তো দূর অস্ত । সময়ের মূল্যায়নে আস্থা ও প্রতীক্ষাই সেখানেই প্রশ্নচিহ্নের সামনে চলে আসে । অবশ্য সবকিছুর মূল্য যে নির্ধারণ করা যায় না, সময়ই সেই অমূল্যকেই চিনিয়ে দেয় যা আমরা সহজ ভাবে মেনে নিতে পারি না । এই না-মানার আধারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা বিশেষভাবে স্মরণীয়। তাঁর দুশো বছর পূর্তিতে বাঙালিসমাজমানসে যেভাবে প্রত্যাশার মেঘ তৈরি হয়েছিল, তা তার ছিটেফোঁটা বৃষ্টিতেই আশাহত করে তুলেছে । তাঁর মতো অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব জীবিতকালেই বাঙালি জনমানসে যে কিংবদন্তি বিস্তৃতি লাভ করেছিল, তার ব্যাপক জনসমাদরের আধারে সেই প্রত্যাশা সক্রিয় করে তুলেছিল । সমকালীন পরিসরের তীব্র বিরোধিতাই মৃত্যর উত্তরকালের অবকাশে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে থাকে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দিকে তাকালেই তা সহজেই অনুমেয়। সেদিক থেকে উনিশ শতকের আধুনিক পরিসরে জ্ঞানবিজ্ঞানের আলোতে বাঙালির সমাজমানসে যেভাবে উৎকর্ষমূলক বিস্তৃতি এসেছিল, তাতে বিদ্যাসাগরের অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের অসাধারণত্ব শ্রদ্ধা ও সমাদরে সর্বব্যাপী ঈশ্বরপ্রতিম বিস্তারের সম্ভাবনা ছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবর্তে ‘বিদ্যাসাগর’-এ বিপুল জনপ্রিয়তা জীবিতকালেই মিলেছিল, তা তাঁর স্বনামের প্রয়োজনহীনতাতেই প্রতীয়মান। অন্যদিকে তাঁর সমকালে তাঁর মতো বাঙালির ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ার নিদর্শনও আর কারও নেই। অতিদ্রুততার সঙ্গে তিনি কিংবদন্তি চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণ্যে বিদ্যাসাগরের উপস্থিতি আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে । বিদ্যাসাগর নামেই তাঁর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাবোধ উঠে আসে। সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব তাঁর দুশো বছরে পূর্তিতেও বাঙালির মানসলোকে অদ্বিতীয় সত্তায় আলোড়িত হয়ে ওঠেনি, তাঁর অমানুষিক ভূমিকা লাভ করেনি যথার্থ জনসমাদর ও শ্রদ্ধা, সুশিক্ষিত বনেদি সুধীসমাজেও অদ্ভুত নীরবতা সেখানে! অন্য পাঁচজন কৃতী বাঙালির স্মরণের ন্যায় বিদ্যাসাগরের প্রতি সাময়িক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন বিস্ময়কর ভাবেই সমান সচল। অথচ তা অস্বাভাবিক মনে হলেও স্বাভাবিক, অপ্রত্যাশিত হলেও বিস্ময়কর নয় ।
আসলে বিদ্যাসাগরের বহুমুখী ব্যক্তিত্বের আধারে জনপ্রিয় চরিত্রপ্রকৃতি তাঁর জীবিতকালেই অনন্যসাধারণ বিভূতি লাভ করেছিল । সেখানে তাঁর বিস্তৃতি যেভাবে জনসাধারণের মধ্যে বিস্তৃতি লাভ করেছিল, বিদ্বৎসমাজের সমাদর লাভে তা শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেনি । তাঁর অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব ধর্ম-সমাজ-গোষ্ঠীতে আচ্ছন্ন রক্ষণশীল বনাম প্রগতিশীল দ্বন্দ্বমুখর জনমানসে বিতর্কের আধারে সক্রিয় ছিল আজীবন । সেখানে তিনি কোনো পন্থী ছিলেন না, বরং একক প্রবল ব্যক্তিত্বে পথিকৃৎ হয়ে ওঠায় বিতর্কের লক্ষ্যে নানাভাবেই আক্রমণের শিকার হয়ে উঠেছেন। অথচ সেখানে তাঁর হয়ে কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠী বা সমাজ প্রত্যক্ষত সক্রিয় ভাবে এগিয়ে আসেনি, দেয়নি সহযোদ্ধার পরোক্ষ সাহারা। তাঁকে একক শক্তিতেই ধর্মীয় ও সামাজিক ভাবে বৃহত্তর ঐতিহ্যবাহী জনশক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছিল। সেদিক থেকে রাজা রামমোহন রায়ের চেয়েও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্মমুখর জীবন ছিল আরও দুরূহ, আরও বিপদসঙ্কুল এবং রীতিমতো অস্বাভাবিক। আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা(১৮১৫) করে রামমোহন তাঁর ব্রাহ্মধর্ম ও ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার পরিসরে যেভাবে সতীদাহ প্রথাকে রোধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রথা চালু করা ছিল তার চেয়ে অনেকবেশি কষ্টকল্পনার। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, সতীদাহ প্রথা রোধ সময়ান্তরে মেনে নেলেও বিধবাবিধবা আজও পরিপূর্ণ ভাবে প্রচলিত হয়নি। সেখানে রামমোহনের সাফল্য যেমন তাঁকে প্রশ্নহীন আনুগত্যে শ্রদ্ধেয় করে তুলেছে, বিদ্যাসাগরের সাফল্য প্রচলনের অভাবে শুধু প্রশ্নের সামনেই দাঁড় করায়নি, তা নামান্তরে অস্বীকারে সামিল করেছে। আসলে বিধবাবিবাহের মত ও পথ দুটিই ছিল হিন্দুসমাজমানসে অভাবিত, অকল্পিত। সহমরণের মধ্যে যে প্রত্যক্ষ অমানবিকতা ছিল, তা দিনের আলোর মতোই জনমানসে নিবিড় হয়ে উঠেছিল। তার প্রতি সাধারণ্যে অপ্রত্যক্ষভাবে সহমর্মিতার অবকাশ তো ছিলই। সেই সঙ্গে নবজাগরিত আধুনিকতায় মানবমুখী চেতনার আলোয় সংস্কারান্ধ হিন্দুসমাজের নির্মম বর্বর সতীদাহ প্রথার প্রতি প্রত্যক্ষভাবে বিরূপ মানসিকতাও জুড়ে গিয়েছিল । সেদিক থেকে তার প্রতিরোধে রামমোহনের উদ্যোগে সেই সংস্কারের বিরূপতায় মানবিক সহানুভূতির নিবিড় যোগও সক্রিয় ছিল। অন্যদিকে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজের সমর্থনও পেয়েছিলেন রামমোহন রায়। এদেশে ১৮২৯-এর ৪ ডিসেম্বর সরকারি ভাবে সতীদাহ রোধ হলেও ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যাতে সেই বিল পাশ হয়ে স্থায়িত্ব লাভ না করে সে-বিষয়ে রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের তৎপরতার বিরুদ্ধে রামমোহনের বিলেত যাত্রায় দ্বারকানাথ ঠাকুর অর্থ দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। অবশ্য হিন্দুধর্মের কুসংস্কার দূর করার ক্ষেত্রে ব্রাহ্মসমাজের সবিশেষ ভূমিকা বর্তমান। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রবর্তনেও তার অবদান বিশেষভাবে উল্লেখ্য। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তত্ববোধিনী সভা’ ও ‘তত্ববোধিনী পত্রিকা’র(১৮৪৩) সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে নিবিড় যোগ ছিল বিদ্যাসাগরের । তাঁর ‘বিধবাবিবাহ প্রচলন হওয়া উচিত হওয়া কিনা’ শিরোনামে বহুচর্চিত সুদীর্ঘ প্রবন্ধটি প্রথমে ‘তত্ববোধিনী পত্রিকা’র ১৩৯ সংখ্যায় (১৭৭৬ শকাব্দের ফাল্গুন) প্রকাশের পর হয়ে ১৮৫৫-এর জানুয়ারিতে পুস্তকাকারে বেরিয়েছে । পত্রিকায় প্রকাশের পরেই বিষয়টি সাধারণ্যে তীব্র আলোড়ন দেখা দিয়েছিল। এবিষয়ে পত্রিকার পরের সংখ্যাতেই(১৪০) সম্পাদকীয়তেই তার সদর্থক প্রকাশ : ‘কয়েক বৎসরের মধ্যে বিধবাগণের পুনঃ সংস্কার প্রচলিত হইবার বিষয় এতদ্দেশে বারম্বার উত্থাপিত হইয়াছে, কিন্তু এ বৎসর এই বিষয় লইয়া যাদৃশ আন্দোলন উপস্থাপিত হইয়াছে, তাদৃশ আন্দোলন অন্য কোন বৎসর হয় নাই। শ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত বিধবাবিবাহ বিষয়ক যে পুস্তক পূর্ব্বমাসে পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাই ঐ আন্দোলনের মূলীভূত ।………’
আসলে সতীদাহ প্রথা সরকারি ভাবে নিষিদ্ধ (১৮২৯) হওয়ার পরে সমাজে বিধবাদের করুণ পরিণতি দূর করার মানসে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নানা ভাবে লেখালেখি শুরু হয়েছি যা ক্রমশ বিস্তার লাভ করে। পূর্বোক্ত সম্পাদকীয়তেও তা প্রতীয়মান। সেক্ষেত্রে ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর সক্রিয় উদ্যোগ বিশেষভাবে স্মরণীয়।
‘জ্ঞানান্বেষণ’(১৮৩১-১৮৪৪), ‘এনকোয়ার’(১৮৩১) ও ‘দ্য বেঙ্গল স্পেপ্টেটর’(১৮৪২-এর এপ্রিল-১৮৪৩-এর ২০নভেম্বর) প্রভৃতি পত্রিকায় বিধবাদের দুরবস্থা ও তার সুরাহায় পুনঃবিবাহের কথা নানা লেখায় প্রাধান্য লাভ করেছিল । সেই প্রগতিশীল গোষ্ঠীর প্রতি রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের বিরূপ মানসিকতায় তা যেমন বিমুখতা লাভ করে, তেমনই যুক্তির চেয়ে শাস্ত্রের বিধানেই আস্থাশীল সমাজে তা গুরুত্ব লাভ করেনি। আরও একটি বিষয়ও উল্লেখ্য। দ্বিভাষিক পত্রিকাগুলিতে বিধবাবিবাহ বিষয়ক লেখাগুলি ইংরেজিতে প্রকাশিত হওয়ায় তার প্রচার স্বাভাবিকভাবেই সীমিত ছিল । স্বয়ং বিদ্যাসাগরও বেনামীতে ১৮৪২-এর এপ্রিলের ‘দ্য বেঙ্গল স্পেক্টেটর’-এ বালবিধবাদের বিয়ের পক্ষে লিখেছিলেন। অন্যদিকে ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকেও বিধবাবিবাহ নিয়ে রীতিমতো সক্রিয় উদ্যোগ চলছিল। ১৮৫৪-এর ১৫ ডিসেম্বর কাশীপুরের কিশোরীচাঁদ মিত্রের ভবনে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে যে ‘সমাজোন্নতিবিধায়িনী সুহৃৎ সমিতি’ গড়ে তোলা হয়েছিল, তার মধ্যে ‘স্ত্রীশিক্ষার প্রবর্তন, হিন্দু-বিধবাদের পুনর্বিবাহ প্রচলন, এবং বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিরোধ’ প্রভৃতি বিষয়গুলি প্রধান্য লাভ করে।
উল্লেখ্য, ১৮৫৪-তেই(১৬ আগস্ট) প্যারীচাঁদ মিত্র ও রাধানাথ সিকদার সম্পাদিত ‘স্ত্রীলোকের জন্য’ ‘মাসিক’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সেই সুহৃৎ সভায় কিশোরীচাঁদসহ রাধানাথ সিকদার, রসিককৃষ্ণ মল্লিক ও তারকনাথ সেনের মত উচ্চশিক্ষিত কৃতবিদ্যদের বিধবাবিবাহের সক্রিয় উদ্যোগ বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। সেদিক থেকে বিধবাবিবাহ নিয়ে প্রগতিশীলদের মধ্যে যে ক্রমশ সক্রিয় উদ্যোগ চলেছিল, তা সহজেই অনুমেয় । অন্যদিকে বিদ্যাসাগর সমাজের নারীদের দুর্গতিমোচনে যে-সব মহৎ কর্মে ব্রতী হয়েছিলেন, সেগুলোরও উদ্যোগী প্রয়াস নানাভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল । সেক্ষেত্রে তাঁর সক্রিয় ভূমিকায় যেভাবে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, তার মূলে ছিল তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বের আলো । বিদ্যাসাগর কোনো ধর্মীয় সমাজ গড়ে তোলেননি বা কোনো ধর্মীয় পরিচয়ে নিজেকে বিস্তার করেননি । সেদিক থেকে তাঁর মনীষা ও মহামানবীয় ব্যক্তিত্বই তাঁকে প্রভাবশালী করে তুলেছিল । ইতিমধ্যে তাঁর বিদ্যাসাগরীয় পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছিল । সেক্ষেত্রে বিধবাবিবাহের প্রয়োজন যত তীব্রতা লাভ করে, তার আয়োজনে তত মরীয়া প্রয়াস ছিল না । কোনো ধর্মীয় সমাজের সক্রিয় ভূমিকা তাতে সদর্থক হয়ে ওঠেনি । ব্রাহ্মসমাজের দিক থেকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিধবাবিবাহে রক্ষণশীলতাকে পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ‘তত্ববোধিনী’ পত্রিকায় বিদ্যাসাগরের বিধবাবিষয়ক লেখাটি ছাপা হয়েছিল বিশেষ করে পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্তের জন্য । তাঁর ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না এবং বিদ্যাসাগরের অনুরাগী ছিলেন। অক্ষয়কুমার সেই সময় অসুস্থ অবস্থায় সেই সম্পাদকীয়ই লেখেননি, বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহের দ্বিতীয় প্রস্তাব প্রকাশিত হওয়ার (১৮৫৫) পর তা থেকে ‘তত্ববোধিনী পত্রিকা’র ১৪৮ সংখ্যায় ‘বিধবাবিবাহবিষয়ক দ্বিতীয় পুস্তকের উপক্রমভাগ’ ও উপসংহারভাগও প্রকাশ করেন। ঐরকম একটি পত্রিকায় বিদ্যাসাগরের স্বনামে প্রকাশিত প্রবন্ধটি যেভাবে ধর্মশাস্ত্রকে অস্ত্র করে ঝলসে উঠেছিল, তাতে স্বাভাবিক ভাবেই সমাজমানসে তীব্র আলোড়ন পড়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, স্বয়ং বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ বিষয়ক দ্বিতীয় পুস্তকের(১৮৫৫-এর অক্টোবর) সূচনায় আশাতীত সাড়া ফেলে দেওয়ায় পুনর্মুদ্রণে উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করেছেন। আবার প্রথম পুস্তকের দ্বিতীয়বারের বিজ্ঞাপনেও (১ আশ্বিন, সংবৎ ১৯১৪) তাঁর উদ্দেশ্য সফলে আত্মতৃপ্তির পরশ ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর সেই প্রাণান্তকর অসাধাসাধন ১৮৫৬-এর ২৬ জুলাই সরকারি ভাবে স্বীকৃতি পেলেও জনমানসের মান্যতার অভাববোধে বিতর্ক অব্যাহত থাকে।
রামমোহন রায় সতীদাহ নিবারণে যেভাবে স্বীয় ব্রাহ্মসমাজের সাহায্য ও মানবিক আবেদনে জনমানসের সমর্থন পেয়েছিলেন, বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রবর্তনে তা যে ছিল না, আইন জারি হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে তার কার্যকারিতার অভাবেই তা স্পষ্ট। সেক্ষেত্রে সতীদাহ প্রথা বন্ধ হওয়ার পর বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের মাঝে দীর্ঘ প্রায় সাতাশ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটানোর পথটি কত দুর্গম ছিল, তা তার গন্তব্যে পৌঁছেও পথিকের সাফল্যকে না মেনে নেওয়ার মধ্যেই প্রতীয়মান। সাফল্যই যেখানে সর্বনেশে, ব্যর্থতা সেখানে সাফল্যে গ্রহণের অন্ধকার হয়ে ওঠে । তখন সাফল্যের প্রয়োগ থেকে প্রয়োজনীয়তা সবেতেই ব্যর্থতার আগ্রাসী অন্ধকার নেমে আসে। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলনে তাঁর সাফল্যের সূর্য যেমন ছড়িয়ে পড়েছিল, তেমনই তার গ্রহণের অন্ধকার বিতর্কের নামান্তরে অস্বীকার করার প্রবণতায় সক্রিয় ছিল। সেক্ষেত্রে সময়ান্তরে সেই গ্রহণের অন্ধকার কমে এসেছে ঠিকই, কিন্তু সমাজের রক্ষণশীল মানসিকতায় তার রেশ অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে বিধবাবিবাহ প্রচলনে বিদ্যাসাগরের নাম যেমন দীর্ঘদিনের দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ আবিষ্কারের ন্যায় দ্রুততার সঙ্গে জনপ্রিয়তা অর্জন করে, তেমনই তাতেই তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি বিরূপ সমালোচনা নেমে আসে ।
সময়ান্তরে তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বিধবাবিবাহ প্রচলন অবিচ্ছেদ্য মিথে পরিণত হলেও তার বিরূপ দৃষ্টি নানাভাবে উঠে এসেছে। বিধবাবিবাহ প্রবর্তনকে বিদ্যাসাগর নিজেই তাঁর জীবনের সেরা কাজ হিসাবে অভিহিত করেছেন। তাঁর কথায় : ‘বিধবা-বিবাহ প্রবর্ত্তন আমার জীবনের সর্ব্বপ্রধান সৎকর্ম্ম, জন্মে ইহার অপেক্ষা অধিক আর কোন সৎকর্ম্ম করিতে পারিব, তাহার সম্ভাবনা নাই ; এ বিষয়ের জন্য সর্ব্বস্বান্ত করিয়াছি এবং আবশ্যক হইলে প্রাণান্ত স্বীকারেও পরাঙ্মুখ নই।’ অথচ বিদ্যাসাগরের সেই ‘সৎকর্ম’ তাঁকে যতই মহত্তর ও বৃহত্তর পরিসরে জনপ্রিয় করে তুলুক না কেন, তার মূল্যায়নের অভাবে অবমূল্যায়নের প্রবণতাকে সক্রিয় করে তুলেছে। স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই তাঁর বিধবাবিবাহ প্রচলনকে সমর্থন করেননি। সেই অস্বীকারের ধারা সময়ান্তরে কেটে গেলেও তার প্রতি যে মহত্তর চেতনার অভাব ছিল, তা তাঁর দুশো বছর পূর্তিতেও নানাভাবে উঠে এসেছে। একালের স্বনামধন্য ইতিহাসচর্চাকারী দীপেশ চক্রবর্তী তাঁর সাক্ষাৎকারে (‘দেশ’, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৯) অকপটে বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলনে বিধবাদের যৌবন রক্ষার পথ খুঁজে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। তাঁর কথায় : ‘বিদ্যাসাগরের কাছে বিধবার প্রশ্নটা কী ? বিদ্যাসাগরের কাছে বিধবা হওয়াটা একটা কেচ্ছার সমস্যা— যে ইহাদের যৌবন আছে, সুতরাং বিবাহ দিয়া দাও, যাতে যৌবন একটি সঠিক পথ খুঁজে পায়।’ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী(চিন্ময় গুহ) তাঁকে ‘এটা অকরুণ হল বিদ্যাসাগরের প্রতি’ বলে ‘তাঁর সহমর্মিতার দিকটা’ স্মরণ করিয়ে দিলে দীপেশ চক্রবর্তী ‘সহমর্মিতা’ স্বীকার করেও নিজের বক্তব্যে অবিচল থাকেন, ‘বিদ্যাসাগরের তর্কটা একটা স্তরের পর কিন্তু তা-ই ।’ যেখানে ভালোভাবে বেঁচে থাকাই দায়, সেখানে যৌবনের সুরক্ষা বিলাসিতা মনে হয়। সেকালের হিন্দুসমাজে পরনির্ভরশীল নারীর বৈধব্যে যৌবনের দায়ের চেয়ে অমানবিক দাসত্বই প্রাধান্য লাভ করে। সেক্ষেত্রে পুনর্বিবাহে সবকূল বজায় স্বাভাবিক জীবনের পথকে সুগম করাই ছিল জরুরি। বিদ্যাসাগর সেই জরুরি কাজটিকেই জীবনব্রত করেই সম্পন্ন করেছেন। এজন্য জীবনের অনেক মূল্য চোকাতে হয়েছিল। আবার সমাজসংস্কার আন্দোলনে তাঁর বিধবাবিবাহ যখন সাধারণ্যে মিথ হয়ে উঠেছে, সেখানেও তাতে সাধারণীকরণের ঝোঁক এসে পড়েছে । তাঁর ভূমিকা যে সেখানে অবিসংবাদিত, তা উপেক্ষিত
হয়ে পড়ে ।
গোলাম মুরশিদের তাঁর ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’(জানুয়ারি ২০০৬) বইয়ে ‘বেঙ্গল স্পেক্টর’ পত্রিকায় ‘সংস্কৃত কলেজের ছাত্র’ থাকাকালীন বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের পক্ষে প্রবন্ধ লেখার কথা জানিয়েছেন এবং তাঁর বিধবাবিবাহ প্রচলন সম্পর্কে বলেছেন: ‘মোট কথা, বিয়ের আইন পাশ হওয়া সত্বেও, বিধবাদের বিয়ে কমই হয়েছিলো। কিন্তু এটা ছিলো রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে একটা প্রতীকী বিজয় । তা ছাড়া, এর ফলে বিধবাদের দুঃখকষ্ট সম্পর্কে সমাজের সচেতনতা সামান্য বেড়েছিলো বলে মনে হয় ।’ প্রথমত, ১৯৪২-এর এপ্রিলে ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’-এ যখন বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের পক্ষে লেখাটি প্রকাশিত হয়, তখন তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপক। ১৮৪১-এ সংস্কৃত কলেজে শিক্ষা সমাপ্ত করে সেবছরের ২৯ ডিসেম্বর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে কর্মজীবন শুরু করেন। আর প্রবন্ধটিও লিখেছিলেন বেনামে। দ্বিতীয়ত, বিধবাবিবাহ প্রবর্তনকে ‘প্রতীকী বিজয়’ বলে আসলে যেভাবে তাকে লঘু করা হয়েছে, তার মধ্যেও রয়েছে সত্যের অপলাপ। বিধবাদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের সামাজিক মর্যাদার মধ্যদিয়ে দীর্ঘকালের সামাজিক অভিশাপমুক্ত করাকে কোনো ভাবেই তার প্রয়োগের স্বল্পতায় ‘প্রতীকি বিজয়’ বলা য়ায় না। বরং বলা ভালো তা ছিল হিন্দুনারীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপান। সতীদাহ প্রথা নিরোধে নারীর যে প্রাণের অধিকার লাভের পরে তা মানে বাঁচার অধিকার তা থেকেই এসেছিল । সেই সোপানে বহুবিবাহ নিরোধ থেকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের পথ সুগম হয়ে ওঠে । সে-সবেই বিদ্যাসাগরের অবিসংবাদিত ভূমিকার কথা তাঁর সেই মিথকেই সুপ্রতিষ্ঠা দিয়েছে। অথচ তাই বিরূপ সমালোচনা থেকে সাধারণীকরণের ফলে তাঁর ভাবমূর্তি সময়ান্তরে মিথে পরিণত করে দূরে সরিয়ে রেখে তার অস্বাভাবিকতায় জনবিচ্ছিন্ন করে তোলায় তা বাঙালিমানসের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি। তার ফলে তাঁকে যেমন অসাধারণে মিথ বানিয়ে আপন করা সম্ভব হয়নি, তেমনই তাঁর বিরূপ সমালোচনায় তাঁকে নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার অবকাশে সংশয়বোধের আধারে নিবিড় শ্রদ্ধাতেও অভাব নেমে এসেছে। এজন্য সময়ান্তরে বিদ্যাসাগরের অপরিময়ে অবদান নিয়ে আবিষ্কারের পরিবর্তে তাঁর অসাধারণ মহিমাকে ক্ষুদ্র করে দেখার অনুদারতা লক্ষণীয়। শুধু তাই নয়, সেখানে দংশন করার জন্য ছিদ্রান্বেষী হয়েই ক্ষান্ত হয়নি, লক্ষীন্দরকে ছোবল মারার জন্য কালনাগিনীর অপরাধের হদিশের ন্যায় ভুল খুঁজে পাওয়ার প্রবণতাও সক্রিয় রয়েছে।
বিদ্যাসাগরের খ্যাতি তাঁর সমকালে জনসাধারণের মধ্যে যেভাবে সমাদর লাভ করেছিলেন, উচ্চশিক্ষিত বনেদি পরিসরে সেভাবে বিস্তার লাভ করেনি। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে শুধুমাত্র বাংলা প্রাইমার লেখক বলে অভিহিত। আবার ‘বিষবৃক্ষ’(১৮৭৩) উপন্যাসে সূর্যমুখীর মুখে বিধবাবিবাহ প্রবর্তক বিদ্যাসাগরকে মূর্খ বলতেও দ্বিধা করেননি বঙ্কিমচন্দ্র। অন্যদিকে অবক্ষয়িত হিন্দু ধর্মের রক্ষণশীল সমাজের প্রতিভূ হিসাবেই শুধু নয়, বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যিক হিসাবেও বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারকের ভূমিকায় যে বিরূপ হয়েছিলেন, তা তাঁর সাহিত্যিক রূপেই প্রতীয়মান। সেখানে বিধবাবিবাহকে শুধু অমান্য করা হয়নি, এজন্য বিধবার প্রতি নির্মম শাস্তিবিধান নানাভাবে উঠে এসেছে ।
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’-এর বালবিধবা কুন্দনন্দিনীকে বিষপানে আত্মহত্যা করতে হয়, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’(১৮৭৮)-এ বিধবা রোহিনীকে বন্দুকের গুলিতে প্রাণ দিতে হয়েছে । শুধু তাই নয়, সমাজের ব্যাভিচারে বিধবাদের ভূমিকাকেই উপন্যাসে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁর কালেই যেখানে সবচেয়ে প্রভাবশালীর কাছে উপেক্ষা-অনাদরের স্বীকার হয়েছেন বিদ্যাসাগর, সেখানে তাঁকে নিয়ে বিতর্ক যেমন জিইয়ে ছিল, তেমনই বিভান্তির অবকাশ থেকেই যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেকালের মনস্বী সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ রমেশচন্দ্র দত্ত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেই উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলেছেন। সেদিক থেকে সেই ‘শ্রেষ্ঠ বাঙালি’র বিরূপ প্রকৃতিতে স্বাভাবিক ভাবেই বিদ্যাসাগর সবুজ হতে পারেননি। অন্যদিকে বিধবাবিবাহ প্রবর্তন নিয়ে তাঁর নাম যেমন সাধারণ্যে বিস্তার লাভ করেছে, তেমনই তা নিয়ে বিরূপ চর্চায় তাঁর বহুমুখী সৃষ্টিকর্ম এবং বহুধাবিস্তৃত কর্মধারাও জনমানসের আড়ালে থেকে যায়। সেদিক থেকে বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পর তাঁর সৃষ্টিকর্ম ও শিক্ষা বিস্তার এবং সমাজসংস্কার নিয়ে নানাভাবে বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্নভাবে যেভাবে খণ্ডে বিখণ্ডে মাহাত্ম্য তাঁর অবদানের চর্চা অগ্রসর হয়েছে, তাতেও অখণ্ড ভাবমূর্তিতে প্রতিমার মাহাত্ম্য প্রকাশ পায়নি। তাঁকে অনুবাদে মূলোচ্ছেদের সম্ভাবনা বারেবারে ফিরে এসেছে। সেক্ষেত্রে তাঁর জীবনীকারদের মধ্যেও তার প্রভাব বর্তমান।
বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রবর্তনে অকৃতজ্ঞ মানুষের ব্যবহারে অতিষ্ট হয়ে আগে জানলে সেপথে আসতেন না-বলার অব্যবহিত পরিসরে কলকাতা ছেড়ে কার্মাটাড়ে গিয়ে কুড়ি বছর ধরে বাকি জীবন অতিবাহিত করাকে অনেকেই তাঁর মধ্যে ‘মানববিদ্বেষী’ প্রকৃতি খুঁজে পেয়েছেন। জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে প্রমমনাথ বিশীর মূল্যায়নে তা প্রতিভাত। ‘মানবপ্রেমিক’ থেকে ‘মানববিদ্বেষী’র রূপান্তরের বিষয়টি সেক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের জনবিচ্ছিন্ন প্রকৃতিকে আরও সবুজ করে তুলেছে। অথচ তাঁর কার্মাটাড়ের জনসেবার বিস্তৃতিই তাঁর ত্যাগ ও সেবার আদর্শকে চারিত্রিক মহিমায় আরও বহুধাবিস্তৃত করে তুলেছে। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলনের বিরূপতায় যেখানে তার ব্যর্থতায় তা নিয়ে বহু অর্থ ব্যয় না করে দীনহীন মানুষের সেবায় ব্যয়ের কথা উঠেছিল, সেখানে কার্মাটাড়ে দুস্থ সহায়সম্বলহীন সাঁওতাল সমাজের সেবায় নিজেকে সঁপে দিলেও তাঁকে ‘মানববিদ্বেষী’ হতে হয়েছে। আসলে ব্যর্থতার আধারেই বিদ্যাসাগরের মহৎ কর্মোৎদ্দোগের বিরূপ সমালোচনা মুখর হয়ে উঠেছিলে। যে ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকা বিধবাবিবাহ প্রবর্তনে উচ্চাশা ব্যক্ত করেছিল, সেই পত্রিকায় পরে তার নেতিবাচক খবর প্রকাশ করে চলে । সেদিক থেকে বিদ্যাসাগরের বহু অর্থ ব্যয় করে তাঁর ‘সৎকর্ম’ রক্ষণশীল মানসে অসৎকর্ম মনে হয় । সেখানে সতীদাহও ভালো মনে হয়েছে যাতে সমাজে ব্যাভিচারের ভয় থাকত না বলে খেদ ব্যক্ত হয়েছে ।
ব্যাভিচার দোষ ও ভ্রুণহত্যার আলোয় দুর্বিষহ জীবনে যেখানে বৈধব্যর চেয়ে বেশ্যাবৃত্তিকে শ্রেয় হয়ে ওঠে, সেখানে বিদ্যাসাগরের অবদান স্বাভাবিক ভাবেই অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে । সেদিক থেকে বিধবাবিবাহ প্রচলনের ব্যর্থতার আলোয় তাঁর মূল্যায়নের আধারটি আপনাতেই তাঁর অনুপম ভাবমূর্তিটি প্রশ্নচিহ্নের সামনে এসে দাঁড়ায়। অর্থাৎ যার জন্য জনমানসে বিদ্যাসাগরের চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার আবেদন মূর্ত হয়ে উঠেছিল, তাই তাঁর অবমূল্যায়নের নিরিখ হয়ে ওঠে। যে ব্যর্থতার মূলাধার রক্ষণশীল হিন্দুসমাজমানসের সংস্কারবোধে বর্তমান, সেই ব্যর্থতা মোচনে সক্রিয় হয়ে যিনি চোদ্দমাসের মধ্যে তা আইনে পরিণত করার পরে আবার তার কার্যকরায় জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁর মূল্যায়নে সেই দায় চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যেই আমাদের দীনহীন মানসিকতা আরও প্রকট হয়ে ওঠে । সেই ধারা বিদ্যাসাগরের দুশো বছর পূর্তিতেও বিদ্যমান । শেখর ভৌমিক তাঁর ‘বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর’ নিবন্ধে (‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, রবিবাসরীয়, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০) উপসংহারে সেই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে পাঠককে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছেন : ‘বিধবাবিবাহের প্রচলনে তাঁর ভূমিকা স্মরণে রেখে সমকালে রচিত গান—‘বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে’ তিনি শুনেছেন, তেমনই তার ব্যঙ্গরূপটিও—‘শুয়ে থাক বিদ্যাসাগর চিররোগী হয়ে’ ঠাকুরদাস-তনয়কে শুনতে হয়েছিল। আইন প্রণয়ন বিদ্যাসাগরের অক্ষয় কীর্তি, কিন্তু দেড়শো বছর পেরিয়ে আজও কি তেমন ভাবে বিধবার বিবাহ ‘চাপাইতে পারা গিয়াছে’ ? অর্থাৎ সেই ‘চাপানোর’ নিরিখে বিদ্যাসাগরের ‘বেঁচে থাকা’র বিষয়টিকে দাঁড় করানোর মধ্যেই তাঁর প্রতি অবমূল্যায়ন প্রকৃতি সবুজ হয়ে ওঠে। প্রয়োগের অসফলতায় কারও মহৎ কীর্তি বা অবদান অথবা জীবনাদর্শকে অস্বীকার করা যায় না । মহাত্মা গান্ধীর অহিংসার আদর্শ ও সত্যাগ্রহ ফলপ্রসূ না হলেও তাঁর ভাবাদর্শ আজও অনন্য। সেখানে তাঁর মহত্তর ও বৃহত্তর মহামানবিক অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের আদর্শও বাঙালিমানসকে প্রাণিত করে না, মিথের অস্বাভাবিক ভাবমূর্তি ক্রমশ আচ্ছন্নতায় আড়ালে চলে যায়, প্রাতঃস্মরণীয় হয়েও তাতে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে । অথচ বিদ্যাসাগর কোনো মহৎ আদর্শের প্রতিভূ নয়, বিদ্যাসাগর নিজেই একটি আদর্শ। মঠ-মিশন বা প্রতিষ্ঠান না করেও ধর্মীয় বা সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক কোনো সংগঠন গড়ে না তুলেও একক সত্তায় নিজেই একটি আদর্শ গড়ে তোলায় বিরলতম মহামানব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। দুশো বছরে তাঁকে আমরা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে নিবিড় গবেষণায় ব্রতী হলেও তাঁকে অখণ্ড ভাবমূর্তিতে সেই আদর্শকেই খুঁজে পেলাম না, ভাবা যায়!