ট্রাম্পের চাপ রান্নাঘরেও

প্রতীকী চিত্র

নরেন্দ্র মোদীর ‘ডিয়ার ফ্রেন্ড’ এবার ভারতবাসীর হেঁশেলেও আঘাত হানছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের তেলা মাথায় তেল দিয়ে আমেরিকার থেকে অবাধে এলপিজি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোদী সরকার। এরই ধাক্কায় বাড়তে পারে রান্নার গ্যাসের দাম।

৫০ শতাংশ শুল্কের শাস্তি মকুব করতে আগেই আমেরিকার থেকে এদেশে অপরিশোধিত তেল, পেট্রল ও ডিজেল আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এবার এলপিজি ও সিএনজি-র ক্ষেত্রেও একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ সংক্রান্ত চুক্তি হয়েছে বলে সগর্বে ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রের পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রকের মন্ত্রী হরদীপ পুরী।

আমেরিকা আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়ার পর থেকে ও দেশে ভারতের পণ্য রপ্তানি প্রতিদিন কমছে। এমন সময়ে আমেরিকার পেট্রো-পণ্যের জন্য ভারতের বাজার খুলে দেওয়া হলো। এতে এক ধাক্কায় মার্কিন পণ্যের রপ্তানি ৩ শতাংশ হারে বাড়ল। উল্লেখ্য, বর্তমানে রাশিয়া এবং পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে পেট্রোপণ্য আমদানি করে থাকে ভারত। এতে আমদানির খরচও অনেক কম। ট্রাম্পের চাপে রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করেছে ভারত। তার উপর এবার বেশি খরচে আমেরিকার থেকে পেট্রো-পণ্যে আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোদী সরকার।


দেশের রান্নার গ্যাসের সার্বিক আমদানির ১০ শতাংশের জন্য আমেরিকার ওপর নির্ভর করতে হবে। পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক জানিয়েছে, ২০২৬-এ আমেরিকা থেকে এক বছরের মেয়াদে মোট ২০ লক্ষ টন রান্নার গ্যাস আমদানি করা হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইন্ডিয়ান অয়েল, ভারত পেট্রোলিয়াম ও হিন্দুস্থান পেট্রোলিয়ামের সঙ্গে আমেরিকার বিভিন্ন সংস্থার এ নিয়ে চুক্তি হয়েছে।

হাস্যকরভাবে আমেরিকার কাছে এই বশ্যতাকে বড় সাফল্য হিসাবে ঘোষণা করেছেন মন্ত্রী হরদীপ পুরী। রান্নার গ্যাসের বাজদার আমেরিকার জন্য খুলে দেওয়াকে এক ‘ঐতিহাসিক’ ঘটনা বলে দাবি করেছেন মন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ‘এটা এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। রান্নার গ্যাসের চাহিদার দ্রুত বৃদ্ধিতে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম বড় বাজার ভারত এবার আমেরিকার জন্য খুলে দেওয়া হলো। এবারে আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে দেশের মানুষের কাছে নিশ্চিতভাবে সুলভে সেই রান্নার গ্যাস পৌঁছে দেওয়া।’

এদিকে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, আমেরিকা থেকে রান্নার গ্যাসের আমদানি সাদা হাতি পোষার সমান। পরিবহন খরচ কয়েক গুণ বাড়বে। এর ফলে সিলিন্ডারপিছু রান্নার গ্যাসের দাম বাড়বে। মূল্যে সামঞ্জস্য রাখতে সরকারকে ভরতুকি বাড়াতে হবে, অথবা সিলিন্ডার মূল্যে পরোক্ষ করের অনুপাত কমাতে হবে। প্রথমটিতে অহেতুক সরকারি ব্যয় বাড়বে, দ্বিতীয়টিতে রাজস্ব আদায় কমবে।

আবার ভারতীয় পণ্য রপ্তানিতে আমেরিকার শুল্ক-প্রাচীর থাকায় অক্টোবরে আমেরিকায় ভারতের পণ্য রপ্তানি কমেছে ১১.৮ শতাংশ হারে, যার অর্থমূল্য ৩৪০০ কোটি ডলার। এতে ভারতের বাণিজ্যে ঘাটতি রেকর্ড হারে বেড়ে ৪১০০ কোটি ডলার হয়েছে। চলতি বছরে ভারতে আমেরিকার থেকে অপরিশোধিত তেলের আমদানি বেড়েছে। অক্টোবরে ৫ লক্ষ ৪০ হাজার ব্যারেল অপরিশোধিত তেল আমদানি করা হয়েছে। শুল্ক-প্রাচীরে ভারতে আমেরিকায় বাণিজ্যে ঘাটতি হলেও রান্নার গ্যাসের বাজার খুলে দিয়ে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সাহায্য করছে মোদী সরকার। একেই ‘ঐতিহাসিক’ বলে দাবি করছে মোদী সরকার।

আমেরিকার রান্নার গ্যাসের দাম বেশি হতে পারে ভেবেই মন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশে রান্নার গ্যাসে বর্তমানে বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা ভরতুকি দেওয়া হয়। রান্নার গ্যাসের দাম সুলভ রাখতে সরকার চেষ্টা করবে বলে আশ্বাসবাণী দিয়ে মন্ত্রী জানান, বর্তমানে রান্নার গ্যাসের গ্রাহক সংখ্যা ৩২.৯৭ কোটি। তবে ৮ কোটি গরিব গ্রাহককে উজ্জ্বলা প্রকল্পে ৫৫০ টাকায় রান্নার গ্যাস দিতে ভরতুকি দিতে হয়। তবে সাধারণ গ্রাহককে বিনা ভরতুকিতে গ্যাস কিনতে হয়। মন্ত্রীর কথায়, বিশ্বের বাজারে রান্নার গ্যাসের দাম বাড়লে দেশে সাধারণ মানুষের রান্নার গ্যাসের দামও বাড়ে। যদিও বিশ্বের বাজারে গ্যাসের দাম কমলে অদ্ভুতভাবে দেশের বাজারে তার কোনও প্রভাব পড়ে না।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর এই প্রথম ভারতে আমেরিকা থেকে রান্নার গ্যাস আমদানি হতে চলেছে। তবে আমেরিকার রান্নার গ্যাসের দাম কোনোভাবেই সস্তা হবে না। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন সস্তা হওয়ার জন্য নয়, বরং ডোনাল্ড ট্রাম্পর চাপেই দেশের বাজার খুলে দেওয়ার পর্ব শুরু হলো। আগেই ট্রাম্প আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে, ভারত যদি আমরিকার বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সাহায্য করে তবে তিনি শুল্ক মকুব করার কথা ভেবে দেখবেন। এর আগেই আমেরিকার কৃষিপণ্য আমদানিতে শুল্কের ছাড় ঘোষণা করেছিল মোদী সরকার। এবারে পেট্রো-পণ্যের ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ নেওয়া হলো।

মূলত পশ্চিম এশিয়ার দেশ কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ভারতে রান্নার গ্যাসের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশ মেটায়। এছাড়া রাশিয়া থেকে পেট্রো-পণ্য আমদানি হয়। বর্তমানে সেই আমদানির পরিমাণ ১২০০ কোটি ডলার। মোট চাহিদার ১০ শতাংশ এবার আমেরিকার থেকে আমদানি করতে চলেছে ভারত। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ হবে আনুমানিক ১০০ কোটি ডলার। এতে আমেরিকার থেকে ভারতে আমদানির হার ৩ শতাংশ হারে বাড়বে।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ভারতে আমেরিকার পণ্য রপ্তানিতে ৫০ শতাংশ হারে শুল্ক চাপানোয় আমেরিকায় ভারতের রপ্তানি ১১.৮ শতাংশ হারে কমে গিয়েছে। এতে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। অক্টোবরে ভারতের পণ্য বিদেশে রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ০.৬৩ শতাংশ। যার মূল্য ২৫ হাজার কোটি ডলার। অন্যদিকে আমেরিকা চাপ বাড়িয়ে ভারতে রপ্তানি বাড়িয়েছে। ট্রাম্পের শুল্ক শাস্তির চাপে ভারতের রপ্তানি কমে আমদানি বেড়েছে। ভারতের কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্প রক্ষায় দীর্ঘদিন যে শুল্ক প্রাচীর ছিল তা ভেঙে দিয়ে মার্কিন একচেটিয়া সংস্থাগুলির মুনাফা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।