ত্রয়ী ঐক্যে রুষ্ট ট্রাম্প

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

ভারত, চিন ও রাশিয়া একই মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনে এই ঐক্যের চেহারা দেখে মার্কিন রাজনৈতিক মহলে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। উদ্বেগ চেপে রাখতে না পেরে প্রকাশ্যেই নানা বেফাঁস মন্তব্য করে চলেছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর প্রশাসনের একাধিক শীর্ষ আধিকারিকও সুর মিলিয়েছেন ট্রাম্পের সঙ্গে। সরাসরি হুমকির সুরে মার্কিন অর্থসচিব হোয়ার্ড লুটনিক বলেছেন, ‘মাস দুয়েকের মধ্যে ভারত সুড়সুড় করে আমাদের সঙ্গে সমাঝোতা করতে চলে আসবে। ওরা ক্ষমাও চাইবে। তারপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছ থেকে বাণিজ্য চুক্তির ভিক্ষা চাইবে। তারপর অবশ্য কী করা হবে, তা পুরোপুরি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ওপর নির্ভর করবে। দিনের শেষে তো উনিই প্রেসিডেন্ট। মানুষ ওনাকেই ভোট দিয়েছেন।’ এই ধরনে মন্তব্যে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও পিছিয়ে নেই। হুমকির সুরেই তিনি সোশাল মিডিয়ায় লেখেন, ‘মনে হচ্ছে ভারত আর রাশিয়াকে আমরা অন্ধকারাচ্ছন্ন চিনের কাছে হারিয়ে ফেলেছি। আগামীতে ওদের সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের শুভেচ্ছা জানাই।’

এই রকম নানা মন্তব্যে স্পষ্ট, ভারত ও চিনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায় মারাত্মক অস্বস্তিতে পড়েছে আমেরিকা। প্রথমে তিয়ানজিনের এসসিও সম্মেলন এবং পরে বেজিঙে ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুদ্ধজয়ের ৮০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে বহুমেরুর দুনিয়া গড়ার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়েছে ভারত, চিন, রাশিয়া, গণতান্ত্রিক কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ইরান সহ দেশ। বলা বাহুল্য, এই দেশগুলির অধিকাংশই কোনও না কোনোভাবে মার্কিন আগ্রাসন, অবরোধ বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি। পশ্চিমী জোটের তর্জনী উপেক্ষা করে, নিম্ন ও মধ্য আয়ের উন্নয়নশীল দেশগুলির এই জোটবদ্ধ হওয়া নাকি ‘আমেরিকার বিরুদ্ধে চক্রান্ত’, এমনটাই হুঙ্কার সোশাল মিডিয়ায় দিয়েছেন ট্রাম্প। মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে এমন উষ্মা প্রকাশ মোটেই অপিরিচিত নয়। বহুমেরুর পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে তৈরি এসসিও, ব্রিকস-এর মতো নানা আন্তর্জাতিক সংস্থাকে ট্রাম্প প্রায়ই ‘আমেরিকা বিরোধী’ বলে তকমা দিয়ে থাকেন। এদিকে ২০২৬ সালে ভারতে ব্রিকস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। অর্থাৎ আমেরিকার উদ্বেগ আগামী দিনে আরও বাড়তে চলেছে।

এসসিও সম্মেলনের সাফল্য, ঐতিহাসিক ‘তিয়ানজিন ঘোষণা’ পত্রে সমস্ত পক্ষের সম্মতি এবং বেজিঙে বিজয় দিবস উদযাপন চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর যে কোনও ধরনের আগ্রাসন প্রতিরোধ করার হুঁশিয়ারিতে পশ্চিমী দেশগুলির রাজনৈতিক মহলে বেশ উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিসরও উদ্বিগ্ন। ট্রাম্প-বিরোধীদের এক বড় অংশ মনে করছেন, তাঁর একবগ্গা আচরণ এবং শুল্ক বৃদ্ধির নামে নিছক ‘দাদাগিরি’তে বহু বন্ধু রাষ্ট্র আমেরিকার বিরোধী শিবিরে গিয়ে ভিড়েছে। মার্কিন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে অভিযোগ করেছেন, ভারতের উপর অহেতুক ৫০ শতাংশ আমদানি শুল্ক চাপিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন দিল্লিকে সরাসরি বেজিঙ ও মস্কো বলয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে।


সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর আমেরিকার নেতৃত্বে যে এক মেরুর দুনিয়া তৈরি হয়েছে, তাতে ওয়াশিংটন বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের উপর নিছক খবরদারি করার সুযোগ পাচ্ছে। কখনও প্রযুক্তিগত লেনদেন থেকে মেধাস্বত্বে বিধিনিষেধ চাপানো, কখনও অস্ত্র বা জ্বালানি তেলের সরবরাহ আটকে বিশ্ব বাজারে কৃত্রিম মন্দা তৈরি করা— গত তিন দশক ধরে এমনভাবেই আমেরিকা এক ভীতির পরিবেশ তৈরি করেছে। আমেরিকার নির্ধারিত বিধিনিষেধ কোনও দেশ মানতে অস্বীকার করলেই, পশ্চিমী জোট তাকে একঘরে করে দিয়েছে। তাতেও কাজ না হলে ষড়যন্ত্র করে সরকার ফেলে দেওয়া কিংবা সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আফগানিস্তান, ইরান, সুদান, কঙ্গো, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া-এসবই তার উদাহরণ।

একুশ শতকে নানা ক্ষেত্রে চিনের অভাবনীয় অগ্রগতি, ওয়াশিংটনের এই দাপাদাপির প্রতি সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারই সঙ্গ রয়েছে প্রযুক্তি ও সামরিক ক্ষেত্রে রাশিয়ার অগ্রগতি এবং ভারতের জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড)। তার উপর ২০০৮ সালের অর্থসঙ্কটের পর থেকে বিশ্ববাজারে ওয়াশিংটনের আর পুরানো দাপট নেই। এসসিও বিশ্বের ৪২ শতাংশ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। আর আমেরিকা ও তার শরিক দেশগুলি দুনিয়ার মোটে ৫ শতাংশ জনসংখ্যার প্রতিনিধি। এসসিও দেশগুলির বড় অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ৪.৫ শতাংশ, আমেরিকা ও তার দোসরদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার মোটে ২.৫ শতাংশ। প্রকৃত পক্ষে, এসসিও বা ব্রিকসের কাছে প্রতিপত্তি হারানোর ভয় পাচ্ছে আমেরিকা। ঠিক সেই কারণেই এসসিও-র প্রধান তিন স্তম্ভ—ভারত, চিন ও রাশিয়ার উপর আমেরিকার রুষ্ট হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।