শিকড়ের সন্ধানে গ্রামের বাড়ির দিকে

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

আদিত‍্য মুখোপাধ‍্যায়

দুর্গোৎসবের সময় খাঁচায় বন্দি বহু শহরবাসীই তাঁদের গ্রামের বাড়ি, দেশের বাড়িতে যান। কর্মসূত্রে এখন অনেকেই আর হুটহাট গঁয়ের বাড়িতে আসতে সময় পান না। গ্রামের আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিতরা প্রায় সকলেই এখন শহরে থাকেন। চাকরি সূত্রে অনেকে বিদেশেও থাকেন। দুর্গা পুজো উপলক্ষে সকলেই শিকড়ের সন্ধানে গ্রামের বাড়ির দিকে পা বাড়ান।

বাড়িতে বৃদ্ধ মা-বাবা কোথাও থাকেন কোথাও থাকেন না। ছেলেমেয়ে খুব প্রতিষ্ঠিত হলে বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন। গ্রামের তিনতলা বা দোতলা বালাগাছি খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির বাড়িটি আজ আর নেই। উঠোনের পাশে একটি এক রুমের বারান্দা দেওয়া পাকা ঘর হয়েছে। নীচেই একটি টিউবয়েল আর পায়খানা বাথরুম। এ বাড়ির মানুষগুলো পুজোতে উৎসবের সময় গ্রামে এলে এগুলো ব‍্যবহার করেন।


শহর থেকে যাঁরা এখন আসেন সেই মানুষেরা এ বাড়িতেই একদিন থাকতেন, এখানের ধুলোবালি নিয়ে খেলতেন। তারপর বড়ো হয়ে চলে গেছেন বাইরে। ঘরে ধূপধুনো সারা বছর না পড়লেও এই সময় পড়ে। খুঁজেপেতে হরিতলার শ‍্যাওলাপড়া ইট ক’খানিকে এই সময় বের করে আনা হয় জঙ্গল সাফ করে। বাড়ির মানুষেরা পুজো উপলক্ষে গ্রামে এসে পাঁচ-ছ’টা দিন থাকেন।

বাড়ির পুজো গ্রামের পুজো দেখেন। কিছু জামাকাপড় এনে দরিদ্রদের দান করেন। নাড়ু মিষ্টি কিনে এনে বিজয়ায় যারা দেখা করতে আসে তাদের খাওয়ানোও হয়। সমবয়সীদের বিড়ি সিগারেটও দেন।
তারপর আবার চলে যান বাধ‍্য হয়ে কর্মক্ষেত্রে, শহরে।

গ্রামে তো অত কাজ নেই। ওঁদের যোগ্য কাজ তো নেইই! সারা বছর মাটির উঠোনে আবার ঘাস গজায়। নিম আর কুল গাছটার ডাল নুয়ে পড়ে মাটিতে। তুলসী মন্দির ঢাকা পড়ে যায় আগাছায়। তালপাতার সেপায়ের মত জঙ্গলের ভিড় ঠেলে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকলেও নারকেল গাছটার ডগে ঝোলে একগাছ সোনামুখি ডাব। সাপে ইঁদুরে বাস করে পাশাপাশি।

মাঠের জমি যে ভাগচাষ করে, সেই মানুষটিই পুজোর আগে আগেই ঘরদোড় পরিষ্কার করে রাখে।
তার বউ গোবর দিয়ে নিকিয়ে রাখে উঠোন। বাজার হাটও করে রাখে ঠিক আগের দিন। তার মনিব আসবেন দেশের বাড়িতে! তার জন‍্য নিয়ে আসবেন ধুতি-গেঞ্জি-গামছা। বউয়ের জন‍্য শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ।
আর সেই ধুতি-গেঞ্জি পরে, কোমরে গামছা বেঁধে গরু ছোটাতে যেতে হবে। হালের বলদকে স্নান করিয়ে, গলায় জং-ঘন্টা বেঁধে দিয়ে, চালগোলা আর কাঁচা হলুদের ছাপ। ব‍্যস, তৈরি বাঘের বাচ্চা।

এবার তার গলায় একটা দড়ি বেঁধে, মনিব-বাড়িতে মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে চলো কলাবাড়ির ডাঙা। ওখানেই গরু ছোটানো হয়। শ’য়ে শ’য়ে দাঁড়িয়ে আছে সাজিয়ে আনা গরুর সারি। মাঝখানে দাঁড়িয়ে মোড়ল হাঁকছে, করছে সারা বছরের ধান-চালের দর। তারপর ঢোল বাজিয়ে ‘হু-উ-স’। যার গরু সবার আগে ছুটবে তাকে ধন‍্যবাদ, নারকেল পুরস্কার।

একাদশীর সকালেই কোটাল-বউ আসে ঝুড়িতে পুঁটি মাছ আর কাঠমাছা নিয়ে। চ‍্যাং-ছিমুরি-মাগুর। সেই মাছের মাথায় সিঁদুর তেল দেওয়া। সাতে-র মাছ কিনা। এই মাছ দেখে কাজে বেরোলেই যাত্রা শুভ। সাত মানে লক্ষণ, শুভ লক্ষণ। নতুন শাড়ি পরা কোটাল বউ এসেছে বাঁশের বাতা দিয়ে বোনা ডালি নিয়ে। চাল-আলু-তেল-মসলার সিধে, একটা আধুলি বা গোটা টাকাও থাকে সঙ্গে। ওতেই একমুখ হাসি।

সকালেই সেই মানুষটিই কৃষিকাজের সমস্ত যন্ত্রপাতি ধুয়ে উঠোনে সাজিয়ে দিয়ে গেছে। লাঙল, মই, সলি, ডোল, ডালা, বাটখারা, দা, কেদে, কোদাল আরও কতকিছু। পরে তার উপর আলপনা আর সিঁদুরের ছোপ। সেও পরেছে সাতের জন‍্য। প্রাচীন ধাতুর টাকা তেল-সিঁদুরে চুবিয়ে মায়ের পাটে ঠেকিয়ে আনা হয়েছে সাতের জন‍্য। বছরের ‘সাত’, সবকিছু শুভর আশায় লক্ষণ করে। বিজয়ার আলিঙ্গন বছরের শুভতে। প্রিয়জনকে সারা বছর শিকড়ের মাটিতে ভালবাসায় বেঁধে রাখতে, আগলে রাখতে ‘সাত’ দেখানো। শুভযাত্রায় সম্পর্কের সুতো যেন আলগা না হয় কোনও ভাবে।

তবু তো সে গ্রাম আর গ্রামে নেই। সে দেশও নেই। থাকার কথাও নয়। অনেক উন্নতি হয়েছে গ্রামের। মাটির বাড়ি অনেক কমে গেছে। রাস্তাঘাট পাকা বা ঢালাই হয়েছে। শহরের সঙ্গে সংযোগ সহজ হয়েছে। ক‍্যেবল লাইন এসেছে, গ্রামের

তে-মাথায় চা-মিষ্টি-চপ-ঝালবড়ার দোকান বসেছে। কেউ আর খেতে পায় না তার জন‍্য ভিক্ষে করে, এমন নেই। আবার সেখান থেকেই শহরে যাবার অটো-টোটো সব পাওয়া যাচ্ছে। কেউ আর হেঁটে অতদূর যায় না। গ্রামের মেয়েটিও সাহসী হয়েছে সেল ফোনে।

আসলে বাংলার গ্রামগুলো সর্বাংশে শহর হয়ে উঠতে চাইছে। তবু কত নেই! ডাক্তার-বদ‍্যি নেই, গোবর নিকোনো উঠোন নেই, দশ-বিশ সের লাফানো মাছ নেই, ঢেঁকি নেই, মুড়ি ভাজা নেই, কলসি কাঁখে বধূ নেই। বাড়িতে বাড়িতে গরু নেই। ট্রাকটরে চাষ হয়। আখের শাল নেই, শহরে আখের রস কিনে খেতে হয় গ্রামের ছেলেটিকে। রাজনৈতিক অশান্তিও আছে। খাঁটি দুধ নেই, শহর থেকে প‍্যাকেটের দুধ আসে গ্রামে।

কতকিছু নেই তবু ভিন্ন এক সুগন্ধ আছে গ্রামের। সৌন্দর্য আছে, পরম্পরার টান আছে, মুক্ত বাতাস আছে। পাশে দাঁড়ানোর লোক কমে গেলেও আছে। যদিও শহর হয়ে উঠতে চাওয়ার অক্ষম অনুকরণে সম্পর্কের সুতোগুলো প্রতিদিনই আলগা থেকে আলগাতর হয়ে মানসিকতার বদল ঘটে যাচ্ছে। একা একা হয়ে ভাবতেই হচ্ছে অর্থ-সম্পদ-জায়গা-জমি-বাড়ি কিছুই নিজের নয়, নিয়ে যাওয়া সম্ভবও হবে না। তাহলে সম্পর্কটুকু, মৌখিক ব‍্যবহারটুকু খারাপ করে লাভ কী! মানুষের এ সত‍্য আজ না বোঝা নয়। করোনায় মরলে কোথায় দেহ যাবে সেও অজানা! তবু দ্বন্দ্বে মানুষের ছাড়া নেই। দুর্গোৎসব মিলনের উৎসব। দুর্গা তো শুধু ইট-কাঠ-মাটির দেবীই নন, কৃষক শিবের স্ত্রী, শস‍্যের দেবী শাকম্ভরী, কার্তিক-গণেশের মা, গিরিরাজ-মেনকার কন‍্যা। জায়া-জননী-কন‍্যা-ভগিনী। ‘দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা’। আম-বাঙালির আবেগ। বাঙালির দোষগুণ সব ওই সম্পর্কেই নিহিত। সম্পর্ক যত পোক্ত হয়, সুন্দর হয় ততই মঙ্গল। এখনও দুর্গোৎসবের ছোট ছোট লৌকিক রীতি-পদ্ধতিগুলি তেমন প্রমাণই দিয়ে থাকে। সেখানে কৃষকের বা মনিবের তেমন কোনও জাত হয় না। সবাই সবটাই করে। আসলে গ্রাম অনেক নষ্ট হলেও, আজও গ্রাম আছে গ্রামেই। দেশের সেই বাড়িতেই।