আজ জাতীয় স্তরে ঋষি বঙ্কিম স্মরণ জরুরি

ফাইল চিত্র

স্বপনকুমার মণ্ডল

দেশপ্রেমের সর্বোৎকৃষ্ট প্রকাশে ‘বন্দে মাতরম’-এর কোনও জুড়ি নেই। মাত্র দুটি শব্দেই তার প্রকাশ আকাশ হয়ে ওঠে। আসমুদ্রহিমাচলে তার আদিগন্ত বিস্তার। দেশের অখণ্ড চেতনায় শব্দ দুটির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক দেশবাসীর মধ্যে এনে দেয় ঐক্যের বন্ধনে আন্তরিক আত্মীয়তা, সংহতির সুতীব্র চেতনা। ২৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানের ১২৭তম পর্বে ৭ নভেম্বর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বন্দে মাতরম’-এর দেড়শ বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশবাসীকে দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষা করার ক্ষেত্রে গানটি স্মরণীয় করে তোলার কথা বলেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দেশমাতার প্রতি ‘বন্দে মাতরম’ গানে যেভাবে দেশাত্মবোধ জেগে উঠেছিল, তা অচিরেই ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। শুধু তাই নয়, ‘বন্দে মাতরম’ শব্দদুটিই বহুবর্ণ, বহু ধর্ম ও বহুভাষাভাষীর দেশে তার বহুধাবিস্তৃত ও বিপুলায়তন পরিসরকে অবিচ্ছিন্ন সত্তায় যেভাবে বিবিধের মাঝে মিলন মহানের আবেগময় প্রকাশে ঐক্যতান সৃষ্টি করে, তার কোনও বিকল্প নেই। আসলে বঙ্কিমচন্দ্রের অপূর্বসৃষ্টি ‘বন্দে মাতরম’। ‘মা তোমাকে প্রণাম’ অর্থে দেশমাতাকে ‘বন্দে মাতরম’ বলার মধ্যেই দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা ধ্বনিত হয়। সেক্ষেত্রে শুধু ‘বন্দে মাতরম’ বা তার ধারক উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’ই (১৮৮২) নয়, বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যচর্চার মধ্যেই দেশসেবার প্রয়াস ছিল। এজন্য শিল্পী বঙ্কিমচন্দ্র থেকে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের রূপান্তর ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। সেই ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের অপূর্ব সৃষ্টি ‘বন্দে মাতরম’ গানটি। অন্যদিকে বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যসাধনাতেই তাঁর দেশসেবার পরিচয় ক্রমশ প্রকাশ পায়। সেদিক থেকে ‘বন্দে মাতরম’-এর দেড়শ বছর পূর্তিতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে স্মরণও অনিবার্য মনে হয়।

অন্যদিকে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় চৌত্রিশ বছর বয়সে ‘বঙ্গদর্শন’ সম্পাদনায় সামিল হন। ইতিপূর্বে তাঁর তিনখানি উপন্যাস পাঠকসমাদর লাভ করেছে। ১৮৬৫ থেকে ১৮৬৯ পর্যন্ত তাঁর ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’ ও ‘মৃণালিনী’ উপন্যাস সাড়া ফেলেছিল। অন্যদিকে তাঁর সরকারি উচ্চপদের প্রতিকূলতাও ছিল। তৎসত্ত্বেও বঙ্কিমচন্দ্র বছর তিনেকের মধ্যে সম্পাদকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়ে বাংলা সাহিত্যের উন্নতিতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, সেই ধারা তাঁর ছাপান্ন বছরের জীবনে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিল। শিল্পীসুলভ সহৃদয়তার পাশাপাশি সম্পাদকসুলভ নির্মমতাকে বজায় রেখে বঙ্কিমচন্দ্রের চৌত্রিশ বছরে অভিভাবকের ভূমিকা অত সহজে নন্দিত বা বন্দিত হয়নি। তাঁর সেই ভূমিকায় অকালপক্ব জ্যাঠামশাইয়ের খবরদারি মূর্তিটি অসূয়াপ্রবণ বাঙালিমানসে আপনাতেই নিবিড় হয়ে উঠেছিল। সেদিক থেকে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর স্বকীয় প্রতিভায় লেখক ও সম্পাদকের দ্বৈত ভূমিকায় অত্যন্ত সফল হয়েছিলেন, তা তাঁর জনমানসে ‘সাহিত্যসম্রাট’ থেকে ‘ঋষি’ উপাধিতেই প্রতীয়মান। কিন্তু সেই উপাধি-পরিচয়ে যেভাবে শিল্পী বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে নীতিবাগীশ বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বৈরথে তাঁর ভাবমূর্তিটি বাঙালিমানসে বিতর্কের অবকাশে উচ্চকিত হয়েছে, সেভাবে সব্যসাচী প্রকৃতিতে অভিভাবকত্বের বিষয়টি উঠে আসেনি। অথচ বাংলা সাহিত্যের বিকাশে তাঁর সেই ভূমিকা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। সেখানে তাঁর সাহিত্যসম্রাটের উষ্ণীষের ভারে ও ঋষিপ্রতিম ব্যক্তিত্বের ধারে সেই অভিভাবকত্বের মান্যতা বাড়তি কোনো স্বতন্ত্র মূল্যে অভিষিক্ত হয়ে ওঠেনি। অথচ বঙ্কিমচন্দ্রের সেই পরিচয় তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় সত্তাকে ছাড়িয়ে গেছে এবং তা সম্পাদকের পরিবর্তে অভিভাবকসুলভ পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় প্রথম থেকেই সচল ছিল। এজন্য তাঁর মধ্যে শাসন ও সোহাগের পাশাপাশি গড়ে তোলার সদিচ্ছা তাঁকে সদা সক্রিয় রেখেছিল। আদর্শ শিক্ষকের মতো ‘ফ্রেণ্ড-ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড’-এর ভূমিকায় তাঁর সেই অভিভাবকত্ব আপনাতেই সম্পাদকের স্থলে শিক্ষা-অন্তঃপ্রাণ শিক্ষকের ভূমিকায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের সমাজশিক্ষকের ভূমিকাটির পাশে তাঁর বাংলা সাহিত্যে নূতন লেখকদের প্রতি দায়বদ্ধতায় দিশারি ভাবমূর্তিটি সমানভাবে সক্রিয় ছিল। এজন্য সাহিত্যসম্রাটের পাশে তাঁর সমাজশিক্ষকের ঋষিপ্রতিম ব্যক্তিত্বের আলোর পরশ যেমন সহজসাধ্য হয়ে উঠেছে, তেমনই সব্যসাচী সম্পাদকীয় পরিচিতির মধ্যে তাঁর সাহিত্যের শিক্ষকের ভূমিকাটি আপনাতেই আলোকিত মনে হয়। তাঁর সেই ব্যক্তিত্ব জীবনের অপরাহ্ণ পর্যন্ত সজীব ছিল। শুধু তাই নয়, সেই সম্পাদকের ক্ষুরধার লেখনী সময়বিশেষে হবু লেখকদের পাচনবাড়ি হয়ে উঠেছে। ‘প্রচার’-এর ১২৯১-এর মাঘ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’-এ সেই পাচনবাড়ির প্রকৃতিটি প্রকট হয়ে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই এতে মনে হতে পারে কী এমন হয়েছিল যে কারণে বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশের উনিশ বছর পর এভাবে ‘নিবেদন’ করতে হয়েছে। হবু লেখকদের প্রতি যে-বারোটি নিয়ম ‘নিবেদন’-এ প্রকাশিত হয়েছে তার সবগুলিই ‘বঙ্গদর্শন’-এর সূচনাতেও অপরিহার্য মনে হবে। সেক্ষেত্রে সুদীর্ঘকাল পরে কী উদ্দেশ্য সাধনের স্বার্থে বঞ্চিমচন্দ্র সেগুলি প্রকটভাবে উপস্থাপনে সক্রিয় হয়েছিলেন, তা স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহলী করে তোলে। অবশ্য তার সদুত্তর কোথাও মেলে না। ‘বঙ্কিমচন্দ্রজীবনী’ লেখক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য সে বিষয়ে কোনওরকম উচ্চবাচ্য করেননি। অন্যদিকে প্রবন্ধটি ‘প্রচার’-এ প্রচারিত হওয়ার পূর্বে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বক্তিমচন্দ্রের লেখনীযুদ্ধ প্রকট হয়ে উঠেছিল। শুধু তাই নয়, ‘প্রচার’-এর সেই সংখ্যায় (১২৯১-এর মাঘ) রবীন্দ্রনাথের ‘মথুরায়’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ায় লেখনীযুদ্ধের অবসানে তাতে ‘ঐতিহাসিক মিলন’-এর ছবি মূর্ত হয়ে উঠেছে। সেদিক থেকে ‘রবিজীবনী’কার প্রশান্তকুমার পাল সে-বিষয়টি অপ্রয়োজনীয় বোধে এড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু বিষয়টি এড়ানো যায় না। বিশেষ করে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘নিবেদন’ তাঁর ‘বঙ্গদর্শন’-এর সম্পাদনার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া সত্ত্বেও তা কেন এতদিন পরে ‘প্রচার’-এর আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে। অবশ্য বিষয়টি ভেবে দেখলে তার সদুত্তর মেলানো দুরূহ মনে হয় না।


‘বঙ্গদর্শন’-এ বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের উন্নতির কথা প্রথম ব্যক্ত করেছিলেন। তার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল, ‘বাঙ্গালী সমাজে ইহা তাঁহাদিগের বিদ্যা, কল্পনা, লিপিকৌশল এবং চিত্তোৎকর্ষের পরিচয় দিক’। আর তৃতীয় তথা শেষ উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, ‘যাহাতে নব্য সম্প্রদায়ের সহিত আপামর সাধারণের সহৃদয়তা সম্বর্দ্ধিত হয়, আমরা তাহার সাধ্যানুসারে অনুমোদন করিব।’ মোটামুটি তিনটি উদ্দেশ্যের সুর একটি, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের উন্নয়ন করা। সেই উন্নয়নের ধারাকে সুসম্পন্ন করার জন্য বন্ধিমচন্দ্রের সার্বিক প্রয়াসে এক সময় বইয়ের সমালোচনাও সামিল হয়ে পড়ে। প্রথম বর্ষের কার্তিক সংখ্যাতেই ‘নতুন গ্রন্থের সমালোচনা’র কথা সম্পাদক জানিয়ে দেন। তবে সমালোচনা অর্থে বইয়ের প্রশংসা বা নিন্দা নয়, তাও তিনি উল্লেখ করেন। সেই সঙ্গে গ্রন্থ পাঠে সুখলাভ বা জ্ঞানলাভের পাশাপাশি তার সমৃদ্ধির প্রতি যেমন সমালোচকের স্পষ্টতা প্রয়োজন, তেমনই তাতে লেখকের ভ্রান্তিদর্শনও সমালোচনার অঙ্গ, তাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে ‘বঙ্গদর্শন’-এ বইয়ের সমালোচনায় বঙ্কিমচন্দ্রের লক্ষ্য অচিরেই ভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। ১২৮১-এর মাঘ সংখ্যার ‘বঙ্গদর্শন’-এ সম্পাদক তাঁর সমালোচনার ব্যর্থতাকে বিনয়ের সঙ্গে ব্যক্ত করতে গিয়ে তাঁর সেই মোক্ষম পাচনবাড়ি অব্যর্থ লক্ষ্যে হাসিল করেছেন। একে পত্রিকায় স্থানাভাবের কথা ব্যক্ত করে যেটুকু বিনয় প্রকাশ করেছেন, তারপরে ‘অনবকাশ’-এর কারণে অবিনয়ী হয়ে উঠেছেন : ‘আজিকালি বাঙ্গালা ছাপাখানা ছারপোকার সঙ্গে তুলনীয় হইয়াছে; উভয়ের অপত্য বৃদ্ধির সীমা নাই এবং উভয়েরই সন্তানসন্ততি কদর্য্য এবং ঘৃণাজনক। যেখানে ছারপোকার দৌরাত্ম্য সেখানে কেহ ছারপোকা মারিয়া নিঃশেষ করিতে পারে না; আর যেখানে বাঙ্গালা গ্রন্থ সমালোচনার জন্য প্রেরিত হয়, সেখানে তাহা পড়িয়া কেহ শেষ করিতে পারে না। আমরা যত গ্রন্থ সমালোচনার জন্য প্রাপ্ত হইয়া থাকি, তাহা সকল পাঠান্তর সমালোচনা করা যায়, এত অবকাশ নিষ্কর্ম্মা লোকের থাকিতে পারে, কিন্তু বঙ্গদর্শন-লেখকদিগের কাহারও নাই। থাকিবার সম্ভাবনাও নাই। থাকিলেও, বাঙ্গালা গ্রন্থমাত্র পাঠ করা যে যন্ত্রণা, তাহা সহ্য করিতে কেহই পারে না। ‘বৃত্রসংহার’ ‘কল্পতক’ বা তদ্বৎ অন্যান্য বাঙ্গালা গ্রন্থ পাঠ করা সুখের বটে, কিন্তু অধিকাংশ বাঙ্গালা গ্রন্থ পাঠ করা গুরুতর যন্ত্রণা যে, তাহার অপেক্ষা অধিকতর দণ্ড কিছু আমাদের আর স্মরণ হয় না।’ স্বাভাবিকভাবেই বঙ্কিমচন্দ্র তা থেকে বিরত হয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে উচ্চ ধারণা গড়ে তুলতে পারেননি। বিষয়টি তাঁর অমর সৃষ্টি অহিফেনসেবী কমলাকান্তর ‘বড়বাজার’ (বঙ্গদর্শন ১২৮১-এর আশ্বিন) পরিক্রমাতেই তার করুণ পরিণতি সরস ব্যঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে। সেদিক থেকে নব্য লেখকদের অপাঠ্য গ্রন্থের সমালোচনা থেকে অব্যাহতির বিষয়ে আকস্মিক মনে হয় না। কিন্তু তাতে তো তাঁর উদ্দেশ্য সফল হওয়ার পথে বিরতি এসে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা তাঁকে যে স্বস্তি দেয়নি, এটা অনুমানের জন্য কষ্টকল্পনার প্রয়োজন নেই। কেননা বাংলা সাহিত্যের লেখা ও লেখক সবেতেই তাঁর উদ্দেশ্য নিহিত ছিল।

‘প্রচার’-এর দিন-পনেরো পূর্বে অক্ষয়চন্দ্র সরকারের সম্পাদনায় ‘নবজীবন’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। দুটি পত্রিকাতেই বঙ্কিমচন্দ্র সমানে হিন্দুধর্মের ব্যাখ্যাকার হিসাবে নীতিবাগীশ পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছেন। ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২), ‘দেবী চৌধুরাণী’ (১৮৮৪) ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়ে শিল্পী বঙ্কিমচন্দ্রের পর্বান্তরে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের পথ প্রশস্ত হয়ে উঠেছে। ‘প্রচার’-এ ‘সীতারাম’ শুরু হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি লেখনীযুদ্ধে সামিল হয়ে সাড়া ফেলেছেন। অথচ সেই পরিসরে ধর্মীয় বাতাবরণের মধ্যেও তাঁর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতির প্রতি দায়বদ্ধতায় কোনোরকম শিথিলতা লক্ষ্য করা যায় না। সেদিক থেকে ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’টি বঙ্কিমচন্দ্রের হবু লেখকদের প্রতি তাৎক্ষণিক নিদের্শিকা ভাবাটা সমীচীন নয়। কেন না, তা ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যদরদি মনীষী বঙ্কিমচন্দ্রের দীর্ঘদিনের চিন্তনের ফসল। যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ‘বঙ্গদর্শন’-এর যাত্রা শুরু করেছিলেন, তা নানাভাবে বিলম্বিত ও বিড়ম্বিত হয়েছে। পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে, আবার তা অন্যের দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে। এজন্য তাঁর লক্ষ্য নানাভাবে ব্যাহত হয়েছে, সেকথাও তিনি স্পষ্ট করে তুলেছেন। আবার যখন তার জেগে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তখন তাঁর হৃদয়বাসনার ক্ষরণও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ১২৮৪-এর বৈশাখে অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ‘বঙ্গদর্শন’ পুনরায় প্রকাশকালে বঙ্কিমচন্দ্র বিনয়ের সঙ্গে তাঁর অভিপ্রায় ব্যক্ত করে বলেছেন: ‘এক্ষণে বঙ্গদর্শনকে অভিনব সম্পাদকের হস্তে অর্পণ করিয়া, আশীর্বাদ করিতেছি যে, ইহার সুশীতল ছায়ায় এই তপ্ত ভারতবর্ষ পরিব্যাপ্ত হউক। আমি ক্ষুদ্রবুদ্ধি, ক্ষুদ্রশক্তি, সেই মহতী ছায়াতলে অলক্ষিত থাকিয়া, বাঙ্গালা সাহিত্যের দৈনন্দিন শ্রীবৃদ্ধি দর্শন করি, ইহাই আমার বাসনা।’ সেই বাসনাও তাঁর অকালেই ঝরে পড়লেও তাঁর মনেপ্রাণের কথাটি বুঝে নিতে কারও অসুবিধা হয় না। তাঁর সাহিত্যচর্চার মূলেও ছিল দেশসেবার আদর্শ। সেই আদর্শের প্রতি তাঁর সতৃষ্ণ দৃষ্টি আজীবন অক্ষুণ্ণ ছিল। সেক্ষেত্রে ‘বন্দে মাতরম’-এর দেড়শ বছর পূর্তির সঙ্গে জাতীয় স্তরে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও স্মরণ করা একান্ত জরুরি।