হিন্দি ভাষা চাপানো নিয়ে অপ্রীতিকর বিতর্ক এখন জাতীয় সংহতির পক্ষেই অস্বস্তিকর

প্রতীকী চিত্র

স্বপনকুমার মণ্ডল

কেন্দ্রের হিন্দিভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিনের সক্রিয় উদ্যোগে এখনও ভাটা পড়েনি, বরং তাঁর দলীয় উদ্যোগে তা আরও সক্রিয় বিরোধিতায় অন্ধত্ব লাভ করেছে। যখন বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা করা হয়, তখন তাতে অমান্যবোধ অস্বীকার প্রবণতায় মেতে ওঠে, তার মানি-না অন্ধত্ব লাভ করে। তামিলনাড়ুর রাজ্য সরকারের হিন্দি ভাষা চাপানোর ধারাবাহিক বিরোধিতা ক্রমশ সেই অন্ধত্বের শিকার। ১৩ মার্চ সংবাদে প্রকাশ এ বার তামিলনাড়ুর রাজ্য বাজেটের লোগোয় ভারতীয় মুদ্রা বা রুপির প্রতীকে হিন্দি র-এর আদলের পরিবর্তে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী তামিল বর্ণ রু-কে ব্যবহার করার কথা সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে জানিয়ে দেন। এতে যে দক্ষিণে ভাষাকে নিয়ে রাজনীতি আরও তীব্রতর হয়ে উঠবে, তা সহজেই অনুমেয়। সেক্ষেত্রে আগামী বছর তামিলনাড়ুর বিধানসভা নির্বাচনে দিকে লক্ষ্য রেখে তামিল অস্মিতা জাগিয়ে তোলার আয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকারের হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে অবিরত প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রীর উগ্র মানসিকতা অস্বাভাবিক না হলেও তাঁর এরূপ জাতীয় সংহতি বিরোধী অবস্থান কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। অন্যদিকে অন্ধ বিরোধিতা যে যুক্তির ধার ধারে না, মারি অরি পারি যে কৌশলেই ছড়িয়ে পড়ে, তার পরিচয় এ বার সামনে চলে এসেছে।

এমনিতে দক্ষিণ ভারতের মানুষের মধ্যে নিজেদের ভাষার প্রতি রক্ষণশীল মানসিকতার রাজকীয় অস্তিত্ব বর্তমান। তাতে স্বাভাবিকভাবেই বহুভাষাভাষী ভারতের মতো দেশে ভাষার আধিপত্য নিয়ে ভাষাভিত্তিক রাজ্যের মানুষের অনৈক্যবোধে বাদপ্রতিবাদ থেকে তীব্র বিরোধিতা প্রথমাবধি সচল রয়েছে। সেখানে দেশের সবচেয়ে জনবহুল ভাষা হিন্দির আধিপত্য উত্তর ভারতে থাকলেও দক্ষিণ ভারতে তার বিস্তার ঘটেনি। সেদিক থেকে দক্ষিণেই হিন্দি ভাষার প্রতি বিদ্বেষী মানসিকতা প্রথম থেকে সচল রয়েছে। সেক্ষেত্রে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের তিন ভাষার শিক্ষানীতিও বিরোধিতার সামনে পড়ে। সেক্ষেত্রে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে ২০৩০-এর মধ্যে তিন ভাষা শিক্ষার কৌশলে হিন্দি ভাষা চাপানোর অভিযোগে তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। সেইসঙ্গে তাঁর অনড় মনোভাবেও রণংদেহি ঔদ্ধত্য বেরিয়ে আসে। স্বাভাবিকভাবেই তাতে রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর দাবিকে অস্বীকার করে উল্টে তামিল ভাষাতেই মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর ব্যবস্থার কথা বলেন। শুধু তাই নয়, সংবিধান স্বীকৃত ভাষাগুলি প্রচলনেও প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার কথাও তুলে ধরেন অমিত শাহ। সেদিক থেকে ভাষা ব্যবহারে রাজনীতির ভাষাই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে শিক্ষায় তার প্রতিফলন স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। আসলে বহুভাষাভাষীর দেশে কোনও একটি ভাষার আধিপত্য মেনে চলার বিষয়টি আদতে অন্য ভাষাভাষী মানুষের মনে পরাধীনতাবোধ জেগে ওঠা অস্বাভাবিক নয়। সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসকদলের দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে এক দেশ, এক ভাষা থেকে হিন্দু – হিন্দি – হিন্দুস্তান কেন্দ্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির অনৈক্যবোধ স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সেখানে সাম্প্রদায়িকতার ছায়ার বিস্তারে অনেকেই অশনি সংকেত খুঁজে পান। সেখানে হিন্দি ভাষার প্রাধান্য নিয়ে বিতর্ক থেকে প্রতিবাদও স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে তামিলনাড়ুর তামিলভাষী মানুষের হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার তীব্র প্রতিবাদ প্রথম থেকেই দেশের মধ্যে পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে এবং তা নিয়ে তাঁদের অস্মিতাবোধ সমীহ আদায় করে নেয়। তাই বলে তা নিয়ে জাতীয়তা বিরোধী মানসিকতা একেবারেই কাম্য নয়। ভারতীয় রুপির প্রতীক বিরোধিতা করে মুখ্যমন্ত্রীর সোস্যাল মিডিয়া পোস্ট সরকারি বিজ্ঞপ্তি হয়ে না বেরোলেও তা যে সরকারের লক্ষ্য, তাও বেরিয়ে এসেছে। সেক্ষেত্রে তামিল অস্মিতায় দেশের প্রচলিত রুপির প্রতীককে অস্বীকার শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধিতা নয়, তা জাতীয়তা সংহতিকেও অস্বীকার করা হয় যা কোনওভাবেই কাম্য হতে পারে না। শুধু তাই নয়, সেই বিরোধিতাকে হাতিয়ার করে ভোটের রাজনীতি সরগরম করা গেলেও তা আসলে দেশের অস্থিরতাকে আমন্ত্রণ জানায়।


আসলে দেশের অস্তিত্বেই দশের ঐক্য জরুরি। সেখানে বৈচিত্রের ঐক্যেই তার সৌরভ, ঐক্যবদ্ধতায় তার গৌরব। সেখানে ঐক্য গড়ে তোলা বা বজায় রাখা একান্ত জরুরি। তার মানে যেমন অন্যকে ছোট করে বা অস্বীকার করে তা সম্ভব নয়, তেমনই ঐক্যচেতনাকে আহত করে নিজেদের অস্মিতাকেই প্রাধান্য দেওয়াও অপ্রত্যাশিত ও অসমীচীন। সেক্ষেত্রে তামিল ভাষার আভিজাত্য দেশের মধ্যে প্রথম ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতিতেই (২০০৪) প্রতীয়মান। শুধু তাই নয়, দক্ষিণের একাধিক ভাষা কানাড়া, তেলেগু, মালায়ালাম প্রভৃতি ধ্রুপদী স্বীকৃতি লাভ করেছে। সেখানে যে ভাষার বিরোধিতায় সারা দেশ জুড়ে হৈচৈ পড়ে, সেই হিন্দিভাষাই এখনও ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি লাভ করেনি। আবার দক্ষিণের হিন্দি ভাষার বিরোধিতায় যেমন রক্ষণশীলতার পরিচয় প্রকট হয়ে ওঠে, তেমনই দেশের হিন্দির পরিবর্তে বিদেশি ইংরেজি ভাষার প্রতি তীব্র দক্ষিণের আনুগত্য ও আকর্ষণ ভাবিয়ে তোলে। সেখানে তাঁদের ইংরেজি ভাষার আভিজাত্য ও বিস্তার মেনে নেওয়ার মানসিকতা বিস্ময়কর। সেক্ষেত্রে দক্ষিণের হিন্দি ভাষা বিরোধিতার যুক্তিও নড়বড়ে হয়ে যায়। অন্যদিকে ভারতীয় রুপির প্রতীকটিও একজন তামিলের তৈরি করা। তামিলনাড়ুর ডিএমকে-র প্রাক্তন বিধায়ক এন ধর্মলিঙ্গমের ছেলে উদয়কুমার ধর্মলিঙ্গমই ভারতীয় রুপির প্রতীক এঁকেছিলেন। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তাঁর আঁকা প্রতীকই সারা দেশে গৃহীত হয়। সেখানে তাঁর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীই নিজের রাজ্যেই না মানার বার্তা দিয়ে জাতীয় ঐক্যকেই আঘাত করেছেন। তার নেপথ্যে যে ভোট বৈতরণী বর্তমান, তা মুখ্যমন্ত্রীর কথাবার্তাতেও বেরিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন পুনর্বিন্যাসের ফলে তাঁর আসন সংখ্যা কমে যাওয়ার আশঙ্কায় কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার বিরোধিতার কথা সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে তামিল অস্মিতার জিগির তোলা অস্বাভাবিক না হলেও তাকে হাতিয়ার করে দেশের জাতীয় সংহতিকে ছিন্ন করে অস্বীকার করার অন্ধত্ব কোনওভাবেই ফলপ্রসূ হতে পারে না। দেশের জাতীয় সংহতি রক্ষা করাই দেশের নাগরিকদের সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ অস্মিতার পরিচয়।

অন্যদিকে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু তামিলভাষীদের অস্মিতাবোধে তীব্র প্রতিবাদ দক্ষিণ ভারতে ছড়িয়ে পড়েনি, অন্য ভাষাতেও তার পরিচয় বর্তমান। বছরদুয়েক আগেও হিন্দি ভাষা চাপানো নিয়ে দক্ষিণেই তুমুল হৈচৈ পড়ে যায়। সেখানে কেন্দ্রের হিন্দি ‘দহি’ শব্দটি ব্যবহারের নির্দেশ ফিরিয়ে নেওয়ার মধ্যেই তার ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার সক্রিয় প্রবণতা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের অধীন খাদ্য নিরাপত্তা ও গুণমান নির্ধারণকারী সংস্থা (FSSAI) ইংরেজি CURD-এর পাশে হিন্দি ‘দহি’ লেখার নির্দেশ জারি করে। ভাষা নিয়ে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলির রক্ষণশীলতা সর্বজন বিদিত। তামিলনাড়ু ও কর্ণাটক কেন্দ্রীয় সরকারের এই নির্দেশিকা নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং শেষে তা প্রত্যাহার করা হয়। আসলে এভাবে হিন্দি ভাষা বিস্তারের কৌশল নানাভাবেই সক্রিয় রয়েছে। এ কারণে বারেবারে ব্যর্থ হলেও তার প্রয়াসে ভাটা পড়েনি। ইতিপূর্বেও তার আগ্রাসী ট্রাডিশন বর্তমান।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘মানুষের ধর্ম’-এ মানুষের দেহ স্বতন্ত্র হলেও মনে ঐক্যপ্রত্যাশীর কথা তুলে ধরেছেন। দেশের মানুষের ক্ষেত্রেও সেই ঐক্যবোধ অস্বাভাবিক নয়। সেক্ষেত্রে ভারতের মতো বহু ভাষার দেশে জাতীয়তাবোধে ভাষিক ঐক্যচেতনার বিষয়টি আপনাতেই প্রাসঙ্গিকতায় উঠে আসে এবং তার বাস্তবায়নে সক্রিয় উদ্যোগও শুরু হয়। অথচ তার মান্যতায় অনৈক্যবোধের পরিচয়ও সুবিদিত। সেখানে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দিভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করে তোলার মানসিকতায় অন্যান্য ভাষাভাষী রাজ্যের অসমর্থনও স্বাভাবিক হয়ে আসে। ইতিপূর্বে কেন্দ্রে নতুন সরকারের খসড়া শিক্ষানীতিতে যে-সব বিষয় গণমাধ্যমের দৌলতে সারা দেশে চর্চার পরিসর তৈরি করেছিল, তার মধ্যে সেই ভাষিক বিস্তার নতুন করে বিতর্ককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ত্রিভাষা শিক্ষানীতিতে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়টি বিতর্কের অবকাশ তৈরি করে এবং তার প্রতিবাদে তা আবশ্যিকের পরিবর্তে ঐচ্ছিক বলে পরে জানানো হয়। এবার আবার হিন্দিকে সরকারি ভাষা করে তোলার সক্রিয় উদ্যোগ সরকারি ভাষা বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সুপারিশে উঠে এসেছে। তাতে রাষ্ট্রসংঘে দেশের সরকারি ভাষা ইংরেজির জায়গায় হিন্দি করা থেকে কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আইটিআই প্রভৃতিতে শিক্ষাদানের ভাষা ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দির প্রচলনই শুধু নয়, হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে হাইকোর্টেও ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দিকে কাজের ভাষা করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বাধ্যতামূলক ইংরেজির জায়গায় হিন্দি ভাষা রাখার সুপা্রিশ রয়েছে। সরকারি দপ্তরেও হিন্দি ভাষার প্রচলনের উপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এভাবে বহু ভাষাভাষী দেশে একটি ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া নিয়ে বাংলায় সেভাবে প্রতিবাদ আগেও লক্ষ করা যায়নি, বর্তমানেও আশাব্যঞ্জক নয়। বরং রাজনৈতিক কারণেই হোক বা দেশজ চেতনাতেই হোক তা নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তি-প্রতিযুক্তির পরিসর তৈরি করেছে। সেখানে তামিলনাড়ুর তামিলদের নিজের ভাষার মতো তীব্র স্বাভিমানবোধ বাঙালিমানসে নিবিড় হয়ে ওঠেনি বা ওঠে না। যেন হলেও ভালো, না-হলেও মন্দ নয়। এরূপ উদাসীন, উদার এবং নিরপেক্ষ মানসিকতা কতটা প্রত্যাশিত ও স্বাস্থ্যকর, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আপনাতেই প্রকাশমুখর। বিশেষ করে যে বাঙালি আন্দোলনের মাধ্যমে বিশ্বের মাতৃভাষার প্রতি সম্মানবোধ এনে দিয়েছে, সেই বাঙালির মধ্যে অন্যভাষার আধিপত্যকে মেনে নেওয়ার মধ্যে বিরূপ মানসিকতার অভাব এত তীব্র কেন, তা আপনাতেই ভাবিয়ে তোলে। শুধু তাই নয়, যে হিন্দি ভাষার আগ্রাসী আধিপত্যে বাঙালিকে স্বদেশে পরবাসী হতে হয়েছিল, সেই হিন্দির প্রাধান্যে বাংলার প্রতিবাদ গর্জে ওঠে না। দেশ স্বাধীনতা হওয়ার পরেও ১৯৪৮-এর ১৪ জুন থেকে ১৯৫৬-এর ১ নভেম্বর পর্যন্ত মানভূমের ধারাবাহিক ভাষা আন্দোলনের তিক্ত অভিজ্ঞতাও সেখানে বিস্মৃত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে হিন্দি ভাষার বিস্তারে বাঙালিরই ভূমিকা অবিস্মরণীয়। সেক্ষেত্রে তার উদার মহানুভবতায় হিন্দির অগ্রগতিতেই তার প্রান্তিক পরিসরও আরও শ্রীবৃদ্ধি লাভ করেছে। ভাষা নিয়ে বাঙালির স্বাভিমান তার শ্রেষ্ঠত্ববোধে সেভাবে সক্রিয় হতে পারেনি। অথচ সক্রিয় হওয়ার পরিবর্তে বাঙালিমানসে উদাসীনতার উদারতা ছড়িয়ে পড়েছে। দেশে হিন্দি ভাষা প্রাধান্যের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার ভূমিকায় বাংলা তার স্বকীয় সত্তায় পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারত। সেখানে তামিলনাড়ু আমাদের অগ্রদূত হয়ে উঠেছে। অথচ প্রয়োজনবোধে বাঙালি কীভাবে গর্জে উঠতে পারে, তার পরিচয়ও বর্তমান।

দেশের প্রধান ভাষা হিসাবে হিন্দির প্রচলনে উদ্যোগী হওয়ার বিষয়টি দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব থেকে সক্রিয় ছিল। সেখানে তার সক্রিয় প্রতিবাদও লক্ষণীয়। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে তার তীব্র প্রতিবাদ সক্রিয়তা লাভ করে। ১৯৩৭-এ প্রথম ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সরকারের বিদ্যালয়ে হিন্দিভাষা শিক্ষার বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে সি রাজাগোপালচারীর নেতৃত্বে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির বিদ্যালয়গুলিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে রাজাজি সেবিষয়ে নরম মনোভাব নিলেও বিশেষ করে তামিলনাড়ুতে তীব্র অনীহা গড়ে ওঠে। এজন্য ঐক্যমত্যের অভাবে ও বিচ্ছিন্নতাবোধে ১৯৫০-এ দেশে সংবিধান গ্রহণের সময় পরিকল্পনামাফিক প্রথম পনেরো বছর পর্যন্ত সরকারি কাজের ভাষারূপে দেবনাগরী হরফে হিন্দির সঙ্গে তার সহায়ক ভাষা হিসাবে ইংরেজিকেও সামিল করা হয়। সেক্ষেত্রে ধীরে ধীরে ইংরেজি ব্যবহার হ্রাস করে প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে হিন্দিকেই শেষে সরকারি ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করার লক্ষ্য ছিল। দক্ষিণ ভারতে অহিন্দিভাষী মানুষের কাছে সেই পরিকল্পনা ষড়যন্ত্র হয়ে ওঠে এবং তার তীব্র প্রতিবাদ সংগ্রামমুখরতা লাভ করে। এজন্য ১৯৬৩-তেই সরকারি ভাষা আইনে ১৯৬৫-এর পরেও সেই ধারা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। আবার ১৯৬৪-তে সরকারিভাবে ইংরেজি তুলে দেওয়ার প্রয়াসও সেক্ষেত্রে প্রতিবাদে সাফল্য লাভ করেনি। তাতে দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে উত্তরভারতের একাধিক রাজ্যও সামিল হয়েছিল। ১৯৮৬-তে কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতিতে নবোদয় বিদ্যালয়ে হিন্দি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারের পরিকল্পনা অন্যত্র বাস্তবায়িত হলেও তামিলনাড়ুতে সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে স্বদেশি হিন্দি ভাষার বিরোধিতায় বিদেশি ইংরেজি ভাষার মান্যতার বিষয়টি আপাতভাবে স্ববিরোধী মনে হতে পারে। অবশ্য সেদিক থেকে ঘরের লোককে পর করে বাইরের লোককে আত্মীয় ভাবার বিষয়টি নিয়ে সেরকম উচ্চবাচ্য না হলেও দেশে হিন্দি ভাষার প্রাধান্য নিয়ে বিতর্কের অবকাশ এখনও চরৈবেতি। সেখানে বাংলা দেশের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষার অধিকারী হওয়া সত্বেও বাঙালিমানসে হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়া নিয়ে সেভাবে আন্দোলন দানা বাঁধেনি। উল্টে হিন্দি ভাষাকে জাতে তোলার জন্যই হোক বা তার জাতীয় স্তরে প্রাধান্য লাভের ক্ষেত্রেই হোক বাঙালির উদারতা প্রথমাবধি সচল রয়েছে।

বিহারের বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসাবে সাহিত্যিক ভূদেব মুখোপাধ্যায় সাধারণ লোকের সুবিধার্থে ফারসির পরিবর্তে হিন্দি ভাষা প্রচলনের জন্য রীতিমতো আন্দোলন করেছিলেন। তাঁর জন্যই বিহারে হিন্দি ভাষা যথাযোগ্য মর্যাদা লাভ করে। ভূদেব মুখোপাধ্যায় সর্বভারতীয় ভাষা হিসাবে হিন্দিকেই সুযোগ্য মনে করতেন। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও তিনি আশা ব্যক্ত করেছেন। ভূদেব মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ (১৮৯২)-এ লিখেছেন : ‘ভারতবাসী চলিত ভাষাগুলির মধ্যে হিন্দী-হিন্দুস্থানীই প্রধান এবং মুসলমানদিগের কল্যাণে উহা সমস্ত মহাদেশে ব্যাপক। অতএব অনুমান করা যাইতে পারে যে, উহাকে অবলম্বন করিয়াই কোন দূরবর্তী ভবিষ্যকালে সমস্ত ভারতবর্ষের ভাষা সম্মিলিত থাকিবে।’ সাহিত্যিক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ও অনুরূপ বিশ্বাস করতেন। এজন্য তিনি উড়িশ্যায় হিন্দি প্রচলনে ‘বাঙ্গালা উঠাইয়া দিয়া’র কথাও ব্যক্ত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সরকারি কাজের ভাষা হিসাবে হিন্দিকে সুপারিশ করেছেন। আবার ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের হিন্দি ভাষাপ্রেম তো সুবিদিত। অথচ বাঙালির এই হিন্দি ভাষাপ্রীতি সেক্ষেত্রে দুর্বলতার অবকাশ তৈরি করেছে। হিন্দিভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে বাঙালির ভাষা সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। মানভূম ভাষা আন্দোলন তারই ফসল। সেখানে বিহার সরকারের বাংলা ভাষার কণ্ঠরোধের প্রতিবাদে সেদিনও গর্জে উঠেছিল মাতৃভাষার প্রতি তীব্র স্বাধিকারবোধ। ভজহরি মাহাতো রচিত সেই সাড়া জাগানো গানের তার মূর্ত পরিচয় ফুটে উঠেছে :

‘শুন বিহারী ভাই
তোরা রাখতে নারবি ডাঙ্গ দেখাই
(তোরা) আপন স্বার্থে ভেদ বাড়ালি
বাংলা ভাষা দিলি ছাই।
ভাইকে ভুলে করলি বড়
বাংলা-বিহার বুদ্ধিটাই…
বাংলা ভাষার দাবীতে ভাই
কোন ভেদাভেদ না।
এক ভারতে ভাইয়ে ভাইয়ে
মাতৃভাষায় রাজ্য চাই ।’

সেখানে পরিকল্পনামাফিক হিন্দি ভাষার আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে তার জাতীয় ভাষার অস্তিত্বকে প্রকট করার সক্রিয়তায় বাঙালিমানসে তা নিয়ে কোনোরকম তাপ-উত্তাপ ঘনীভূত হয় না। শুধু তাই নয়, বাঙালির মধ্যে নিজের মাতৃভাষার পরিবর্তে অস্তিত্ব-সংকটে হিন্দিকে আপন করে ভারতীয় হয়ে ওঠার প্রয়াস সক্রিয় হয়ে ওঠে। অন্যদিকে সেক্ষেত্রে ইংরেজির সঙ্গে হিন্দিকে মেলালে চলবে না। ইংরেজি অনেক দিন পূর্বেই আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ভাষা হয়ে উঠেছে। সেটি কোনো জাতির বা দেশের ভাষা নয়। তাছাড়া ইংরেজি টিঁকে আছে তার ব্যবহারিক উপযোগিতায়, তার অবিকল্পতায় এবং তার গ্রহণযোগ্যতার আভিজাত্যবোধে। সেদিক থেকে হিন্দির জাতীয়তাবোধে ইংরেজিকে বিজাতীয় করে তোলাও সমীচীন নয়। দেশে হিন্দির মতো আরও ২১টি সংবিধান স্বীকৃত ভাষা বর্তমান। সেগুলিকে উপেক্ষা করে করে শুধুমাত্র জাতীয়তাবোধের তীব্রতায় হিন্দিকে ‘রাজভাষা’ বা রাষ্ট্রীয় ভাষায় উন্নীত করার পরিকল্পনার মধ্যে কল্পনা আর বাস্তবের বিভেদ আপনাতেই প্রকট হয়ে ওঠে। এমনিতেই গণমাধ্যমের দৌলতে বিশেষ করে বলিউডি সিনেমার জনপ্রিয় হাতছানিতে হিন্দি ভাষার বিস্তার সাধারণ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে তার ছায়ায় প্রাদেশিক ভাষাগুলিও অস্তিত্ব-সংকটে পড়েছে। বাঙালিদের মধ্য নিজেদের ভাষাগৌরবের প্রত্যয়ী মানসিকতায় জাতীয় স্বার্থে হিন্দির একনায়কত্ব মেনে নেওয়ার মধ্যে শুধু স্বাভিমানের অভাববোধই প্রকট হয়ে ওঠে না, স্বকীয় অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তোলে। মানুষের অস্তিত্বে তার মাতৃভাষা অবিচ্ছিন্ন সত্তায় আত্মিকভাবে আবদ্ধ। সেই মাতৃত্বকে বিমাতৃত্বের দিকে সক্রিয় করলে শুধু মা নয়, তার সন্তানও তার শিকার হতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে দেশে ভাষিক অস্তিত্বে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হওয়ার পথটি আপনাতেই সুগম হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, ভারতের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ধর্মও সেখানে ব্যাহত হয়। সকলের প্রাধান্যেই দেশের গণতান্ত্রিক পরিসর আদর্শায়িত হয়েছে। সেখানে ভাষা শেখায় অসুবিধা নেই, এক ভাষাকে উচ্চকিত করতে গিয়ে অপর ভাষাগুলিকে নিম্নগামী করাতেই আপত্তি। ভাষার ধর্ম প্রকাশ করা। সেই প্রকাশের দৌরাত্ম্যে বৈষম্যবোধে ঐক্যবোধও ব্যাহত হতে বাধ্য। জোর করে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ায় শুধু হিন্দি বিদ্বেষ তীব্র হবে না, দেশে বিচ্ছিন্নতাবোধও মাথাচাড়া দেবে। ভাষা অধিকার, কিন্তু মাতৃভাষা অস্তিত্ব। সেই অস্তিত্বকে অস্বীকার করে গণতান্ত্রিক দেশের ভাষা গড়ে উঠতে পারে না, পারবেও না। সকলের প্রাধান্যেই দেশের গণতান্ত্রিক পরিসর আদর্শায়িত হয়েছে। সেখানে ভাষা শেখায় অসুবিধা নেই, এক ভাষাকে উচ্চকিত করতে গিয়ে অপর ভাষাগুলিকে নিম্নগামী করাতেই আপত্তি। ভাষার ধর্ম প্রকাশ করা। সেই প্রকাশের দৌরাত্ম্যে বৈষম্যবোধে ঐক্যবোধও ব্যাহত হতে বাধ্য। সেদিক থেকে ভাষা শিক্ষা বা তার ব্যবহার বা প্রয়োগ হোক মুক্ত, ঐচ্ছিক এবং আবেদনক্ষম। সেখানে ভাষাশিক্ষা নিয়ে রাজনীতি বন্ধ হওয়া একান্ত জরুরি। অন্যদিকে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার অজুহাতে ভাষার অস্মিতাবোধে তাড়িত হয়ে তা নিয়ে রাজনৈতিক সুবিধাবাদী জিগির তুলে দেশের জাতীয় সংহতিকে অস্থির করে তোলা কোনওভাবে কাম্য হতে পারে না।