এতদিন চরম অপমান থেকে চূড়ান্ত তিরস্কারে জুতো ছুড়ে মারার রেওয়াজ জনগণের কাছে প্রতিবাদের ভাষা মনে হত। স্বৈরাচারী শাসক থেকে দুর্নীতি পরায়ণ নেতানেত্রীর বিরুদ্ধে জুতো ছুড়ে মারার ঘৃণ্য প্রকাশ আমজনতার বাহবাও কুড়িয়েছে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশকে লক্ষ্য করে জুতো ছুড়ে মারার ঘটনা বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। অন্যদিকে রাজনৈতিক জনসভায় জনরোষের শিকারে জুতো ছুড়ে মারার কথা আকছার শোনা যায়। সেখানে ৬ অক্টোবর দেশের মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে বিচার চলাকালীন প্রধান বিচারপতি বি আর গাবাইকে লক্ষ্য করে আইনজীবীর পোশাকে কৌঁসুলী রাকেশ কিশোরের জুতো ছুড়ে মারার আকস্মিকতা স্বাভাবিকভাবেই জনমানসে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ রকম অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
অন্যদিকে, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিও ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করেছে। সেক্ষেত্রে আমজনতার ন্যায়বিচারের শেষ ভরসাস্থলেই জুতো ছুড়ে মারার মতো গর্হিত অপরাধে বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে না ওঠাটাই এখন আবার বিতর্কের জন্ম দিয়ে চলেছে। মশা মারার কয়েলেই মশাকে বসে থাকতে দেখার মতো বিস্ময়কর বিষয় আমাদের মননকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। তখন প্রথমেই মনে হয়, মশা মারার কয়েলের বিষও মশা আত্মস্থ করে ফেলেছে। সেখানে প্রধান বিচারপতিকে লক্ষ্য করে জুতো ছুড়ে মারার বিষয়টি আরও বিভ্রান্তিকর। কোনও সাধারণ জনগণ নন, স্বয়ং একজন আইনজীবী প্রধান বিচারপতিকে জেনেশুনে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই কুকাজটি তাঁর প্রতিবাদীসত্তায় সম্পন্ন করেছেন। এজন্য তাঁর কোনওরকম আফসোস নেই, অনুশোচনাও জাগেনি। উল্টে হামলাকারী চিৎকার করে তাঁর আসল কথাও ফাঁস করে দিয়েছেন, ‘সনাতন ধর্মের অপমান হিন্দুস্তান সহ্য করবে না।’ প্রসঙ্গত, খাজুরাহো মন্দিরে বিষ্ণুমূর্তি পুনর্নির্মাণ নিয়ে মামলার বিচারে প্রধান বিচারপতি আবেদনকারীর প্রচারমূলক অভিসন্ধির বিরোধিতা করে তাঁকেই স্বয়ং ধর্মসাধনা করেই পদক্ষেপ করতে বলেছিলেন। সেক্ষেত্রে সনাতন ধর্মের দোহাই দিয়ে প্রধান বিচারপতিকে জুতো ছুড়ে মারা যে কোনওভাবেই ধর্মরক্ষকের নিদান হতে পারে না, বরং তা যে আসলে দেশের ন্যায়ধর্মকে অবজ্ঞা ও অমান্য করে অস্বীকার করার নামান্তর, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মাধ্যমেই তা পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।
আসলে প্রতিবাদের লক্ষ্য যখন প্রতিশোধের দিকে ধাবিত হয়, তখন তার বিচারবোধে অন্ধত্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে। তা না হলে ধর্মীয় উন্মাদনায় একজন প্রবীণ আইনজীবী হয়ে স্বয়ং প্রধান বিচারপতিকে লক্ষ্য করে জুতো ছুড়ে মারার মতো দুঃসাহসী পদক্ষেপ গ্রহণের অতি তৎপরতা দেখা যেত না।
ইতিপূর্বে প্রধান বিচারপতির রায়দানে কোনওরকম ধর্মীয় পক্ষপাতিত্ব নেই, নেই কোনও ধর্মীয় বিদ্বেষের চেতাবনি। তাঁর মধ্যে ধর্মীয় বিরোধিতার পরিচয়ও বিতর্ক তোলেনি বা তাঁকে কোনওভাবেই ধর্মবিরোধী বলা যায় না। বরং প্রধান বিচারপতির মধ্যে ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় উঠেছে। সেক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় চেতনায় তাঁকে লক্ষ্য করে যেভাবে জুতো মেরে শিক্ষা দেওয়ার প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠেছে, তা শুধু হেডমাস্টারের জুতা চুরি করেও পরিচিতি পাওয়ার বিকৃত রুচির প্রচারকামী ধর্মান্ধের পক্ষেই স্বাভাবিক। অন্যদিকে প্রধান বিচারপতি বিষয়টি উপেক্ষা করে বিচারের কাজ চালিয়ে যাওয়ার মধ্যে দেশের বিচারব্যবস্থার ন্যায়ধর্মকে রক্ষা করার মহান আদর্শে অবিচল থাকায় আবারও তাঁর বিচারকের পদমর্যাদাকে গৌরবান্বিত করে দেশের সম্মান বাঁচিয়েছেন। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।
অন্যদিকে, জুতো ছুড়ে মারা ক্রমশ প্রতিবাদের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকা থেকে এশিয়া মহাদেশেও তার বিস্তার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে একুশ শতকের সূচনা দশক থেকে প্রতিবাদের ভাষায় জুতো ছুড়ে মারা সবচেয়ে জোরালো হাতিয়ার হয়ে ওঠে। আধুনিক পরিসরে রাজনৈতিক নেতা থেকে শাসক বা প্রশাসকদের বিরুদ্ধে জনরোষ বা গণপ্রতিবাদে অহিংস পথে জুতো ছুড়ে মারা স্বাভাবিকভাবেই জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেক্ষেত্রে নিষ্ঠুরতম অমানবিকতার বিরুদ্ধে মানবিক প্রতিবাদে জুতো ছুড়ে মারার নিকৃষ্টতম পন্থা প্রতিবাদী ভাষাকে আরও তীব্রতর ও জোরালো করে তোলে। সেখানে গরু মেরে জুতো দানের পরিহাসেও জুতোর গরিমা বৃদ্ধি পায়নি, বরং চামড়ার জুতোর পাশবিক আভিজাত্য অমানবিকতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। জুতো মেরে সোজা করার নিদানে জুতো ছুড়ে মারার প্রতিবাদকে লক্ষ্যভেদী করে তোলে। আসলে জুতোর আভিজাত্য যতই থাক, তার সমাদর দোকানের শোকেশে যতই বর্ধিত হোক, মূল্য তার গৌরবে নেই, তা একান্তভাবেই গর্হিত কাজে। তা যে শুধু পদযুগলকে সুরক্ষিত রাখে না, অনায়াসেই পদাঘাতেরও শরিক হয়ে ওঠে। লাথি মারতে না পারলেও জুতো ছুড়ে মারা থেকে জুতোর মালা গলায় পরানোর ঘৃণ্য মানসিকতা প্রতিবাদ থেকে প্রতিশোধের প্রকাশে আকাশ হয়ে ওঠে। সেদিক থেকে প্রতিবাদী ভাষায় জুতো ছুড়ে মারার পরিসর যে ক্রমশ বিস্তার লাভ করতে পারে, তা জেনেবুঝেই সেই বিকৃতরুচির ধর্মান্ধ আইনজীবীর মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে জুতো ছুড়ে মারা, লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও তাঁর আসল লক্ষ্য ষোলোকলায় পূর্ণ হয়েছে। তবে সনাতন হিন্দুত্বের জিগিরে যেভাবে প্রচার পেতে চেয়েছিলেন, তা তিনি পাননি। সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে সনাতন ধর্মের বিরোধীরূপে যেভাবে আইনজীবী প্রধান বিচারপতিকে কালিমালিপ্ত করতে চেয়েছিলেন, তা পারেননি। তিনি আদতে সনাতন ধর্মকেই কলুষিত করেছেন। সনাতন ধর্মের পরমতসহিষ্ণু অহিংস উদার মানসিকতার পরিবর্তে তার উগ্র ধর্মীয় সংকীর্ণতার পরিচয়কে প্রকট করে হিন্দুধর্মকেই তিনি কলুষিত করেছেন। শুধু তাই নয়, তাঁর অভিসন্ধি ফলপ্রসূ হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুত্ববাদীদের অনুদার ভাবমূর্তিকে তুলে ধরায় সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির হাতে ও মুখে গরম প্রমাণ উঠে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতায় তাঁর তীব্র প্রতিবাদেই সেই আগুন জ্বলে ওঠার আগেই তা নিভে যাওয়ায় তা আর ছড়াতে পারেনি। অথচ তার রেশ এখনও নানাভাবে চর্চিত। শুধু তাই নয়, অকারণে বিতর্কের রসদ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে প্রধান বিচারপতিও উগ্র ধর্মান্ধ আইনজীবীর কৃতকর্মে কালিমালিপ্ত হননি, বরং তাঁর ভাবমূর্তি আরও স্বচ্ছ,আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আগেকার দিনে যাত্রাপালায় খল চরিত্রের নির্মম ও নিষ্ঠুর অভিনয় জীবন্ত হয়ে ওঠায় শ্রোতাদের মধ্যে অসহনীয় বোধে কেউ যখন জুতো ছুড়ে মারত, তখন সেই জুতোর তিরস্কারই খল চরিত্রের অভিনেতার কাছে পুরস্কার হয়ে উঠত।
উনিশ শতকে বিদ্যাসাগরের জীবনেও এরকম ঘটনা বর্তমান। তিনিও এরকম জুতো ছুড়ে মেরেছিলেন জানা যায়। প্রধান বিচারপতিকে লক্ষ্য করে জুতো ছুড়ে মারার মধ্যেও সেই তিরস্কারের পুরস্কারে অন্ধকারই আলো হয়ে উঠেছে। সেই আলোতেই আবার প্রমাণ হল ভারত কোনও ধর্মের দেশ নয়, ধর্মনিরপেক্ষ ন্যায়ধর্মের স্বদেশ। সে দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ ভারতীয় সংবিধান। আর তা রক্ষা করে প্রধান বিচারপতি সেই ন্যায়ধর্মকে রক্ষা করে নিজের মুখই নয়, দেশের মুখও উজ্জ্বল করেছেন। এজন্য দেশের বিচারব্যবস্থায় গর্হিত কৃতকর্মের জন্য সেই আইনজীবীর যথাযোগ্য শাস্তিও জরুরি। কেন না প্রধান বিচারপতিকে লক্ষ্য করে জুতো ছুড়ে মারা শুধু গর্হিত অপরাধ নয়, ভয়ঙ্কর অশনি সংকেত। দেশের সুশাসনে সেই সংকেতের সমূলে বিনাশ একান্ত জরুরি।