শোভনলাল চক্রবর্তী
চলতি মাসেই শুরু হচ্ছে ‘অল ইন্ডিয়া টাইগার এস্টিমেশন’— সর্বভারতীয় বাঘ সুমারি। দেশের অন্যান্য ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্প এলাকার মতোই সুন্দরবনেও এই গণনার কাজ শুরু করবে বন দফতর। ৪৫ দিন ধরে চলবে এই অভিযান। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা বন বিভাগের জঙ্গলে ইনফ্রা-রে প্রযুক্তি সম্বলিত স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা বসিয়ে তোলা হবে বাঘের ছবি। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ক্যামেরাগুলি খুলে নেওয়া হবে। এরপরে ছবির বিশ্লেষণ করেই নির্ধারিত হবে সুন্দরবনে বাঘের বর্তমান সংখ্যা। সারা দেশের অন্যান্য ব্যাঘ্র সংরক্ষণ এলাকার তথ্যের সঙ্গে একত্রে সেই সংখ্যা প্রকাশ করবে কেন্দ্রীয় সরকার। ২০২১-’২২ সালে হয়েছিল শেষ সর্বভারতীয় বাঘ সুমারি। চার বছর পরে ২০২৫-’২৬ সালে ফের শুরু হচ্ছে গণনা। প্রায় ৩৫০ জন বনকর্মী এই কাজে যুক্ত থাকবেন। তিন দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে কর্মীদের।এবার ৩০ দিনের বদলে ৪৫ দিন ধরে চলবে ক্যামেরা ট্র্যাপিং। পাশাপাশি, সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প ও ২৪ পরগনা বন বিভাগ— দুই এলাকায় এক সঙ্গে হবে গণনার কাজ।গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের নিজস্ব সুমারিতে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির ইঙ্গিত মিলেছিল। তখন বিশ্লেষণে দেখা যায়, আগের তুলনায় বেশি সংখ্যায় বাঘের উপস্থিতি ধরা পড়েছে ক্যামেরায়। সর্বশেষ সর্বভারতীয় সুমারিতে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০১টি।সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের ডেপুটি ফিল্ড ডিরেক্টরের মতে গত বছরের ফলাফল ইতিবাচক ছিল। ক্যামেরা ট্র্যাপে বহু শাবকের ছবি উঠেছিল। এখন তারা বড় হয়েছে, আবার নতুন শাবকের জন্মও হয়েছে। তাই আশা এ বার সংখ্যাটা আরও বাড়বে।
বাঘ গণনার পাশাপাশি, জঙ্গলে বাঘেদের খাদ্য— যেমন হরিণ, বুনো শুয়োর ও অন্যান্য প্রাণী যথেষ্ট পরিমাণে আছে কি না, তা-ও পর্যবেক্ষণ করবেন বনকর্মীরা। সেই উদ্দেশ্যে খাঁড়ি ও নদীপথে ছোট নৌকো ও ভুটভুটি নিয়ে টহল চালানোর পরিকল্পনাও করা হয়েছে। এ বার বাঘের গতিবিধি নজরবন্দি করতে জঙ্গলের অন্দরমহলে বসানো হবে মোট ১,৪৮৪টি ট্র্যাপ ক্যামেরা। প্রায় ৪,১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই ক্যামেরাগুলি বসানো হবে। এর মাধ্যমে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বাঘের ছবি সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হবে ২৬ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে গেছে ক্যামেরা বসানোর কাজ। প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময় অন্তর সুন্দরবনে বাঘের শুমারি চালানো হয়। ক্যামেরা ট্র্যাপিং, পায়ের ছাপ সংগ্রহ, এবং প্রাকৃতিক চিহ্ন বিশ্লেষণের মাধ্যমেই নির্ধারণ করা হয় বাঘের সংখ্যা।
এ বছরের গণনার প্রথম পর্যায় শুরু হবে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে।দু’বছর আগে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ৯৬। বন দফতরের আধিকারিকদের অনুমান, এ বছর সেই সংখ্যা ১০০ পেরোবে। তবে এ বার গণনা শুধুমাত্র বাঘের সংখ্যাতেই সীমিত থাকবে না। বাঘের আচরণ, খাদ্যের জোগান এবং শিকারের প্রজাতির উপস্থিতিও বিশ্লেষণ করা হবে। বিশেষ করে, হরিণ, বুনো শুয়োর ও অন্যান্য প্রাণীর সংখ্যা কী পরিমাণে রয়েছে, তা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যাচাই করা হবে জঙ্গলে বাঘের খাদ্যচক্র কতটা স্থিতিশীল। ধারণা করা হচ্ছে, খাবারের জোগান কমে আসায় মাঝেমধ্যেই বাঘ লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। সেই ধারণা যাচাই করতেই এই বছর বাড়তি নজর দেওয়া হচ্ছে খাদ্যসম্পদের পর্যবেক্ষণে।এই কাজের জন্য একটি বিশেষ অ্যাপ তৈরি করেছে বন দফতর, যার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হবে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে।
এ বার তাই বাঘের শুমারি শুধু সংখ্যা নয়, তাদের দৈনন্দিন জীবন ও খাদ্যচক্র সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেবে। বাঘ লোকালয়ে ঢুকে মানুষ মেরেছে, এই ঘটনা বিরল। মানুষ জ্বালানি, মাছ, মধু, কাঁকড়ার সন্ধানে জঙ্গলে ঢোকায় প্রাণহানি ঘটে। সঙ্গে এও ঠিক, নোনা জল বাঘের শরীর, আচরণে প্রভাব ফেলে। অন্য জঙ্গলের মতো ভারী চেহারার তৃণভোজীও এখানে নেই, আছে হরিণ, বানর, শূকর। কর্দমাক্ত জলজঙ্গল, শ্বাসমূলের কারণে সেগুলিকেও শিকারে সমস্যায় পড়ে বাঘ। ফলে তার সংগ্রামও কম নয়। অন্য দিকে, মানুষ সঙ্কীর্ণ খাল বা খাঁড়িতে ঢুকে যখন ডাল বা মৌচাক কাটে, জাল পাতে, খুঁটি পোঁতে, কাঁকড়ার জন্য পায়ে হেঁটে কাদায় শিক গাঁথে তখন অরক্ষিত ও অসতর্ক থাকার কারণে বন্যপ্রাণের কাছাকাছি আসার সম্ভাবনা প্রবল। তখন মাংসাশী প্রাণী অন্যান্যের চেয়ে শ্লথ ও দুর্বল মানুষকে সহজ শিকার জ্ঞানে আক্রমণ করে। জঙ্গলের ঝুঁকিপূর্ণ জীবিকায় বাঘ-কুমির-কামটের সঙ্গে যুঝতে হবে, জঙ্গলবাসী জনগোষ্ঠী তা অবগত— জঙ্গলজীবনের রীতিনীতি, বনদেবী, বনবিবির বিশ্বাস তারই প্রমাণ। তা সত্ত্বেও মানুষ যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গলে ঢুকতে বাধ্য হন তার কারণ অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক অনগ্রসরতা। উপার্জনের তাড়না এতটাই যে অনেক সময়ই বৈধ অনুমতিপত্র ছাড়াই তাঁরা জঙ্গলে যান, টহলদার নৌকা দেখলে আরও সঙ্কীর্ণ খালে আত্মগোপনের চেষ্টা করেন, যার পরিণাম প্রাণঘাতী। বাঘসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের শান্তিপূর্ণ বাসস্থান ও খাদ্যশৃঙ্খলের স্বাস্থ্যের উন্নতিও বন দফতরের দায়িত্ব।
প্রয়োজন কর্মসংস্থান। বাঘের সঙ্গে লড়াই করে মানুষকে সংসার প্রতিপালন করতে হচ্ছে, এই চিত্রটুকুই রাজ্যের কর্মক্ষেত্রের বনিয়াদি স্তরের দুরবস্থাকেও বেআব্রু করে। অরণ্যসম্পদে ভরসা রাখলে জঙ্গলে ঢোকার বদলে বাক্সে মধুমক্ষিকা প্রতিপালন, নিরাপদ স্থানে ও পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষের প্রচলন বাড়াতে হবে। আয়তনে বিরাট এই বনে পর্যাপ্ত টহলদারের সংখ্যা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনই গ্রামে গ্রামে সতর্কতামূলক প্রচার করতে হবে, জঙ্গলকিনারার জালকে পোক্ত রাখতে হবে এবং তা সত্ত্বেও মানুষ নিয়ম ভাঙলে, জাল কাটলে, জঙ্গলে অবৈধ প্রবেশ করলে, কঠোর শাস্তি দানের ব্যবস্থা করতে হবে। বাঘ ও মানুষ উভয়ের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকলে তবেই পারস্পরিক সংঘাত কমানো সম্ভব।সুন্দরবন লাগোয়া জনবসতির মানুষগুলির জীবন কতখানি অনিশ্চয়তায় ভরা তা আবারও প্রকাশ্যে এল গত মাসে। শীতের মুখে একই সপ্তাহে সিঁদুরকাটির ও চামটার জঙ্গলে বাঘের আক্রমণে দু’টি অপমৃত্যু এলাকায় শোক ও ত্রাসের সঞ্চার করেছে। দু’ক্ষেত্রেই বাঘ নৌকার উপরে বসে থাকা মানুষকে লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়েছে। সুন্দরবনের বাঘ নরখাদক— বিশ্ব জুড়ে পুঞ্জীভূত এই জল্পনা এই ঘটনাক্রমে আরও তীব্র হওয়ারই শঙ্কা। কিন্তু, মনে রাখা জরুরি, অন্যান্য জঙ্গলের মতোই এখানকার প্রতিটি বাঘ মানুষখেকো নয়। যদি তা হত তবে প্রতিটি বাঘ বছরে গড়ে ৫০টি মানুষ মারত, সে ক্ষেত্রে হতাহতের সংখ্যা কোন অঙ্কে পৌঁছত সহজেই অনুমেয়। অযথা আতঙ্ক না ছড়িয়ে বোঝা দরকার যে, পরিবেশের বিরূপতা ও বিকল্প জীবিকার অভাব বাদাবনের বাঘ-মানুষ সম্পর্ককে এমন ভাবে জটিল ও সঙ্কটাপন্ন করে রেখেছে, যাতে বিপদ দু’পক্ষেরই। সুন্দরবনের জঙ্গলে মাছ-কাঁকড়া ধরতে গিয়ে প্রায়ই বাঘের মুখে পড়েন মৎস্যজীবীরা। বাঘের হানায় কোনও মৎস্যজীবীর মৃত্যু হলে প্রশাসনের তরফে তাঁকে ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা। কিন্তু অভিযোগ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রশাসনিক গাফিলতিতে সেই ক্ষতিপূরণ মেলে না। নানা অজুহাতে গরিব পরিবারগুলির টাকা আটকে রাখে বন দফতর। এরই প্রতিবাদে বছর দু’য়েক আগে কুলতলির বাঘ-বিধবা শান্তিবালা নস্কর হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। হাই কোর্ট দ্রুত তাঁকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়। আদালতের নির্দেশে ক্ষতিপূরণ পান শান্তিবালা। তারপর থেকে আরও বেশ কিছু পরিবার হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে ক্ষতিপূরণ আদায় করে এনেছেন। একটি মামলার রায়ে বিচারপতি স্পষ্ট জানান, জঙ্গলে বাঘের হামলায় মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ দিতেই হবে। কোর বা বাফার এলাকা দেখা চলবে না।
কিন্তু অভিযোগ, তারপরেও নানা টালবাহানায় ক্ষতিপূরণ আটকে রাখছে বন দফতর। আইনি লড়াই লড়ে অধিকার ছিনিয়ে আনতে এই বাঘ বিধবাদের পাশে দাঁড়িয়েছে মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর। বাঘ-বিধবাদের হয়ে ক্ষতিপূরণের দাবিতে হাই কোর্টে লড়বেন তাঁদের আইনজীবীরা। প্রতি বছর গড়ে ২০ জন মৎস্যজীবী বাঘের হানায় আহত বা জখম হচ্ছেন। অথচ, বন দফতর প্রায় কাউকেই ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে না। দিন কয়েক আগে বন দফতরের এক অস্থায়ী কর্মী গ্রামে ঢুকে পড়া বাঘ ধরতে গিয়ে চোখ হারালেন। তাঁকেও ক্ষতিপূরণ দেয়নি প্রশাসন। তাই প্রত্যন্ত এলাকার গরিব পরিবাগুলিকে বাধ্য হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। বন বিভাগের দাবি, আবেদনের ভিত্তিতে কাগজপত্র খতিয়ে দেখে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। কিছু ক্ষেত্রে নথিতে সমস্যা থাকলে দেরি হয়। সুন্দরবনের লোকালয়ে ঘন ঘন বাঘের প্রবেশ রুখতে বন দফতর উদ্যোগী হয়েছে। সেই পর্যায়ে জোড়া প্রযুক্তির ব্যবহার করে বার বার জনবসতি এলাকায় বাঘের প্রবেশ রুখতে চাইছে তারা।
বিস্তৃত জঙ্গলে ১০০টি ট্র্যাপ ক্যামেরা বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন এই ক্যামেরাগুলি গ্রাম সংলগ্ন জঙ্গলে লাগানো হবে, যাতে বাঘ লোকালয়ে প্রবেশ মাত্রই বন দফতর জানতে পারে। এই ক্যামেরাগুলি বাঘের গতিবিধিও রেকর্ড করতে পারবে। ফলে কোন বাঘ, কত বার, এবং কোথায় লোকালয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তা সহজেই নির্ধারণ করা সম্ভব হবে বন দফতরের তরফে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে বাঘের আচরণ বিশ্লেষণ করা যাবে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের আরও কার্যকর ভাবে সতর্ক করা যাবে।
বাঘের লোকালয়ে প্রবেশ রোধে ক্যামেরার পাশাপাশি বিশেষ সেন্সরযুক্ত আলোও বসাতে উদ্যোগী হয়েছে বন দফতর। জঙ্গলের নির্দিষ্ট স্থানে পাঁচ ফুট উচ্চতায় লাল, নীল এবং সবুজ রঙের আলো লাগানো হবে। সেই আলো এমনভাবে লাগানো হবে, যাতে লোকালয়ে প্রবেশের আগেই সরাসরি তা বাঘের চোখে পড়ে। বন দফতরের মতে, আলো দেখেই বাঘ জঙ্গলে ফিরে যাবে। প্রতি দিন সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত এই আলো জ্বালানো থাকবে। সুন্দরবনের জনবসতি এলাকায় বাঘের আগমন ঠেকাতে এবং জঙ্গলের রয়্যালবেঙ্গল টাইগার সংরক্ষণ প্রকল্পের অংশ হিসেবে এই পদক্ষেপগুলি করা হচ্ছে।
সুন্দরবন অঞ্চল বাঘের প্রাকৃতিক আবাসভূমি হওয়ায় এখানে বাঘের উপস্থিতি স্বাভাবিক ঘটনা। তবে, লোকালয়ে বাঘের ঢুকে পড়া শুধু মানুষের জন্য নয়, বাঘের নিরাপত্তার জন্যও চিন্তার বিষয়ে। এই প্রকল্পে স্থানীয় গ্রামবাসীদেরও সচেতনতার মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। নতুন এই জোড়া প্রযুক্তি চালু হলে এবং বাঘের চলাচল সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া গেলে বন দফতর দ্রুত পদক্ষেপ করতে পারবে। পাশাপাশি, নতুন প্রযুক্তি বাঘ এবং মানুষের মধ্যে সংঘাত কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। বন দফতরের এই উদ্যোগ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং স্থানীয় মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি কার্যকর উদাহরণ হতে পারে বলেই মত সুন্দরবনে কর্মরত বন আধিকারিকদের।