শান্তনু রায়
কিশোর বয়সেই স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়া সদ্যতরুণ প্রবেশিকা পরীক্ষায় স্কলারশিপ পেয়ে স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবেন স্নেহশীল শিক্ষকমশাইদের কাছে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রতিশ্রুতি সফল করতে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু বাধ সাধল অদৃষ্ট। প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়ার আগেই ১৯০৮ সালের মধ্যভাগে নারায়ণগঞ্জে ধরা পড়ে গিয়ে ছ’মাসের কারাবাস হলো। সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্যজীবন শেষ হয়ে নতুন জীবন আরম্ভ হলো। যদিও ১৯০৯ সালে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। তবে নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন— আমার স্বপ্ন সফল হয় নাই, আমি সফলকাম বিপ্লবী নই। তিনি ময়মনসিংহের কাপাসটিয়া গ্রামে ভূমিষ্ট— দুর্গাচরণ ও প্রসন্নময়ী চক্রবর্তীর পঞ্চম সন্তান ত্রৈলোক্যনাথ, যিনি বিপ্লবী মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী বা ত্রৈলোক্য মহারাজ নামেও সুপরিচিত। তাঁর বাবাও স্বদেশি আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন।
আসল নাম ছিল ত্রৈলোক্যমোহন। পরে একটি বিশেষ ঘটনার অভিঘাতে হয়ে যান ত্রৈলোক্যনাথ। ত্রৈলোক্যনাথ ১৯০৬ সালে অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেন। ১৯০৯ সালে তিনি ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলায় পুলিশ তাঁর সন্ধান শুরু করলে আত্মগোপন করেন। ১৯১৩-১৪ সালে মালদহ, রাজশাহী ও কুমিল্লায় ঘুরে গুপ্তঘাঁটি গড়তে থাকেন। ১৯১৪ সালে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসেবে আন্দামানে সেলুলার জেলে পাঠায়। অনুশীলন সমিতির প্রথম দিকের আর এক সদস্য পুলিনবিহারী দাসও তখন সেখানে বন্দি ছিলেন। ছিলেন বারীন্দ্র ঘোষ, সাভারকর ভ্রাতৃদ্বয় এবং আরও অনেকে।
যা হোক, দীর্ঘ দশ বছর পর ১৯২৪-এ মুক্তি পেয়ে কোলকাতা এসে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের পরামর্শে দক্ষিণ কলকাতা জাতীয় বিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯২৭-এ আবার গ্রেপ্তার করে বর্মা অধুনা মায়ানমারের মান্দালয়ে পাঠানো হয়। ঘটনাচক্রে সে সময় সুভাষচন্দ্র বসুও সেখানে বন্দি ছিলেন। সেখানে তাঁদের এই প্রথম সাক্ষাৎকার তিনি স্মরণে রেখেছেন আজীবন। মান্দালয় থেকে তাঁকে ভারতে এনে ১৯২৮-এ নোয়াখালির হাতিয়া দ্বীপে অন্তরীন রাখা হয়। পরে মুক্তি পেয়ে উত্তর ভারতে গিয়ে চন্দ্রশেখর আজাদের হিন্দুস্থান রিপাবলিক আর্মিতে যোগ দেন ও পরে দলের আদেশে বর্মার বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে বর্মায় যান। ১৯২৯-এ আবার লাহোর কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৩০-এ আবার গ্রেপ্তার হন, ১৯৩৮-এ মুক্তি পান। ১৯৩৯-এ সুভাষচন্দ্রের আপোষবিরোধী রামগড় কংগ্রেসে যোগ দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে বিদ্রোহ ছড়ানোর চেষ্টা করলেও সফল হননি। বরং গ্রেপ্তার হয়ে যান চট্টগ্রামে। ১৯৪২-এ ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে যোগ দিয়ে ফের গ্রেপ্তার হন, মুক্তি পান ১৯৪৬-এ। তখন থেকেই নোয়াখালিতে সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন ১৯৫৪ সালে সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চার প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেমব্লিতে নির্বাচিত হলেও ১৯৫৮-য় সেই নির্বাচন খারিজ করে দেওয়া হয় এবং তাঁর রাজনৈতিক, এমনকি সামাজিক কার্যকলাপের উপর বিধিনিষেধও জারি হয়। ১৯৬৫-এ পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ছিয়াত্তর বছরের বৃদ্ধ এই বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান সরকার। মুক্তি পান ১৯৬৬ সালে। এরপর থেকে তিনি নিজের গ্রামেই দিন কাটাতেন।
অনুশীলন সমিতি থেকে আরএসপি, তারপর পাকিস্তান সোস্যালিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার প্রথম চোটেই সেই পার্টিকে নিষিদ্ধ করে দেয়। একসময় পাকিস্তান সোশ্যালিস্ট পার্টির অফিসেই তিনি থাকতেন।
তিনি লিখেছিলেন, ‘বিপ্লব আন্দোলন ব্যর্থ হইয়াছে… ইহার কারণ এই নয় যে, বিপ্লবীদের দুর্বলতা…। বিপ্লবীদিগকে অনেক প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতে হইয়াছে।’
এর প্রত্যক্ষ উদাহরণ স্বয়ং ত্রৈলোক্য মহারাজ। ১৯৪৬-এর অভূতপূর্ব হত্যালীলার পর দেশবিভাগ এবং ১৯৫০-এ আবার রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা যার ভয়াবহতা কিঞ্চিৎ অনুমান করা যায় একদা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও পরাধীন ভারতে বর্ণহিন্দুবিরোধী রাজনীতির প্রবক্তা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের সেদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়ে প্রেরিত পদত্যাগপত্র থেকে। কিন্তু ত্রৈলোক্য মহারাজ গণনিষ্কাশন সত্ত্বেও অনিশ্চিত অন্ধকারাচ্ছন্ন পাকিস্তানেই আপনজনদের সঙ্গে রয়ে গেলেন। তিনি নিরাপদ ভারতে চলে আসতে সীমানা অতিক্রমে উৎসাহ বোধ করেননি। ওই ভূখণ্ডের সকলের সুখ দুঃখের অংশীদার হয়ে নবগঠিত পাকিস্তানকেই স্বদেশ বলে মেনে নিয়েছিলেন। তবে অশীতিপর বয়ঃভারে অনিবার্য মৃত্যুর হাতছানির প্রেক্ষিতে একবার সীমানার এপারে প্রাচীন ভারত, এককালের কর্মস্থলে আসতে চেয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে কারামুক্তির পরই আবেদন করেছিলেন ভিসার। সে আবেদন মঞ্জুর হয় চার বছর পর।
অবশেষে ১৯৭০-এর ২৪ জুন হরিদাসপুর চেকপোস্ট দিয়ে তিনি ভারতে এসেছিলেন। উঠেছিলেন যাদবপুরে ৪৭/এ, সেন্ট্রাল পার্কে ভাইপো জিতেন চক্রবর্তীর বাসস্থানে। বলেছিলেন দেড় মাস থেকে দেশে ফিরে যাবেন— ফেরা আর হয়নি। ইতিমধ্যেই দিন পনেরো আগে ১১ জুন দীর্ঘ রোগভোগের পর বিপ্লবী দেশনেত্রী লীলা রায়ের প্রয়াণ ঘটেছে কোলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে। এদেশে আসার পর ত্রৈলোক্য মহারাজের জনপরিসরে সর্বপ্রথম উপস্থিতি দেশনেত্রীর স্মৃতিসভায়। মহাজাতি সদনে অনুষ্ঠিত ২৮ জুন লীলা রায় স্মরণে সেই নাগরিক সভায় উপস্থিত বিরাশি বছরের তরুণ বিপ্লবী শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেছিলেন— সে যুগে নারী শিক্ষা ও সমাজ আন্দোলনে তিনি (লীলা রায়) অন্যতম পথিকৃৎ। ঘোরতর অন্ধকারের দিনে দেশের নারী সমাজে জাগরণ এনেছিলেন লীলা রায়, তাই বয়সে ছোট হলেও তিনি আমার শ্রদ্ধার পাত্রী।
এরপর তিনি দিল্লি যান। সাক্ষাৎ হয় এদেশের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে। দিল্লিতেও বিপুলভাবে সম্বর্ধিত হন অশীতিপর বিপ্লবী। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও তাঁকে সাদরে ও শ্রদ্ধায় অভ্যর্থনা জানান। লোকসভার স্পিকারের আমন্ত্রণে ভারতীয় সংসদে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণও দেন— যা এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর আকস্মিক মহাপ্রয়াণ ঘটে দিল্লিতেই ১৯৭০ সালের ৯ আগস্ট গভীর রাতে। সেদিন কংগ্রেসের প্রভাবশালী সাংসদ সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ দিল্লিতে গিয়ে, যাঁর ২১নং জনপথের বাসভবনে মহারাজ অবস্থান করছিলেন, তিনি মহারাজের সম্মানে এক নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন সেখানে। যে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী-সহ অনেক বিশিষ্টরাও উপস্থিত হয়েছিলেন। এমনকি শ্রীমতী গান্ধী তাঁকে নিজ হাতে মিষ্টি পরিবেশন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেই নৈশভোজে যোগ দেবার কয়েক ঘণ্টা পরেই সেই চিরবিদায়। যদিও রাত সাড়ে দশটায় ভোজসভা শেষে খুব স্বাভাবিকভাবেই মহারাজ বাইরে গিয়ে অতিথিবৃন্দকে বিদায় সম্বর্ধনা জানিয়ে শুতে যান এবং ঘুমিয়েও পড়েন। গভীর রাতে আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তৎক্ষণাৎ দিল্লির উইলিংডন হাসপাতালের চিকিৎসকরা এসেও শেষরক্ষা করতে পারেননি— ইতিমধ্যে তাঁর শেষনিঃশ্বাস নির্গত।
সংবাদ পেয়ে সকাল থেকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্টরা উপস্থিত হন সুরেন্দ্রমোহন ঘোষের সেই বাসভবনে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী উপস্থিত হয়ে মাল্যার্পণ করেন। পাক হাইকমিশনারও আসেন শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে। মহারাজের স্মৃতিতে সংসদেও শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদিত হয়।
পরদিন শবাধার নিয়ে বিমান সন্ধ্যা নাগাদ পোঁছয় কলকাতায়। দমদম বিমানবন্দর থেকে মরদেহ নিয়ে বিরাট শোকমিছিল দীর্ঘপথ অতিক্রম করে প্রথমে টালিগঞ্জে অনুশীলন ভবন হয়ে রাত আড়াইটা নাগাদ দেশপ্রিয় পার্কে পৌঁছয়। সেখানে রাখা মরদেহে সারারাত ধরে অগণিত মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে গিয়েছেন। পরদিন বেলা দশটা নাগাদ কেওড়াতলা মহাশ্মশ্মানে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
এ প্রসঙ্গে এক ব্যক্তিগত অনুভুতির কথাও বলতে হয়। সে সময় একাদশ শ্রেণীর ছাত্র এই নিবন্ধকার রেডিও ও সংবাদপত্র থেকে প্রয়াণ ও মরদেহ কলকাতায় পৌঁছনোর সংবাদ জেনে সকাল হতেই হাজির কেওড়াতলা মহাশ্মশ্মানে একটু শেষ দর্শন, শেষ প্রণাম নিবেদনের একান্ত ইচ্ছায়। তখন ভিআইপি-র সৎকারের সময়েও এত কড়াকড়ি ছিল না শ্মশানে প্রবেশের— হয়ত পরিবেশ, পরিস্থিতি, জন মানসিকতাও ছিল কিঞ্চিৎ ভিন্ন। যা হোক শ্মশানে প্রবেশ করে যে স্থানে চিতা সাজানো হচ্ছিল তার কাছেই ঘোরাফেরা অপেক্ষায় থাকা অধীর আগ্রহে— মরদেহ পৌঁছনোর। বেলা দশটা নাগাদ বিপুল জনতার দোলায় যেন প্রবেশ করলেন অন্তিমশয়নে সেই বিপ্লবী পুরুষ। চারিদিকে ভীড়-জনস্রোত। সে ঠেলায় প্রাথমিকভাবে ছিটকে গেলেও খানিক পরে অগ্নিযুগের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া ও রাজনৈতিক কারণে সম্ভবত সর্বাধিককাল কারাবাসী দুঃসাহসী বিপ্লবীকে খুব কাছ থেকে শেষ দর্শন করা ও পদযুগল স্পর্শ করে প্রণাম জানানোর পর শেষকৃত্যে সাক্ষী থাকার পরম সৌভাগ্য ঘটেছিল সেদিন। এই নিবন্ধকারের জীবনধন্য করা সে ঘটনার স্মৃতি চিরকাল অম্লান ও জাগরুক থাকবে।
প্রসঙ্গত, মৃত্যুর কয়েকদিন আগে নেতাজি ভবন পরিদর্শনকালে ভবনের ভিজিটরস বুকে তিনি লিখে গিয়েছিলেন যে কথা ক’টি তাই বোধকরি ভারতবর্ষের তরুণদের উদ্দেশে তাঁর অন্তিম বাণী— ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র ভারতের যুবকদের আদর্শ। ভারতের যুবকেরা নেতাজির আদর্শে শক্তিশালী ভারত গড়িয়া তুলিবে ইহাই আশা করি।’ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে মান্দালয় জেলে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর একসঙ্গে দিন কাটানোর কথা। স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন, ‘মান্দালয় জেলে পৌঁছনোর পরই সুভাষবাবু বলিয়াছিলেন, মহারাজের সিট আমার পাশে থাকিবে এবং সুভাষবাবুর পাশে আমার থাকিবার সৌভাগ্য হইয়াছিল। সুভাষবাবুর জন্ম বড় ঘরে, শৈশব হইতে তিনি সুখে লালিত পালিত হইয়াছেন। কিন্তু দেশের জন্য দুঃখ-কষ্ট বরণ করিতে তিনি কাহারও অপেক্ষা পশ্চাৎপদ ছিলেন না। কাহারও অসুখ হইলে তিনি নিজে সারারাত্রি জাগিয়া সেবা করিতেন। একবার টেনিস খেলিতে যাইয়া আমি পড়িয়া যাই— তাহাতে হাঁটুর চামড়া উঠিয়া যায় ও ঘা হয়। সুভাষবাবু প্রত্যহ নিজ হাতে আমার ঘা নিমপাতা সিদ্ধ জল দ্বারা ধোয়াইয়া দিতেন।… সুভাষবাবুর মত লোককে জেলখানায় সঙ্গী হিসেবে পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়। (জেলে ত্রিশ বছর)
প্রসঙ্গত, বিপ্লবী দেশনেত্রী লীলা রায়ের সঙ্গে মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথের যোগাযোগ ছিল বরাবর, দেশনেত্রী এদেশে চলে আসার পর এবং মহারাজ পূর্ব পাকিস্তানে অন্তরীণ থাকাকালীনও। কথিত বিমান দুঘর্টনায় নেতাজি মারা যাননি, তা মুখার্জি কমিশনের রিপোর্ট ও অন্যান্য নথিপত্র থেকে দিবালোকের মতো পরিষ্কার। ১৯৬৩-তে নিমসারে গিয়ে ভগবানজীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনিই যে নেতাজি একথা সুনিশ্চিত হয়ে দেশনেত্রী যে ক’জন ঘনিষ্ঠ বৃত্তের ও বিশেষ কয়েকজনকে সেই চাঞ্চল্যকর সুসংবাদটি জানান, তাঁদের মধ্যে অন্যতম মহারাজ ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী। দেশনেত্রীর গোপন ও সাংকেতিক চিঠি নিয়ে ষাটের দশকের মধ্যভাগে তাঁর বিশ্বস্ত বিপ্লবী সহযোগী শৈলেন রায় (ননীদা) ছদ্মবেশে গোপনে সীমান্তের ওপারে গিয়ে ঢাকায় ত্রৈলোক্য মহারাজের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর পূর্বতন যোগাযোগের (পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টির জনৈকা মহিলা সদস্যা) সাহায্যে সদা শ্যেনদৃষ্টিতে সতর্ক পাকিস্তানী প্রহরার মাঝেও এবং সেই চিঠিটি দিলে মহারাজও সাঙ্কেতিকভাবে লেখা একটি চিঠি শৈলেন রায়ের হাত দিয়ে পাঠান, যেটি তিনি ফিরে এসে আবার দেশনেত্রীকে হস্তান্তর করেন। লীলা রায় সে চিঠি আবার যথাস্থানে পাঠিয়ে দেন। প্রসঙ্গত, ১৯৮৫-তে ভগবানজীর রামভবনের ডেরা থেকে ত্রৈলোক্য মহারাজের সাংকেতিক ভাষায় লেখা এরকম একটি চিঠি উদ্ধার করা হয়েছে, যা পরে মুখার্জি কমিশনের সামনেও পেশ হয়েছিল। সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা হলেও সেই চিঠিতে মান্দালয় জেলে কষ্টকর যাপনকালেও সুভাষ-সান্নিধ্যের ঘটনাবলী উল্লেখিত আছে। শোনা যায়, ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষকালে পাকিস্তান এরাজ্যের কলাইকুণ্ডায় বিমান আক্রমণ করলেও ভারত পাল্টা পূর্বপাকিস্তান আক্রমণে না যাওয়ার পেছনে মহারাজ ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন— লোকমারফৎ যথাস্থানে প্রয়োজনীয় বার্তা পৌছে দিয়ে।
আজ ৯ আগষ্ট। খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। ৮৩ বছর আগে এ দিনে আগস্ট বিপ্লবের সূচনা হয়, যা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সশস্ত্র বিপ্লবপন্থায় স্বাধীনতা অর্জন করার লড়াইয়ে ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’ প্রাণ দিয়েছেন অনেক অগ্নি সন্তানেরা। বারংবার কারাবাসে দুঃসহ উৎপীড়ন ও যন্ত্রণা ভোগ করেছেন অনেকে। সেরকমই একটি নাম দেশবন্ধুর স্নেহধন্য সুভাষ-সান্নিধ্যে অনুপ্রাণিত বিপ্লবী মহারাজ ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী। স্বাধীনতা সংগ্রামে ও দেশের কল্যাণে নিজের সারা জীবন সঁপে দিয়ে প্রথমে ব্রিটিশের কারাগারে পরে পাকিস্তানি শাসনে তিরিশটি বছর দুঃসহ জীবন কাটিয়ে অবশেষে এদেশে এসে মহাপ্রয়াণ ঘটেছিল যে অদম্য সাহসী বিপ্লবীর আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসও। সেই মহাত্যাগীর ৫৫তম প্রয়াণবার্ষিকীতে তাঁর চরণে শতকোটি প্রণাম।