শীর্ষ আদালতই অভিভাবক

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

বিচার বিভাগ, আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগ— এরা সকলেই কেবলমাত্র মানুষের সেবা করার জন্য আছে। এদের মাধ্যমেই নিশ্চিত করতে হবে ন্যায়বিচার যেন দ্রুততম সময়ে এবং ন্যূনতম খরচে মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। ভারতের প্রধান বিচারপতি বিআর গাবাই এমনটাই মনে করেন। তিনি আরও বলেছেন, ‘আমি সব সময় বিকেন্দ্রীকরণের দৃঢ় সমর্থক। ন্যায়বিচার মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। না আদালত, না বিচার বিভাগ, না আইনসভা— কারোরই অস্তিত্ব রাজপরিবার, বিচারপতি বা নির্বাহী সদস্যদের জন্য নয়। আমরা সবাই আছি মানুষের কাছে ন্যায়বিচার পৌঁছে দিতে।’

বি আর আম্বেদকরকে উদ্ধৃত করে গাবাই বলেছেন, ‘বাবাসাহেব ভারতের ঐক্যের দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। তিনি সব সময় বলতেন, প্রথমে ভারত এবং শেষেও ভারত। তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, আমাদের সংবিধান শান্তি ও যুদ্ধ— উভয় সময়েই ভারতকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী রাখবে।’ আম্বেদকর সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতা ছাড়া রাজনৈতিক সমতার কোনও মূল্য নেই।

‘বিচারব্যবস্থা ও সংবাদমাধ্যম: অভিন্ন নীতি— মিল ও অমিল’ শীর্ষক প্রেম ভাটিয়া স্মারক বক্তৃতা ২০২৫ দিতে গিয়ে ভারতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না বলেছেন, দেশের বিচার বিভাগ ও সংবাদ মাধ্যমকে ন্যায়নিষ্ঠ ও নির্ভীক হতে হবে। গণতন্ত্র রক্ষায় বিচারব্যবস্থা ও সংবাদ মাধ্যমের যৌথ দায়িত্ব রয়েছে। এই দুই প্রতিষ্ঠানকেই জনগণের আস্থা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। বিচারব্যবস্থা ও সংবাদ মাধ্যম উভয়ই কার্যনির্বাহী বিভাগের উপর এবং সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক ভূমিকা পালন করে। তাদের বৈধতা আসে নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, বরং মানুষের আস্থা থেকে।


পক্ষপাত, বৈমষ্য বা মেরুকরণের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সংবাদ মাধ্যমকে শালীন ভাষা, ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবের অবাধ বিনিময় বজায় রাখতে হবে, যাতে গণতান্ত্রিক আলোচনা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। আদালতকক্ষ ও সংবাদকক্ষের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তা হলো, উভয়ের ভিত্তি ন্যায্যতা, নিরপেক্ষতা ও পূর্বাগ্রহ প্রতিরোধের ওপর নির্ভরশীল। তথ্য যদি ভুল বা অসম্পূর্ণ হয়, তবে সিদ্ধান্তও ত্রুটিপূর্ণ হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেবল তখনই সীমিত করা যায় যখন তা অরাজকতা বা সহিংসতা উসকে দেয়। সংবিধানের ১৯(২) অনুচ্ছেদের অধীনে বিধিনিষেধ হতে হবে যুক্তিসঙ্গত, সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পরিস্থিতি-সাপেক্ষ।

সামাজিক সমাজ মাধ্যমের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে বলা যায়, এটি জ্ঞানের গভীরতা কমিয়ে দিচ্ছে। বিতর্কের মেরুকরণ করছে এবং ধারাবাহিক বিষয়বস্তুর কারণে সংখ্যালঘু মতামতকে প্রান্তিক করে তুলছে। যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথ্যপ্রাপ্তি বাড়াচ্ছে, তা প্রায়শই সংলাপের পরিবর্তে ক্ষোভ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ভারতের প্রধান বিচারপতি বি আর গাবাই সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘প্রতিটি ধর্মের নিজস্ব ধর্মগ্রন্থ আছে। কিন্তু প্রত্যেক ভারতীয়ের জন্য সংবিধানই সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। আমাদের প্রথম আনুগত্য এর প্রতিই থাকা উচিত। আদালত হোক সাংবিধানিক নৈতিকতার মন্দির। দেশকে এগোতে হবে কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিনিময়ে নয়। সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কর্তব্য হলো এগুলি সংরক্ষণ ও রক্ষা করা।’

সেই সংবিধান এখন কেন্দ্রের হাতে বিভিন্ন দিক থেকে আক্রান্ত। সংবিধান সংশোধনী বিল এনে বিরোধী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের অভিযুক্ত করার পথে নেমেছে কেন্দ্রের মোদী সরকার। বিরোধী চাপে অবশ্য সেই বিল এখন যৌথ সংসদীয় কমিটির হেফাজতে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে ‘একদল, এক শাসন’ কায়েমের চেষ্টা। ‘এক দেশ, এক ভোট’—এর নামে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখছে। সংবিধান থেকে ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ শব্দটি বাতিলের চেষ্টা চলছে। সঙ্ঘ পরিবারের ইচ্ছানুযায়ী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পিছনে ফেলে সাভারকারের গুণগানে ব্যস্ত। একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। দেশের ঐক্য ও সম্প্রীতির দীর্ঘ ঐতিহ্য ধ্বংস করাই আরএসএসের লক্ষ্য। এমনকি, বিচার ব্যবস্থা বা আদালতকেও প্রভাবিত করা হচ্ছে কেন্দ্রের পক্ষে। একের পর এক মামলায় শীর্ষ আদালতে মোদী সরকার ভর্ৎসিত হলেও প্রশাসনের কোনও হেলদোল নেই। স্বাভাবিক কারণেই শীর্ষ আদালতকেই ‘অভিভাবকের’ ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে।