বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফুটবল তারকা লিওনেল মেসিকে স্বশরীরে দেখার জন্য মাঠে যে চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল, তার নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস পদত্যাগ করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে আপাতত ক্রীড়া দপ্তর থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। তার পাশাপাশি যুবভারতীতে এই তাণ্ডবের জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ ধরানো হল মুখ্যমন্ত্রীর আস্থাভাজন ডিজি রাজীব কুমার এবং ব্যবস্থা নেওয়া হল আরও কয়েকজন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে। পরবর্তী ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত ক্রীড়া দপ্তর মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নিজের হাতেই নিয়েছেন। আর যাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার মুকেশ, ক্রীড়া ও যুব কল্যাণ দপ্তরের সচিবকে ‘শোকজ’ করা হয়েছে। সমান্তরালে আইপিএস অফিসার অনীশ সরকারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে নবান্ন। কর্তব্যে গাফিলতির জন্য তাঁকে সাসপেন্ডও করেছে রাজ্য সরকার। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণের অধিকর্তা দেবকুমার নন্দনকেও তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গোটা বিষয়টি নিয়ে নিরাপত্তা অধিকর্তা পীযুষ পাণ্ডে, এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) জাভেদ শামিম, এডিজি দক্ষিণ বঙ্গ সুপ্রতিম সরকার এবং বারাকপুরের পুলিশ কমিশনার মুরলীধরকে নিয়ে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তাছাড়া যুবভারতীতে জনতার তাণ্ডব ও চরম বিশৃঙ্খলা, মাঠের মূল্যবান আসবাবপত্র ভাঙচুর এবং তাতে অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রাক্তন বিচারপতি অসীমকুমার রায়ের নেতৃত্বে, মুখ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্র সচিবকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছেন। কমিটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখবে কী করে এত বড় কাণ্ড ঘটল মেসিকে দর্শন নিয়ে, যা কলকাতার পক্ষে অত্যন্ত লজ্জাজনক। মুখ্যমন্ত্রী ঘটনার দিন যুবভারতীতে আসার সময় শুনতে পান যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে চরম বিশৃঙ্খলা! এমনকি তিনি ফিরে যান। তারপর এক এক করে ঘটনার সব খবর নিয়ে প্রাক্তন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে কালবিলম্ব করেননি। মুখ্যমন্ত্রী যুবভারতীর দর্শকদের তাণ্ডব ও আয়োজকদের ব্যর্থতা নিয়ে যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা সঠিক। তিনি এই ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। মেসিকে দেখার জন্য দর্শক সমাগম হবে, এটা স্বাভাবিক। যুবভারতীতে মেসিকে দেখার জন্য তারা হাজার হাজার টাকা খরচ করে টিকিট কেটেছিল। কিন্তু মেসি যুবভারতীতে আসার পর তাঁকে ঘিরে ধরে ভিআইপিরা, যাঁদের মধ্যে রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসও ছিলেন।
ক্রীড়ামন্ত্রী এবং আয়োজকদের উচিত ছিল মেসিকে নিয়ে মাঠের চারদিকে ঘোরানো। তা করলে দর্শকরা মেসিকে ভালোভাবে দেখতে পেত। কিন্তু মেসি যতক্ষণ যুবভারতীতে ছিলেন, ততক্ষণ তাঁকে ঘিরে ধরে থাকে কিছু বিশিষ্ট লোকজন। মেসিকে নিয়ে ছবি তোলার জন্য ক্রীড়ামন্ত্রীকেও ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। কিন্তু মেসি বিপুল দর্শক সমাবেশ এবং মাঠে বিশৃঙ্খলা দেখার পর মাঠ ছাড়েন। মেসিকে না দেখতে পেয়ে দর্শকরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং প্রতিবাদস্বরূপ তারা মাঠে জলের বোতাল ছুঁড়তে আরম্ভ করেন। এত জলের বোতল কোথা থেকে এল তাও রহস্যজনক। একদল যুবক মাঠে নেমে মাঠের বহু মূল্যবান আসবাবপত্র ভাঙতে শুরু করে। ভিআইপি’দের বসার জন্য সোফায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ এক শ্রেণির দর্শকদের তাণ্ডব দেখে নিষ্ক্রিয় ছিল। পরে যখন বিশৃঙ্খলা এবং ভাঙচুর চরমে ওঠে, তখন পুলিশ তা থামানোর চেষ্টা করে এবং লাঠি চালায়। দর্শকদের তাণ্ডব চলে অনেক সময় ধরে। পুলিশ আগের থেকে ব্যবস্থা নিলে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের এত ক্ষতি হতো না। কিন্তু পুলিশ ও ইভেন্ট আয়োজকদের ব্যর্থতার জন্য যুবভারতীকে দর্শকদের ক্ষোভ চরমে উঠল এবং তারা ভাঙচুর শুরু করল।
আশ্চর্যের বিষয় এই যে মেসি হায়দরাবাদ, মুম্বই ও দিল্লিতেও যান। সেখানে মেসিকে দর্শকরা ভালোভাবেই দেখতে পান। দিল্লিতে তিনি ক্ষুদে ফুটবলারদের সঙ্গে খেলে তাঁর যাদু দেখান এবং দর্শকরা খুশি হন। কিন্তু কলকাতার যুবভারতীতে মেসিকে নিয়ে যা ঘটল তার জন্য মাথা হেট হয়ে যায়। অতীতে ফুটবল তারকা পেলে এবং ফুটবলের জাদুকর মারাদোনাও কলকাতায় এসেছিলেন। পেলে খেলাতেও অংশগ্রহণ করেন— কিন্তু তাঁদের নিয়ে এমন কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তাঁরা কলকাতার দর্শকদের প্রশংসা করে যান। কিন্তু মেসিকে নিয়ে যা ঘটল তা অনভিপ্রেত এবং লজ্জাজনক। মেসি যুবভারতীতে বিশৃঙ্খলার আঁচ পেয়েই মাঠ ছাড়েন।