অভিজিৎ রায়
বিহার নির্বাচনের ফলাফল এককথায় সকলকে অবাক করেছে। অত্যন্ত জটিল সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে দেশের একটি বৃহৎ রাজ্য বিহারে অবশেষে জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট দুর্দান্ত লড়াইয়ে জয়লাভ করেছে। গণতন্ত্রের জন্মভূমি আবারও দেখিয়েছে যে নির্বাচনী লড়াইয়ে জনগণেরই আসল ক্ষমতা। ২০১০ সালের পর এই প্রথম বিহারে এনডিএ এত বিশাল জয় পেল আর আরজেডি এবং কংগ্রেসের দীর্ঘদিন পর বিহারে ভরাডুবি হল।
বিহারে ভোটের সুনামি এক প্রকার মহাজোটকে নিশ্চিহ্ন করে দিল। এই জয় গত বছর মহারাষ্ট্রে বিজেপি-নেতৃত্বাধীন মহাযুতি জোটের মহা বিকাশ আঘাডির কাছে শোচনীয় পরাজয়েরই প্রতিফলন। আশ্চর্যজনকভাবে, ভারতীয় জনতা পার্টি বিহারে একক বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, এমন একটি রাজ্যে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করেছে যেখানে পার্টির কখনও নিজস্ব কোনও মুখ্যমন্ত্রী ছিল না। জনসাধারণ মহাজোটের পরিবর্তনের স্লোগানের প্রতি কোনও বিশ্বাস দেখায়নি।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় যা একটি ঘনিষ্ঠ প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলে মনে হয়েছিল তা শেষ পর্যন্ত কেবল একটি বিভ্রম প্রমাণিত হয়েছে। জনগণ মহাজোটের পরিবর্তনের স্লোগানকে বিশ্বাস করেনি, না প্রশান্ত কিশোরের ভিন্ন রাজনীতিতে বিশ্বাস করেছে। তথ্য বিশ্লেষণ অব্যাহত থাকবে, তবে বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে, এই ফলাফল বেশ কিছু বার্তা বহন করে। বিহারে তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে আসা ‘পিকে’ (প্রশান্ত কিশোর)-র দল জনসুরাজ পার্টি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেয়েছে। তবে, এই নির্বাচনে জনসুরাজের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত যে দলটি হয়েছে সে হল আরজেডি, যার ভোট ব্যাংকের উপর পিকে-র দল সরাসরি কোপ বসিয়েছে।
বিহারের দীর্ঘতম মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের নেতৃত্বে জনতা দল ইউনাইটেড (জেডিইউ) সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠেছে এবং সম্মানজনক দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে। নির্বাচনের আগে, নীতীশ কুমার মহাজোট নেতাদের লক্ষ্যবস্তুতে ছিলেন। তাঁকে একজন ক্লান্ত, অসুস্থ এবং অবসরপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। বলা হয়, যে বিজেপি নীতীশ কুমারকে জোটের মুখ্যমন্ত্রী মুখ হিসেবে উপস্থাপন করেনি। ফলে অনেকেই নীতীশ কুমারের বিদায়ের কথা প্রায় লিখেই দিয়ে ছিলেন। কিন্ত নির্বাচনের ফলাফল সকলকেই ভূল প্রমাণিত করেছে।
জনগণের রায় ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সর্বাধিক আসন জয়ী রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) কে এবার তৃতীয় স্থানে ঠেলে দিয়েছে। তবে, এই বিধানসভা নির্বাচনের একতরফা ফলাফলের একটি উপসংহার হল যে ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য বিজেপি এবং জেডিইউকে একসঙ্গে থাকতে হবে। ঠিক যেমন নীতীশ কুমার, যিনি তার দলীয়করণের কারণে ‘পল্টু রাম’ তকমা পেয়েছিলেন, তার সম্ভাবনা এবার নেই। তিনি এই সত্যে সান্ত্বনা পেতে পারেন যে, লোকসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাব থাকা ভারতীয় জনতা পার্টি ভবিষ্যতে কেন্দ্রে তাঁর সরকার বাঁচাতে জেডিইউ-এর উপর নির্ভর করবে।
অন্যদিকে, আসাদুদ্দিন ওয়েইসির দল অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন, যা এই নির্বাচনে পিকে-র চেয়ে কম আলোচিত ছিল, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। প্রকৃতপক্ষে, ওয়েইসির দল আরজেডির বিরুদ্ধে তাদের গত নির্বাচনের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছে, যখন আরজেডি তাদের পাঁচজন বিধায়কের মধ্যে চারজনকে কো-অপ্ট করেছিল। ওয়েইসি ছয়টি সীমাঞ্চল আসনে তাঁর প্রভাব বজায় রেখেছেন এবং দলটি তাদের কয়েকটিতে ভালো ফলাফল করেছে। এটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে ওয়েইসি তেজস্বীর চকলেট ছিনিয়ে নিয়েছেন।
অতীতের অভিযোগ ভুলে গিয়ে, ওয়েইসি তার দলকে মহাজোটে যোগ দিতে চেয়েছিলেন এবং মাত্র ছয়টি আসন দাবি করেছিলেন। তবে, তেজস্বী সেই ছয়টি আসনও দিতে অস্বীকৃতি জানান। আজ, ওয়াইসির দল সীমাঞ্চলের সেই ছয়টি আসনের উপর শক্তিশালী দখল প্রতিষ্ঠা করেছে। সীমাঞ্চলে তেজস্বী দ্বিগুণ ধাক্কা খেয়েছেন। ওয়েইসির দল এক সময় ছয়টি আসনে এগিয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত পাঁচটি আসন জিতে নিয়েছে। অন্যদিকে, বিহারের রামগড় আসনে, বহুজন সমাজ পার্টির হাতিটি সবাইকে পায়ের তলায় পিষে ফেলে ওই আসনটি জিতে নিয়েছে। এখানে, বিএসপি আরজেডি এবং বিজেপি উভয়কেই ছাড়িয়ে গেছে। প্রশান্ত কিশোরের মতো নেতার প্রতি বিহারের জনগণের বার্তা স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন ছিল। পিকে-র দল জনসুরাজ- এর একটি আসনও না জিততে পারা থেকে স্পষ্ট যে তাঁর দল নির্বাচনী মাঠে নামার আগেই রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে প্রস্তুত। আসলে তাঁর দলের ৯৮ শতাংশ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, বিহার নির্বাচনে প্রশান্ত কিশোরের আত্মবিশ্বাসের উৎস ছিল বিধানসভা উপনির্বাচনে তার দলের ১০ শতাংশেরও বেশি ভোট পাওয়া। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে, আরও কিছুটা প্রচেষ্টা করলে হয়তো বিহার নির্বাচনে তার ভাবমূর্তি আরও প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবেন। তবে, তার দল এবারের নির্বাচনে ভোট কাটার ক্ষমতাও অর্জন করতে ব্যর্থ হয়।
তাছাড়া, প্রশান্তের কণ্ঠস্বর জনসাধারণের কাছে পৌঁছতে না পারার একটি কারণ হল তিনি তেজস্বীকে চ্যালেঞ্জ করেও পরে পিছু সরে যান। ফলে, বিহারের মানুষ তাঁর রাজনীতিকে ব্যবসা হিসেবে দেখতে শুরু করেন। প্রশান্ত যদি তেজস্বীকে চ্যালেঞ্জ করে রাঘোপুর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন, ফলাফল যাই হোক না কেন, অন্তত তিনি অন্তত অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো স্বীকৃতি পেতেন, যিনি ২০১৪ সালে বারাণসী থেকে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।