ফিরে আসবে দুঃস্বপ্নের রাত

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

পরমাণু ক্ষেত্রে বেসরকারি পুঁজির অবাধ বিচরণের দাবি উঠে আসছে অনেকদিন থেকে। উদারনীতি ও বেসরকারিকরণের জমানা চালু হওয়ার পর থেকে প্রধানত আমেরিকা থেকে প্রবল চাপ আসতে থাকে মার্কিন পরমাণু চুল্লি নির্মাতাদের জন্য ভারতের বাজার খুলে দেওয়ার। মূলত মার্কিন চাপের কাছে। নতি স্বীকার করে বামপন্থীদের বিরোধিতাকে পাত্তা না দিয়ে প্রথম ইউপিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর করেন। সেই চুক্তির অনেক গোপন শর্তের মধ্যে ছিল, ভারতের বাজারে মার্কিন পরমাণু চুল্লির অবাধ প্রবেশের ব্যবস্থা। ভারতে পরমাণু বিদ্যুৎ ক্ষেত্র পুরোপুরি রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের অধীন।

বর্তমানে যত পরমাণু বিদ্যুৎ চুল্লি আছে তার সব ক’টিই প্রায় রাশিয়া থেকে কেনা। ভারতে পরমাণু চুল্লি বিক্রির ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা পরমাণু দায়বদ্ধতা আইন। চুল্লিতে দুর্ঘটনা হলে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের যাবতীয় ক্ষতির দায় নিতে হয় চুল্লি নির্মাতা এবং চুল্লির পরিচালন সংস্থাকে। এই বিপুল দায়বদ্ধতা নিয়ে মার্কিন চুল্লি নির্মাতারা ভারতে চুল্লি বিক্রিতে রাজি নয়। তাই আমেরিকার তরফে প্রবল চাপ আসে দায়বদ্ধতা আইন শিথিল করার। দেশজুড়ে প্রবল বিক্ষোভের চাপে ইউপিএ সেই আইন সম্পূর্ণভাবে বাতিল করতে পারেনি। তাই পরমাণু বিদ্যুৎ ক্ষেত্রকে বেসরকারিকরণও সম্ভব হয়নি। মোদী সরকার এখন সেই দায়িত্ব পালন করে আমেরিকাকে খুশি করতে উদ্যোগী হয়েছে। নতুন বিলটি এবার সংসদে পাশ হওয়ায় পরমাণু ক্ষেত্রে আর দেশি-বিদেশি পুঁজির দৌরাত্ম্য আটকানো যাবে না।

দিল্লিতে ভারত-আমেরিকা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে ছয় রাউন্ডের আলোচনা সেরে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দল ফিরে যেতে না যেতেই মোদী সরকারের মন্ত্রীসভা পরমাণু বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে তথা অসামরিক পরমাণু ক্ষেত্রকে দেশি-বিদেশি বেসরকারি পুঁজি নিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করে দেবার বার্তা দিয়ে দিয়েছে। সন্দেহ নেই ট্রাম্পের চাপে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি কমিয়ে আমেরিকা থেকে তেল-গ্যাস, যুদ্ধাস্ত্র সহ অন্যান্য পণ্য বড় আকারে আমদানির সিদ্ধান্তের এটা সম্প্রসারিত অংশ। মোদী মন্ত্রীসভা ১৯৬২ সালের পরমাণু বিদ্যুৎ আইন এবং ২০১০ সালের পারমাণবিক দুর্ঘটনার দায়বদ্ধতা আইন সংশোধন করে নতুন আইনের জন্য তৈরি বিল অনুমোদন করেছে। তাতে কঠোরভাবে সরকারি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ অসামরিক পরমাণু ক্ষেত্রকে নিরঙ্কুশ সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে দেশি-বিদেশি বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থার মুনাফার রাস্তা পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে।


মোদী সরকার দূষণ বর্জিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হিসাবে ২০৪৭ সালের মধ্যে ১০০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ পরমাণু শক্তি থেকে উৎপাদন করতে চাইছে। চাইলে একাজ রাষ্ট্রায়ত্ত পরমাণু বিদ্যুৎ কর্পোরেশনের মাধ্যমেই করা যায়। কিন্তু মোদীরা যেহেতু বেসরকারি কর্পোরেটের হাতে অর্থনীতির যাবতীয় ক্ষেত্র তুলে দেবার নীতিতে বিশ্বাস করেন, তাই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে সরিয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বেসরকারি পুঁজিকে। এমনকি ১০০ শতাংশ সরকারি মালিকানার পরমাণু বিদ্যুৎ কর্পোরেশনকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার ছক কষছে। বেসরকারি উদ্যোগে আপাতত ৪৯ শতাংশ বিদেশি মালিকানার ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে। অচিরেই সেটা বিমা ক্ষেত্রের মতো ১০০ শতাংশ যে হয়ে যাবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। মোদী সরকার পরমাণু বিদ্যুৎ বেসরকারিকরণে থেমে থাকছে না। সেই বেসরকারি চুল্লি দুর্ঘটনায় যদি তেজস্ক্রিয়ার বিপর্যয় ঘটে, হাজার-লক্ষ মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে, তাহলে তার দায় কে নেবে, সেটা অস্বচ্ছ থেকে যাচ্ছে। বিদেশি চুল্লি বিক্রেতা এবং দেশি-বিদেশি চুল্লি পরিচালকরা তার দায় নেবে না। নিলেও যৎসামান্য। ভোপাল গ্যাসের দুঃস্বপ্ন কি আবার ফিরে আসবে?