প্রজন্মের ফলকে দেশজ সংবিধানে বদলের ইজারা!

প্রতীকী চিত্র

সুবীর পাল

‘কন্সটিটিউশন ইজ নট এ মেয়র লইয়ারস ডকুমেন্ট, ইট ইজ এ ভিকল অফ লাইফ এন্ড ইটস স্পিরিট ইজ অলওয়েজস দ্য স্পিরিট অফ এজ।’ এই বিখ্যাত উক্তিটি ভারতীয় সংবিধানের প্রধানতম স্থপতি ভীমরাও রামজী আম্বেদকরের। যে উক্তিটির বাংলা অর্থ হলো, সংবিধান শুধুমাত্র আইনজীবীদের কাছে নিছক দলিল নয়। এটি জীবনের একটি অমূল্য বাহন। এর চেতনাবোধ হলো চিরযুগের চেতন বিকাশ।

এখানেই প্রত্যাশিত ভাবে কিছু প্রশ্নাবলী উঁকি দেয় জনমানসের মনে। সেই পরম্পরার বহুচর্চিত যুগকে কেন্দ্র করে। ভারতের সংবিধান সত্যিই কি কালজয়ী? নাকি সময়ের স্রোতে সেও পরিবর্তনের অঘোম প্রত্যাশী?
সংবিধান হলো আধুনিক বিশ্বে একটি দেশের আত্ম-দর্শনের এক শপথের দলিল। ভারতের সংবিধান যে একই ঐতিহ্যের ধারাবাহিক পরম্পরা। তবু সময় বড়ই আগুয়ান। পরিবর্তনের অবিচ্ছেদ্য সাথী। আর এই চলমান স্রোতে অতীত রচিত আমাদের সংবিধান কতটা পুঙ্খানুপুঙ্খ কালজয়ী, তা নিয়েই তো দেশীয় স্তরে অবাধ প্রশ্নের ছড়াছড়ি।


গণতান্ত্রিক দেশে প্রজাতান্ত্রিক ভারতের পবিত্রতম গাঁটছড়ার মঙ্গলসূত্র হলো আমাদের অন্তরাত্মার সংবিধান। এ হেন জনগণ সংবিধান আক্ষরিক অর্থেই বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহানের এক দেশজ স্বভিমানের মহান স্বীকৃত মঙ্গলকাব্য।

১৯৪৭ সাল ১৫ আগস্ট। দুশো বছরের ব্রিটিশ ভারত সেই মধ্য রাতে বিশ্বের কাছে নতুন পরিচয়ে উন্মেষিত হলো ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে। তীব্র আকাঙ্খিত স্বাধীনতা প্রাপ্তির সোনালি গ্রন্থিতে। এরপরেই হন্যে হয়ে খুঁজে নেওয়ার পালা, দেশীয় পরিকাঠামোয় গণবিচিত্র সমাজ ব্যবস্থার গর্ভে বৈচিত্র্যময় একাত্মতার সন্ধিতে প্রজাতান্ত্রিক গ্রন্থির মহান মহাকাব্য ‘সংবিধান’কে। অবশেষে হাঁটি হাঁটি পায়ে পায়ে উদিত হলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি। ভারতীয় আইনসভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক প্রস্তাবিত সংবিধান। সেটি অবশ্য দেশের নাগরিকদের উৎসর্গে প্রথমবারের মতো লাগু করা হয় ঠিক দুই দিন পর ২৬ জানুয়ারি। পালিত হলো সেদিন সর্বপ্রথম দেশের নস্টালজিক প্রজাতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র দিবস। ফলে সারা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ওই দিন থেকে সুচনা হয়েছিল কিংবদন্তি সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থা।
দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ইচ্ছা অনুসারে প্রথম সংবিধানের কপিটি ছাপা অক্ষরে প্রকাশিত হয়নি। দেশজ প্রাচীন পুঁথির ছায়ায় সেটি লেখা হয়েছিল হস্তাক্ষরে। লিখেছিলেন তদানীন্তন প্রথিতযশা ক্যালিগ্রাফার প্রেমবিহারী নারায়ণ রায়জাদা। এই ক্যালিগ্রাফি শিল্পী সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে এই পবিত্র ব্রত সম্পন্ন করেছিলেন। ইটালিক হলফে লিখেছিলেন। ৪৩২টি কলমের নিব ব্যবহার করেন। যার মধ্যে ৩০৩টি ক্যালিগ্রাফি নিব আনানো হয়েছিল ব্রিটেন ও চেকোস্লোভাকিয়া থেকে। ২৫১টি পাতা পার্চমেন্ট কাগজের উপর লেখা হয়। যার ওজন ছিল তিন কেজি ৭৫০ গ্রাম। আটটি তফশিল এবং প্রস্তাবনা সহ ৩৯৫টি ধারা উল্লেখ ছিল তাতে। পুরোপুরি নির্ভুলভাবে সংবিধানটি লিখতে তিনি সময় নিয়েছিলেন ছয় মাস। তবে এই মূল সংবিধানের হিন্দি সংস্করণটি তৈরি করেন বসন্তকৃষাণ বৈদ্য।

সংবিধান কি শুধু লেখ্য শিল্পেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তা তো হতে পারে না। তাই সংবিধানের ছবি আঁকবে কে? ডাক পড়লো কালজয়ী চিত্রকর নন্দলাল বসুর। মূল সংবিধানের পাতায় পাতায় তিনি সৃষ্টি করলেন তাঁর তুলির আঁচড়ে অপার শিল্পরূপ। ভারতের সনাতন রূপে ও বর্ণছটায় রঙিন হয়ে পাতার পর পাতা। মোট ২২টি ছবিতে মূর্ত হয়ে ওঠে ভারতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শৈল্পিক মগ্নতা। প্রকৃত সনাতনী ভারতবর্ষকে তিনি চিত্রিত করেছিলেন প্রাকৃতিক রঙের ঋষি সাধনায়।

অন্যদিকে, ভারতের সংবিধানের জনক ছিলেন ভীমরাও রামজী আম্বেদকর। তিনি ছিলেন দেশের প্রথম কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী। সংবিধান প্রণয়ন খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনিই ছিলেন এর মূল রচনার খসড়া তৈরির প্রধানতম স্থপতি। ভারতবর্ষকে তাঁর এই রচনার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক ও ন্যায়তান্ত্রিক এই ত্রিধারাকে প্রকৃতই ত্রিবেণী সঙ্গমে অন্তর্ভুক্তি করিয়ে ছিলেন যথার্থ নিরপেক্ষ বিচক্ষণ মুন্সীয়ানায়। ওই সংবিধান প্রণয়ন খসড়া কমিটিতে ছিলেন আরও ছয়জন সদস্য। যথাক্রমে তাঁরা হলেন এন. গোপালস্বামী, আল্লাদি কৃষ্ণস্বামী আয়াস, কে এম মুন্সি, সাইজো মোলা সাদুল্লা, ডিপি খৈতান এবং এন. মাধব রাও।

এত গেল ভারত কলবরের পরমাত্মার অনির্বাণ আলোকবর্তিকা সম সংবিধান সৃষ্টির এক সংক্ষিপ্ত উপকথা। কিন্তু মহাকালের ঘড়ির কাঁটা যে বড্ড অবাধ্য। কিছুতেই থামতে শেখেনি সে। চিরচঞ্চল সময় তাই ভারত ভূখন্ডের কোনারকের ছায়ালগ্ন ক্রমেই পেরি​​য়ে চলেছে এক ক্লান্তিহীন অভিযাত্রার। জয় জওয়ান জয় কিষাণ থেকে মেরা ভারত মহানের স্বপ্নঘোরে। মেক ইন ইন্ডিয়া হতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগের অভিমুখে। সেই ১৯৫০ সাল থেকে ২০২৫ সালের কোনি ফাইট ফাইট শপথে। ৭৬ তম প্রজাতন্ত্র দিবস অতিক্রমের এক অন্তর্দেশীয় সোনালী যাত্রাপথে গুটি গুটি পদযাত্রায়। সুতরাং অনিবার্য ভাবেই সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সংবিধানের ভাবধারাতেও বিবর্তন আবশ্যক হয়ে ওঠেই। এটাই তো অগ্রগতির অঘোম দস্তুর। তারই সূত্র ধরে আমাদের দেশে ২০২৫ সালের আগাস্ট মাস পর্যন্ত এযাবৎ ১০৬ বার সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো সংশোধনীটি আনা হয় ১৯৫১ সালের ১৮ জুন। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর শাসনকালে। দেশব্যাপী জমি আইনে প্রান্তিক পর্যায়ের বিকেন্দ্রীকরণ ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে রাজ্য বিধানসভায় ভূমি সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনকে চুড়ান্ত ক্ষমতাদান প্রসঙ্গে। ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬ সালে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ৪১ তম সংশোধন করা হয়। যা এককথায় বিশ্বের দরবারে ঐতিহাসিক পরিবর্তন হিসেবে সূচিত হয়ে রয়েছে। প্রকারান্তরে এই সংশোধনীকে বলা হয় ভারতের ক্ষুদ্র সংবিধান। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ভারত সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে একটা পৃথক স্থান অধিকার করে নেয়।

মূল সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী তিন ধরনের প্রক্রিয়ায় সংশোধনী আনা যায়। প্রথমতঃ সংসদের উভয় কক্ষে সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে এই সংশোধনী পাশ করানো যায়। ধ্বনি ভোট বা সরাসরি ভোটাভুটির দ্বারা। এছাড়া সংবিধানের ৩৬৮ ধারা অনুসারে ভিন্ন দুই পদ্ধতিতেও সংশোধনী বাস্তবায়িত করা সম্ভব। তবে কোনও রাজ্য বিধানসভায় সংবিধান সংশোধন করা আদৌ সম্ভবপর নয়। সর্বশেষ যে ১০৬ নম্বর সংশোধনীটি আনা হয়েছে তা দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমলে। ২০২৩ সালের নারী সংরক্ষণ বিল অনুসারে ২৩৯এএ অনুচ্ছেদে এই বাস্তবায়ন ঘটানো হয়। সেই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় সেটি। এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিশেষ করে দিল্লি বিধানসভায় মহিলাদের জন্য এক তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষিত করা হয়।

সংবিধান যদি আমাদের স্বাধীনোত্তর দেশের এক চিরন্তনী স্বভিমানী সিন্দুকে সযত্নে গচ্ছিত রাখা স্থায়ী যক্ষের বৈদুর্য ধন ধরা হয় তবে তার সংশোধনী হলো চলমান অরণ্যদেবের প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রত্যয়ের একই সংস্কারজাত ভাবধারার বংশধারা। পার্লামেন্টের পুরোনো ভবন ছেড়ে সংবিধান বর্তমানে পাড়ি জমিয়েছে ভারতীয় নতুন সংসদ ইমারত সেন্ট্রাল ভিস্তাতে। ২০২৩ সালের ২৮ মে থেকে। প্রশাসনের নতুনতর রাজদণ্ডকে সাক্ষী রেখে। সেখানকার কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে হিলিয়ামে ভরা এক সুসজ্জিত বাক্সের অভ্যন্তরে।
এ হেন ঐতিহ্যমন্ডিত ভারতীয় সংবিধান সম্পর্কে দেশের নাগরিকদের একাংশের মনে উঠে আসে নানা সংশয়। বিবিধ প্রশ্ন। দেশের মধ্যেই নানা প্রান্তে উঠে আসে এক গুরুত্বপূর্ণ দ্বিধা। আমাদের সংবিধানের সরাসরি ছত্রছায়ায় আজকের দিনে এসে আমরা কতটা সুরক্ষিত? প্রকৃতই এটা এখন কতটা আমজনতার প্রত্যাশা পূরণে সার্থক? সত্যিই কি সময়ের গতিময়তাকে মান্যতা দিয়ে সংবিধান নতুন করে রচনার সময় এসে গেছে। নাকি চলন্ত গাড়ির চাকার টিউবে লিক্ সারানোর মতো শুধু সংশোধনী পট্টি দিয়ে যেতে হবে? ১০৬ বার তো গ্যাটিস দেওয়া হলো। সংবিধান চালু হবার পরের বছরেই তো শুরু সংশোধনী প্রক্রিয়া। চলতি বছরেও তার ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। সংসদ কক্ষে যাঁরা সংশোধনীর পক্ষে বিপক্ষে ভোট দেন আজ তাঁরাই তো সংবিধান স্বীকৃত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখান একদম খুল্লামখুল্লা জনসমক্ষে। কী ট্রেজারি বেঞ্চের কী বিপক্ষ আসনের। দলবদলের আইন বাঁচিয়ে বহাল তবিয়তে অনেক সাংসদ ও বিধায়ক তো নির্লজ্জ ভাবে অন্য রাজনৈতিক দলের পতাকা হাতে বহন করতেও দ্বিধা বোধও করেন না। মুখে তাঁদের এক ডায়লগ, মানুষের সেবা করতে চান। যেমনটি আবার লজ্জা বোধ করেন না কোনও কোনও রাজ্যের খোদ মুখ্যমন্ত্রী সাংবিধানিক আসনে বসে ব-কলমে সংবিধানের কোনও সংশোধনকে মানবেন না বলে জনসমক্ষে ব্যক্তিগত হুমকি দিতে।

দেশের সংবিধান থাকতে কিসের এত এত অপরাধ তত্ত্বের লাগামছাড়া অবক্ষয়? কেন আইন প্রণেতারা আজ অনেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠতে পেরেছেন আইনভঙ্গকারী হিসেবে? কেন বহু আইন রক্ষাকারীরা আজও জেলমুখী? সংবিধানের কি কোনও সংস্থানই নেই এসব অধঃপতন রুখে দেবার। কী দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েই চলেছে ক্রমশঃ, একবারও কি তা পর্যালোচনা করার সময় হয়নি আমাদের এখনও পর্যন্ত? পুরাতনী সংবিধান কি শুধুই হিলিয়ামের আকরে থাকা এক সনাতনী শো-পিস হয়েই রয়ে যাবে যুগ যুগ ধরে। ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে। কল্কি অরাজকতায় অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের স্থবির ভূমিকায়।

অগত্যা কিইবা আর আমাদের করার আছে? আমরা যে হাজার হলেও আমআদমি না? আমাদের দেশের গণদেবতার তোলা কন্ঠস্বরে কেইবা আর মূল্য দিতে চায়। হতেই পারে আমাদের দেশের এটাই আবালবৃদ্ধবনিতার চিরাচরিত অভ্যাসের মেনে নেওয়া। কিন্তু আগামী যুগ অভিমুখী ​অবাধ্য সময় তো মেনে নেওয়ার বান্দা মোটেও নয়। সে যে পরিবর্তিত যুগের প্রয়োজন মাফিক পরিবর্তনের চলচঞ্চল অগ্রগতির ডাক হরকরা। সুতরাং তার বিলি করা কালের লেফাফায় থেকেই যায় কিছু প্রশ্নের ইস্তেহার। আমাদের তিনি বৃদ্ধ হলেন সংবিধান প্রকৃত কালের রূপরেখায় সত্যিই কি নবজন্মের সরণিতে অপেক্ষারত? পরিশেষে একটা কালজয়ী জীবনমুখী গানই না হয় গেয়ে আত্মসন্তুষ্টি লাভ করা যাক, প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তর তো জানা।
ঘড়ি চলে অবিরাম টিক টিক টিক। সংবিধান একই রয়েছে ঠিক ঠিক ঠিক। তাই আমার কথাটি ফুরোলো নটে গাছটি মুড়োলো। কিন্তু বারবার সংশোধিত হলো, পরিবর্তিত হলো না আরবার।