জেন জি-র কাছে দার্শনিক অরবিন্দ ঘোষের বৌদ্ধিক প্রাসঙ্গিকতা

ফাইল চিত্র

রতন ভট্টাচার্য

ভারতের নবজাগরণকালীন বৈপ্লবিক চিন্তার মধ্যে যিনি সবচেয়ে স্বতন্ত্র, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং অনন্য দার্শনিক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ অথবা ঋষি অরবিন্দ। তাঁর চিন্তার পরিধি যেমন গভীর, তেমনই পরিব্যাপ্ত— রাজনীতি থেকে বিপ্লব, বিপ্লব থেকে সাহিত্য, সাহিত্য থেকে যোগ ও মানব-চেতনার বিবর্তন— সমস্ত ক্ষেত্রেই তিনি রেখেছেন এক বিরাট বৌদ্ধিক ইমপ্রিন্ট। আজকের জেনারেশন জি একটি প্রজন্ম যারা ডিজিটাল ঝড়ের মধ্যে বেড়ে উঠছে, অভূতপূর্ব প্রযুক্তি-নির্ভরতা, তীব্র মানসিক চাপ, পরিচয়-সংকট, বিশ্বায়নের সংঘর্ষ ও সামাজিক ন্যায়ের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন— তাদের কাছে আরবিন্দ ঘোষকে ফিরে দেখা একটি নতুন মানবিক ও বৌদ্ধিক পথ সন্ধানের সুযোগ করে দেয়। কারণ তিনি শুধু অতীতের একজন ইংরেজ-বিরোধী বিপ্লবী নন; তিনি ভবিষ্যতের দার্শনিক, এক visionary, যার কথাগুলি আজকের পরিবর্তিত পৃথিবীতে আরও বেশি সত্য বলে মনে হয়।

শ্রী অরবিন্দ ছিলেন একাধারে দার্শনিক, কবি, যোগী, রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও আধ্যাত্মিক গুরু। তাঁর রচনাসমূহ বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই প্রকাশিত এবং আধুনিক ভারতীয় চেতনায় বিরাট প্রভাব ফেলেছে। The Life Divine অরবিন্দের আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক চিন্তার শীর্ষ প্রকাশ। এখানে তিনি মানবজীবন, চেতনার বিকাশ, অধিবিদ্যা ও ‘Supermind’ ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। Savitri: A Legend and a Symbol এক মহাকাব্যের মতো বিস্তৃত দার্শনিক কবিতা।


Essays on the Gita— গীতার উপর অরবিন্দের ব্যাখ্যা— গীতি দর্শন, কর্মযোগ, ভক্তিযোগ ও জ্ঞানযোগ নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ। The Synthesis of Yoga বিভিন্ন যোগপথকে একত্র করে এক সামগ্রিক যোগরূপ ব্যাখ্যা—Integral Yoga। The Human Cycle, The Ideal of Human Unity, War and Self-Determination– র রচনাগুলোতে মানবসমাজ, রাষ্ট্র, মানবসভ্যতার বিবর্তন এবং যুদ্ধ–শান্তি বিশ্লেষণ করেছেন। Letters on Yoga শিষ্যদের উদ্দেশে লিখিত চিঠি— যোগ, সাধনা, চেতনার পরিবর্তন ও জীবনচর্চা নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল। The Foundations of Indian Culture ভারতীয় সংস্কৃতির ভিত্তি, দর্শন, সাহিত্য ও চেতনার স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে। On Poetry and Poetics, The Future Poetry কবিতা কীভাবে সৃষ্টি হয়, কবিতার কলা, ভবিষ্যৎ কাব্যের ধারা— এসব বিষয়ে চমৎকার রচনা। Bande Mataram ও Karmayogin পত্রিকার রাজনৈতিক প্রবন্ধ স্বদেশী আন্দোলনের সময় দেশের মুক্তি, জাতীয় জাগরণ, ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম নিয়ে লেখা রাজনৈতিক রচনা। যদিও তাঁর প্রধান লেখা ইংরেজিতে, বাংলাতেও তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনা আছে— কলিকাতা থেকে বন্দেমাতরমে প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘ধর্ম ও জাতীয়তা’ ‘কৈবল্য’ চিঠিপত্র ও ভাষণ প্রাথমিক পর্যায়ের বাংলা কবিতা ও অনুবাদ। তিনি এক জায়গায় লিখেছিলেন, ‘The seeker after truth must be ready to follow wherever it leads.’ এই উদ্ধৃতি যেন জেনারেশন জেড-এর আত্মার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ—বদ্ধমূল চিন্তাকে ভেঙে নতুন পথ খোঁজাই তাদের প্রবণতা। তাই অরবিন্দের চিন্তা তাঁদের মুক্তমনা অভিযাত্রায় একটি দিশারি হয়ে ওঠে।

জেনারেশন জি-র সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তাদের অবিরাম প্রশ্ন করার ক্ষমতা। তারা জেনে নিতে চায় সত্য কী, ন্যায় কী, স্বাধীনতা কী, আর মানবিক হওয়া মানে কী। এরা কর্তৃত্ব অন্ধভাবে মানে না, আবার পুরোনো নৈতিকতার কাঠামোও সহজে গ্রহণ করে না। অরবিন্দ ঘোষ তাঁদের জন্য এক অনুপম দৃষ্টান্ত, কারণ তাঁরও বৌদ্ধিক যাত্রা শুরু হয়েছিল গভীর প্রশ্ন থেকে, আর শেষ হয়েছিল গভীর উপলব্ধিতে। এই প্রজন্ম যে যুগে জন্মেছে, সেখানে মনোযোগ ভঙ্গুর, চিন্তা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, সম্পর্ক ভার্চুয়াল, আর সময় যেন ক্ষুদ্র টুকরোয় পরিণত। তথ্যবিস্ফোরণের যুগে তারা ক্লান্ত, উদ্বিগ্ন এবং ছুটে চলার মধ্যেও এক ধরনের গভীর নিঃসঙ্গতার ভার বহন করে। অরবিন্দ বারবার বলেছেন যে মানুষের প্রকৃত শক্তি নিহিত তার ‘অন্তরসত্তা’-য়। তিনি লিখেছিলেন, ‘The first principle of true teaching is that nothing can be taught.’ অর্থাৎ মানুষকে বাহির থেকে চাপিয়ে দিয়ে নয়, ভেতরের আত্ম-আবিষ্কার দিয়েই সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন করতে হয়। এই বাণী জেনারেশন জেনারেশন জি-র জন্য এক বিশেষ বার্তা— আজকের অত্যধিক তথ্য-নির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি বা স্ক্রিন-জীবনের বিভ্রান্তির মধ্যে নিজস্ব চিন্তা তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবই শেখানো যায় না; কিছু জিনিস নিজের জীবন, অভিজ্ঞতা ও অন্তর-বিবেচনা থেকে বুঝে নিতে হয়।

বৌদ্ধিক অরবিন্দের বিপ্লবী জীবনও আজকের তরুণদের জন্য বিশেষ তাৎপর্যময়। তিনি স্বদেশী আন্দোলনের উজ্জ্বল মুখ ছিলেন। তাঁর লেখায় ছিল এমন দীপ্ত আত্মমর্যাদার আহ্বান যে ব্রিটিশ সরকার পর্যন্ত আশঙ্কিত হয়ে ওঠে। কিন্তু বিশেষত্ব এই যে, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন কোনো সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদে আটকে থাকেনি। তিনি লেখেন, ‘Nationalism is not a mere political programme; it is a religion that has come from God.’ এই উক্তি দেখায় যে তাঁর চিন্তায় জাতীয়তাবাদ ছিল নৈতিক দায়িত্বের প্রতীক, সংকীর্ণতা নয়। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি এটিও বলেছেন, ‘All nations, even the greatest, must progress towards a larger unity.’ এই দুই বক্তব্যের মধ্যেই নিহিত আছে আজকের জেনারেশন জি-র দ্বৈরথ— স্থানীয় পরিচয়ের সঙ্গে বৈশ্বিক পরিচয়ের সমন্বয়। অরবিন্দ প্রযুক্তিকে অস্বীকার করেননি; তবে তিনি মানুষকে সবসময় সতর্ক করেছেন বাহিরের শক্তির দাস না হয়ে অন্তরের শক্তির মালিক হতে। তিনি বলেছেন, ‘It is in the inner silence that the world-problems will be solved.’ অর্থাৎ শুধু বাহ্যিক প্রযুক্তি বা রাজনৈতিক কাঠামো দিয়ে সমস্যার সমাধান নয়; সমস্যার মূল সমাধান আসে মানুষের চেতনার জাগরণে। আজকের ডিজিটাল যুগে, মন শান্ত রাখার গুরুত্ব যে কতটা, তা তরুণেরা আগের চেয়ে অনেক বেশি উপলব্ধি করছে। তাই অরবিন্দের এই ‘inner silence’-এর দর্শন তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মবিকাশের জন্য বিশেষ প্রাসঙ্গিক।

জেনারেশন জি-র আরেক পরিচয় তাদের তীব্র ন্যায়বোধ। জলবায়ু আন্দোলন, পরিবেশ সংরক্ষণ, লিঙ্গসমতা, LGBTQ+ অধিকার, প্রাণী কল্যাণ— সব ক্ষেত্রেই তারা বেশি সচেতন, বেশি সোচ্চার। অরবিন্দ ঘোষ তাঁদের এই প্রশ্নমুখিতা ও ন্যায়-অন্বেষাকে নৈতিক সাহস হিসেবে দেখতেন। তাঁর ভাষায়, ‘Courage and love are the only indispensable virtues.’ এই উক্তি তরুণ প্রজন্মকে নতুন করে ভাবতে শেখায় যে ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করা মানে কেবল সংঘর্ষ নয়, ভালোবাসার এক বৃহত্তর কর্ম। মানবতাকে উন্নীত করার সংগ্রামও এক ধরনের প্রেম— মানবতার প্রতি স্নেহ, দয়া ও দায়বদ্ধতার প্রকাশ। জেনারেশন জি এমন এক সময়ের সন্তান, যখন বিশ্বায়ন একদিকে মানুষকে কাছাকাছি এনেছে, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক পরিচয়কে জটিল করে তুলেছে। নিজের পরিচয় ঠিক রেখে বহুত্বকে গ্রহণ করা আজ এক গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। লিখেছেন, ‘Spirituality is not a denial of life but a greater life.’ এটি এমন এক বাক্য যা জেনারেশন জি-র কাছে নতুন আলো এনে দেয়— কারণ তাদের অনেকেই মনে করে আধ্যাত্মিকতা মানেই বাস্তবতা থেকে পালানো। অরবিন্দ বলেন, না, আধ্যাত্মিকতা মানে জীবনকে উচ্চতর, সমন্বিত ও মানবিক মাত্রায় গ্রহণ করা। এই ধারণা আধুনিক তরুণকে শেখায় যে দৈনন্দিন বাস্তবতা ও অন্তর্দর্শন একই যাত্রাপথের দুটি ধাপ। অরবিন্দ ঘোষ মানুষের বিবর্তন নিয়ে যে তত্ত্বের কথা বলেছেন, তা জেনারেশন জি-র কল্পনাশক্তিকে গভীরভাবে উজ্জীবিত করতে পারে। তিনি মনে করতেন, মানুষ একটি ‘transitional being’— এখনো সম্পূর্ণ হয়নি, বরং আরও পরিণত হওয়া বাকি। তাঁর ভাষায়, ‘Man is a transitional being, he is not final.’ প্রযুক্তি, AI, ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান— এসব নিয়ে যে প্রজন্ম সবচেয়ে বেশি চিন্তা করে, তারা এই ধারণাকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। তাঁদের কাছে মানব-চেতনার বিবর্তন মানে সৃজনশীলতা, নৈতিকতা, বুদ্ধিমত্তা ও সহমর্মিতার নতুন সীমায় পৌঁছোনো। অরবিন্দ তাঁদের এই অগ্রযাত্রায় এক ধরনের দার্শনিক জ্বালানি দিয়ে যান।

আজকের তরুণদের সবচেয়ে বড় সমস্যা মানসিক স্বাস্থ্য। তারা উদ্বেগ, হতাশা, একাকিত্ব, তুলনার ফাঁদ, এবং ২৪ ঘণ্টা সংযোগের চাপের মধ্যে বাস করে। অরবিন্দের দর্শনে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অমূল্য উপাদান রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘Peace is the foundation of all perfection.’ তাঁর এই বাণী আজকের প্রজন্মের কাছে বিশেষ অর্থ বহন করে— যে পৃথিবীতে সাফল্য, গতি ও প্রতিযোগিতাই যেন চূড়ান্ত লক্ষ্য, সেখানে অন্তরের শান্তি যে আসলে জীবনের ভিত্তি। তরুণ প্রজন্ম mindfulness ও healing-এর প্রতি যে ঝোঁক দেখাচ্ছে, তা অরবিন্দের দর্শনের সঙ্গে আশ্চর্যভাবে মিলে যায়। জেনারেশন জি সৃজনশীলতায় বিশ্বাসী। অরবিন্দ লিখেছেন, ‘A god’s labour is ours; we have to work out the divine in the world.’ এই পঙক্তি তরুণকে বলে যে তার জীবনের কাজ শুধুই চাকরি বা সফলতা নয়; তার মধ্যে রয়েছে পৃথিবীকে আরও সুন্দর, ন্যায়সঙ্গত ও মানবিক করে তোলার দায়িত্ব। জেনারেশন জি-র কাছে অরবিন্দ ঘোষ প্রাসঙ্গিক কারণ তাঁর দর্শন সময়োত্তীর্ণ। তিনি অতীতের নন, ভবিষ্যতের দার্শনিক। তাঁর চিন্তা তরুণদের শেখায়— যে পরিবর্তন বাহিরে চাই, তা প্রথমে ভেতরে ঘটাতে হয়। যে শক্তি সমাজে খুঁজছি, তা আমাদের মধ্যেই রয়েছে যে সত্য আমরা পেতে চাই, তা সাহসী সাধনায় প্রকাশ পায়। অরবিন্দের কথায়, ‘The world is preparing for a new creation.’ আর এই নতুন সৃষ্টি, এই ভবিষ্যতের নির্মাতা, নিঃসন্দেহে জেনারেশন জি । তাই আজকের লাগাতার পরিবর্তনের যুগে, বিভ্রম ও অনিশ্চয়তার মাঝেও, আরবিন্দ ঘোষের দর্শন তরুণদের মনে করিয়ে দেয়— সবচেয়ে বড় বিপ্লব হল চেতনার বিপ্লব, আর সেই বিপ্লবের যাত্রা শুরু হয় আজ থেকেই, এই মুহূর্ত থেকেই।