দীর্ঘ লড়াই-আন্দোলনে অর্জিত ২৯টি শ্রম আইন বাতিল করে চারটি শ্রম কোড চালু করেছে কেন্দ্রের মোদী সরকার। এই চার শ্রম কোডে শ্রমিকদের অর্জিত অধিকার এবং প্রাপ্ত সুযোগ কর্পোরেটদের কেড়ে নেওয়ার অবাধ সুবিধা করে দেওয়া হয়েছে। দেশে দীর্ঘদিন ধরে চালু থাকা শ্রম আইন ও তার সীমাবদ্ধতার বিকল্প এই শ্রম কোড হতে পারে না। দেশের ২৯টি শ্রম আইন নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত দেশের শ্রমিকদের সুরক্ষা দিয়ে আসছিল। আমাদের পুরনো শ্রম আইনে শ্রমিকের মজুরি, কাজের সময়, সামাজিক সুরক্ষা, শিল্পে শ্রমিকের নিরাপত্তা, ইন্সপেকশন, শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি আদায়ের দরাদরি করার সুযোগ ছিল। সেই আইনে যেসব সীমাবদ্ধতা ছিল তা দূর করে শ্রম আইন আরও সহজ সরল সহজ করার বদলে কেন্দ্র শ্রম কোড নিয়ে এসেছে। এতে শ্রম আইনকে লঘু করা হয়েছে। শ্রম আইনে শ্রমিকদের যে অধিকার দেওয়া হয়েিছল শ্রম কোডে তা কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
নতুন শ্রম কোডের ফলে দেশে শিল্পে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বাড়বে বলে মোদী সরকারের পক্ষ থেকে যে দাবি করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। শ্রম কোডের আসল পরিকল্পনা পুঁজির আক্রমণের সামনে নিরস্ত্র শ্রমিকদের ফেলে দেওয়া। শ্রম আইনে শ্রমিকদের যে রক্ষাকবচ ছিল, শ্রম কোডে তা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রের সরকার দেশি ও বিদেশি পুঁজিপতিদের লোভ দেখাতে শ্রমিকের সুরক্ষার ব্যবস্থাই তুলে দিয়েছে। কেন্দ্র আরও চাইছে, দেশে শ্রমিকদের ধর্মঘটের এবং দাবিদাওয়া নিয়ে দরকষাকষির যে অধিকার রয়েছে, তা পাকাপাকিভাবে তুলে দিতে।
এই শ্রম কোডের মাধ্যমে দেশে জঙ্গলরাজ কায়েম করতে চায় কেন্দ্র। এতে কর্পোরেটদের একচেটিয়া ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের শ্রমিকদের যাবতীয় অধিকার গুঁড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা পেয়েছে কর্পোরেটরা। প্রশাসনের সক্রিয় সহযোগিতা পাচ্ছে কর্পোরেটরা।
শ্রম কোড দেশের সংযুক্ত রাষ্ট্র কাঠামো এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতি লঙ্ঘনের এক কুৎসিত উদাহরণ। এই শ্রম কোড আনার আগে কেন্দ্র কোনও ত্রিপাক্ষিক আলোচনাও করেনি। শ্রম কোড প্রণয়নের ক্ষেত্রে শ্রমিক ইউনিয়নগুলিকেও যুক্ত করা হয়নি। তাদের বাদ দিয়েই এই শ্রম কোড তৈরি করা হয়েছে। সংসদেও বিনা আলোচনায় পাশ করা হয়েছে শ্রম কোড বিল। শ্রম কোডের বিরুদ্ধে যাবতীয় যুক্তি ও সমালোচনা উড়িয়ে দিয়ে কেন্দ্র নিজের ইচ্ছামতো তা তৈরি করেছে।
শুধু শ্রম কোড লাগু করেই থেমে থাকল না মোদী সরকার। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ শিক্ষা, বিমা, ব্যাহ্ক, এমনকি পারমাণবিক ক্ষেত্রের ঢালাও বিকেন্দ্রীকরণ। তারই সঙ্গে কর্পোরেট ক্ষেত্রকে বিশেষ আইনে ছাড় দেওয়া। শ্রমিকদের পাশাপাশি কৃষকদের স্বার্থ বিঘ্নিত করতে পরিকাঠামোগত উন্নয়নের যুক্তি দেখিয়ে কৃষিজমি অধিগ্রহণের নিয়ম আরও সহজ করা হচ্ছে।
আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া সংসদের শীতক্ষেত্র বেসরকারি মালিকানার জন্য খুলে দেওয়া, ইউজিসি সহ উচ্চশিক্ষার অন্যান্য নিয়ামক সংস্থাগুলি তুলে দেওয়া, জাতীয় সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে আরও সহজে কৃষিজমি অধিগ্রহণ, ব্যাঙ্ক ও বিমা ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ সহজ করার মতো বেশ কয়েকটি বিল আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাব হতে পারে এমন বিলগুলির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ‘পারমাণবিক শক্তি বিল’। এর মারফত অসামরিক পারমাণবিক ক্ষেত্রে বেসরকারি মালিকানার পথ প্রশস্ত করা হবে। দেশের পারমাণবিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির একচেটিয়া ক্ষমতা খতম করার প্রস্তাব এ বছরের বাজেট অধিবেশনেই করা হয়েছিল. এই বিল আইন আকারে পাশ হলে একাধারে বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত পারমাণবিক কেন্দ্রের বেসরকারিকরণের সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে তাদের নিজস্ব পারমাণবিক কেন্দ্র খোলার অনুমতি দেওয়া হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অসামরিক পারমাণবিক ক্ষেত্র বেসরকারিকরণের পথ খুলে দেওয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য ‘নিউক্লিয়ার পাওয়ার কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেড’ (এনপিসিআইএল)-কে আরও দুর্বল করা এবং ‘ইনিশিয়াল প্রাইস অফারিং’ (আইপিও)-র মাধ্যমে তা বাজারের দখলে সমর্পণ করা। এর পরবর্তী পদক্ষেপে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে তাদের নিজস্ব পারমাণিক কেন্দ্র খোলার অনুমতি দেওয়া হবে।
ভারতের উচ্চশিক্ষা কমিশন বিলের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার তিন সর্বভারতীয় নিয়ামক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন (এআইসিটিই) এবং ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার এডুকেশন (এনসিটিই) তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই তিন সংস্থার দায়িত্ব এবার থেকে ভারতের উচ্চশিক্ষা কমিশন (এইচইসিআই) নামের এক নতুন সংস্থা পালন করবে। ২০২০-র জাতীয় শিক্ষানীতি প্রয়োগ করতে এই নতুন বিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর প্রধান উদ্দেশ্য উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রীয়করণ।
এই নতুন কমিশনের মূলত তিনটি প্রধান ভূমিকা নিয়ন্ত্রণ, স্বীকৃতি প্রদান (অ্যাক্রেডিটেশন) এবং পেশাগত মান নির্ধারণ। শিক্ষা ব্যবস্থার চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে বিবেচিত ‘তহবিল’ বা অর্থায়নের বিষয়টি অবশ্য এইচইসিআই-এর হাতে থাকছে না। অর্থ বরাদ্দের দায়িত্ব বা কর্তৃত্ব সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রকের হাতে দেওয়া হবে। ২০১৮-য় এই সংক্রান্ত একটি খসড়া বিল প্রস্তাব করা হয়। প্রকৃত অর্থে সেই খসড়া বিল প্রান্তিক অংশের মানুষ ও রাজ্যস্তরের প্রতিনিধিত্ব বাদ দিয়ে সরকারি আমলা এবং কর্পোরেট প্রভুদের হাতে প্রভূত ক্ষমতা তুলে দেবে।
অন্যদিকে, বিমা ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই)-এর ঊর্ধ্বসীমা বাড়িয়ে ১০০ শতাংশ করতে সংসদের এই অধিবেশনে নতুন বিল প্রস্তাব করা হবে। এই বিমা আইন (সংশোধনী) বিলের কথিত উদ্দেশ্য বিমা শিল্পের প্রসার ঘটানো এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বাড়ানো। এই সংশোধনীর আরও একটি উদ্দেশ্য হলো বিমা ক্ষেত্রের ঢালাও বেসরকারিকরণ এবং তাতে বিদেশি ফাটকাবাজদের দখল বাড়ানো।
সংসদের আসন্ন অধিবেশন এইসব বিষয় নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠবে বলেই সকলে মনে করেন।