মহম্মদ শাহাবুদ্দিন
পরিবার বেঁধে রাখে আমাদের সম্পর্ককে। অনেক দিন হল সম্পর্কের এই বাঁধন থেকে আমরা আলগা হতে শুরু করেছি। প্রতিটি যুগে সমাজের হাজারো পরিবর্তনে পরিবারের ছায়া মানুষকে স্পর্শ করে এসেছে। যে ছায়া মানুষের মানবিক সম্পর্কগুলোকে লালন করেছে। সমাজতাত্ত্বিকরা বলেন পরিবার হলো সমাজের মৌলিক কোষ। প্রেম ভালবাসা মান অভিমান আদর সোহাগের ছোঁয়ায় মিশে পরিবার অটুট বন্ধনের ভিত গড়ে। পরিবার মানুষকে ধাপে ধাপে গড়ে তোলে। আপন অস্তিত্ব বিকাশের এই মরুদ্যান থেকে আমরা অনেকটা সরে এসেছি। আমরা জনসংখ্যায় বাড়ছি, কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছি মানবিক মূল্যবোধহীনতার মধ্যে। এক সময় নিঃসঙ্গ মানুষ দলবদ্ধ হতে চেয়েছিল, তারা চেয়েছিল নিরাপত্তা, নিয়ম, মানসিক স্বস্তি। এমনি করেই মানুষ এক সময় তৈরি করে ফেলেছিল পরিবার। পরিবার ছিল মানুষের দলবদ্ধতার মূলমন্ত্র। এখানে জীবনখাতার প্রতিদিনের পাতায় থেকে যায় সঙ্ঘবদ্ধ জীবন যাপনের কোলাহলের চিহ্ন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পশ্চিম ইউরোপে পরিবার নিয়ে ইতিহাস ঘেঁটে দেখার আগ্রহ দেখা দিয়েছিল প্রবলভাবে। পশ্চিমা বিশ্বে একসময় বাইবেলের মানব প্রেমের কথাকে পরিবারের উৎপত্তি হিসাবে মানা হতো। বলা হয় বাইবেলের পিতৃতান্ত্রিক আদর্শ ও অনুশাসনগুলো ছিল পরিবারতন্ত্র গড়ে ওঠার ভিত্তি। সমাজতাত্ত্বিকরা সাধারণত বিবাহ কিংবা রক্তের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে আত্মীয়তার পরিচয় দিতে গিয়ে পরিবার শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন। তাঁদের ধারণা বিবাহ এবং পারিবারিক ব্যবস্থার মধ্যে পরিবার গঠন ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের একটি যোগসূত্র রয়েছে। ইতিহাসের পিছনে হাঁটলে ২৩৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়ায় প্রথম নথিভুক্ত বিবাহ অনুষ্ঠানের প্রমাণপত্র পাওয়া যাচ্ছে। পরবর্তী কয়েকশ বছর ধরে প্রাচীন হিব্রু, গ্রীক ও রোমানদের মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। পরিবারে পিতারাই কর্তৃত্ববাদী ভূমিকা পালন করতো। এই কতৃত্বের অধীনে প্রাপ্ত বয়স্ক, শিশু থেকে দাস, সবাই পরিবারের সদস্য ছিল। চতুর্দশ শতকের আগে নথিভুক্ত করে বিবাহের প্রচলন ছিল না। ফলে একজন পুরুষের এক বা একাধিক নারীর ওপর কর্তৃত্ব চেপে বসেছিল। এতে পারিবারিক অশান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছে যেত। নথিভুক্তির মাধ্যমে বিবাহ পারিবারিক সংস্কার পরিধিতে একটা সীমা টেনে দিতে পেরেছিল।
আধুনিক নাগরিক জীবন ও শিল্পায়নের পথ ধরে পরিবার কাঠামোতেও পরিবর্তন এসেছে। পারিবারিক সংঘবদ্ধতাকে নিয়ে এসেছে আধুনিকায়ণের বৃত্তে। একদিকে শিল্প বাণিজ্যের বিস্তার ভেঙে দিয়েছে গ্রামীণ সমাজ অর্থনীতিকে। এই দুঃসহ সময় গ্রন্থিতে জীবিকার টানে মানুষ হয়েছে শহরমুখী। রুটি রুজির তাগিদে গ্রামের বড় পরিবারগুলোও ভেঙে যেতে শুরু করেছে অনেকদিন। আলগা হয়েছে যৌথ পরিবারে অভিভাবকের কতৃত্ব ও অনুশাসনের শিকড়।
পরিবার মানসিকতার এত ভাঙনের পরেও আমরা শেষ অবধি দেখেছি পরিবারই মানুষের দলবদ্ধতার মূল জায়গা। সব সম্পর্ক, অনেক চাওয়া পাওয়াকে এখানে আমরা এক সঙ্গে বাঁধতে পারি। মানুষ তাই এখনও বিশ্বাস নিয়ে অনেকের মাঝে, পরিবারের মাঝে সমাজ শৃঙ্খলার মাঝে থাকতে চায়। দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধের পরে অর্থনৈতিক সামাজিক সঙ্কট, খেয়ে পরে বাঁচার ভাগদৌড়ে বয়ে যাওয়া সময়ের মধ্যে এনেছিল নানান সংঘাত। মানুষ নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সংসারের ছোট খাটো কাঠামোটাকে তখন নিজের করে নিল। জমি, সম্পত্তির বিবাদ, বৃদ্ধ অভিভাবকের ভরণপোষণ নিয়ে বিরোধ সবার অস্তিত্বকে আলাদা করে দেখিয়ে দিল। মানুষ বেছে নিল নিভৃত সুখের নির্জনতা। আত্মসুখের অনুভূতি ঘিরে রাখল তাকে। পুরানো বাড়ি ভেঙে পড়ার মতো মানুষের নিজের একান্ত আপন কিছু সম্পর্কও ভেঙে যেতে লাগলো।
পরিবার ভেঙে যৌথজীবনের স্বাদও ফুরিয়ে গেল। এতো সম্পর্কের পতনের ভিতর মাঝে মাঝে আমরা অভিভাবকের আশ্রয় খুঁজ। হারানো মানুষগুলোর ছবিতে মালা দিই। বৃদ্ধাবাসে কাটানো কোনও আত্মীয়ের কথা ভেবে আফসোস করি। তবে ছোট পরিবারে সুখ আহ্লাদ কিন্তু ভুলি না। জন্মদিন, পার্টি, আউটিং, উটি, কাশ্মীর, পুরী, দার্জিলিং ভুলি না। আত্মকেন্দ্রিকতার গভীর উৎস থেকে উঠে আসে ছোট পরিবারের এই সব নিঃসঙ্গ আনন্দ।
জীবন এখন আর বহতা নদীর মতো নয়। জীবন অ্যাপার্টমেন্ট, বিদেশের হাতছানি, কর্পোরেট বৃত্তের মধ্যে হাঁপিয়ে ওঠে। এক অসম্ভব গতিময়তায় আমরা ভীষণ ক্লান্ত। থেমে থাকলে চলবে না। মৃত্যু সংবাদ, আনন্দের খবর আসে হোয়াটস আপ ফেসবুকের বার্তা হয়ে। মনের অনুভূতি জানাতে নানান ই-মোজি পাঠালেই চলে। রিল্যাক্স-এর জন্য নেটফ্লিক্স অ্যামাজনের দরকার হয়। রবীন্দ্রনাথকে বাঁচিয়ে রাখলেও, ভুলে গেছি শরৎচন্দ্র নজরুল জীবনানন্দ। পুরানো ভালো লাগাকে রিওয়াইন্ড করে শুনতে হয় শ্যামল, হেমন্ত, সন্ধ্যার গান। এসবই আমরা পেয়েছিলাম পরিবারের সান্নিধ্যে, পরিবারের কালচারে। হাতের মাঝে সেই প্রবীণের হাত যার সাহায্য ছাড়া আজকের এই আমার অস্তিত্বই পায়ো যেত না, তাকে যেন কোথায় হারিয়ে এসেছি। আমরা শুধু যেন কোথায় হারিয়ে এসেছি। আমরা শুধু চেয়ে দেখছি। মানুষ বদলে যাচ্ছে। সেই কবে আমরা এক সাথে বসে গল্প করেছি, কথা বলেছি একে অপরের সাথে। দরকার নেই, তাই কথাও নেই। সবাই কী ভীষণ ভাবে ব্যস্ত, এই ভেবে নিজেকে একা করে নিচ্ছে সবাই। সমাজ আর সমগ্রে বিশ্বাস করে না। সমাজ এখন একা মানুষদের আগলে রাখে। ভিতর থেকে ভাঙছে মানুষ, পরিবার, তার পতনের শব্দ এসে ঘা দিচ্ছে সমাজের অন্তরে।
নিউক্লিয়ার পরিবারের এই সময়কালে একদা ডালপালা বিস্তৃত পারিবারিক মূল্যবোধের ক্ষীণ ভগ্নাংশ আজও বর্তমান একক পরিবারগুলিতে। সেখানে খুঁজলে পাওয়া যাবে পুরনো অ্যালবাম। যৌথ পরিবারের কত ছবি সেখানে স্মৃতি হয়ে আছে। কারও বাড়িতে এখনও রাখা আছে সাবেকি পেতল কাঁসা। এখন ফ্লাট বন্দি ছোট পরিবারে বাক্সবন্দি স্মৃতি ভাণ্ডার। ভেঙে আসা পরিবারের লক্ষ্মীর পট কিংবা পুরানো নামায পার্টি বহু পরিবারে আজও সংরক্ষিত। আধুনিক ফ্ল্যাটবাড়ির খোপে আলো জ্বলে, সন্ধেবাতি জ্বলে না। তবুও প্রায় সব ঘরেই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যাবে সযত্নে রাখা সাঁঝবেলার শাঁখ।